ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক অদ্ভুত প্রতিভা ছিলেন তিনি। নাম জুবিন গার্গ। গানে, গিটারে, হারমোনিয়ামে, কিংবা কণ্ঠে— সুরের সঙ্গে তার যে গভীর বন্ধন ছিল, তা তাকে বেঁচে থাকতে কিংবদন্তির আসনে বসিয়েছিল। আর তাই ৫২ বছর বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর খবরে শুধু সংগীতজগৎ নয়, গোটা ভারত উপমহাদেশেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
গত শুক্রবার দুপুরে সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে নেমেই অকালমৃত্যু হয় এই সংগীতশিল্পীর। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গুয়াহাটির রাস্তায় হাজারো ভক্ত জড়ো হন প্রিয় শিল্পীর মরদেহকে একনজর দেখতে। স্ত্রীর অশ্রুভেজা বিদায় দৃশ্য যেন পুরো শোককে আরও ভারী করে তোলে।
বহুভাষিক কণ্ঠের জাদুকর
অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি—এমনকি বলিউডের জনপ্রিয় ছবিতেও সমান সাবলীল ছিলেন জুবিন গার্গ। ২০০০ সালের পর থেকে শুরু হয় তার মূল যাত্রা। একদিকে বলিউড সিনেমা গ্যাংস্টার–এর “ইয়া আলি” গান তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়, অন্যদিকে ঘরোয়া টোনে গাওয়া বাংলা গান তাকে বাঙালি হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে দেয়।
তার গানে ছিল সহজ-সরল ভালোবাসা, আঞ্চলিক স্বাদ আর একধরনের মাটির গন্ধ। শহুরে ঝলমলে রঙ থেকে দূরে থেকেও, তার কণ্ঠে শোনা যেত বিশ্বজনীন আবেদন।
জীবনে সরলতা, ভালোবাসায় ভরপুর
অর্থের পেছনে দৌড়ানো মানুষ ছিলেন না জুবিন। বড় কোনো প্রজেক্ট হাতে নিলেই সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করতেন, বাকি সময়ে থাকতেন নিজের মতো। আসামের শান্ত পরিবেশেই তিনি খুঁজে নিতেন প্রশান্তি।
নিজের বাড়ি ও স্টুডিও সাজিয়েছিলেন বাঁশের কাজ, হস্তশিল্প ও স্থানীয় শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবিতে। বিলাসবহুল জীবনযাপনের চেয়ে সাদামাটা জীবন তাকে বেশি টানত। তবে গাড়ি ও বাইকের প্রতি দুর্বলতা ছিল বিশেষ। তার গ্যারেজে ছিল মার্সিডিজ বেঞ্জ, রেঞ্জ রোভারসহ বেশ কিছু দামী মোটরবাইক।
বাংলা গানে অবদান
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতাদের কাছেও জুবিন ছিলেন সমান প্রিয়। ভক্তদের কাছে অমলিন হয়ে থাকবে তার অসংখ্য বাংলা গান। এখনও প্লেলিস্টে বেজে ওঠে—
১. চোখের জলে
২. বোঝেনা সে বোঝেনা
৩. পিয়া রে পিয়া রে
৪. আয়না মন ভাঙা আয়না
৫. তোমার আমার প্রেম
৬. হাবুডুবু হাবুডুবু
৭. প্রেম কি বুঝিনি
৮. ও বন্ধুরে
৯. লাগে না লাগে না
১০. মন তোকে দিলাম
প্রতিটি গান যেন বয়ে আনে একেকটি স্মৃতি, একেকটি সময়ের আবেগ।
আসামের শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রীয় শোক
তার মৃত্যুর পর আসাম রাজ্যজুড়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করেছেন তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। মানুষের কণ্ঠে ভেসে এসেছে একটাই কথা—“আমাদের প্রিয় জুবিন নেই, কিন্তু তার গান আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে।”
বিদায়ের পরও অমর
জুবিন গার্গ চলে গেলেন, কিন্তু তার সুর থেকে গেল সর্বত্র। ঘরে-বাইরে, গ্রামে-শহরে, হেডফোনে বা মঞ্চে—যেখানেই শোনা যাবে তার কণ্ঠ, মনে হবে তিনি এখনো আছেন, আমাদেরই মাঝে।
সংগীতের মতোই সরল, সহজ আর হৃদয়ছোঁয়া ছিল তার জীবন। তাই জুবিন গার্গের মৃত্যু শুধু এক শিল্পীর বিদায় নয়, বরং এক যুগের আবেগময় সমাপ্তি। তবুও তার গানই প্রমাণ করে—সুরের যাত্রীদের আসলেই মৃত্যু হয় না।