সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো শব্দে মাপা যায় না— কখনো তা পরিণত হয় সুরে, কখনো স্মৃতিতে, আর কখনো হয়তো জাদুঘরে। ভারতের আসামের গৌহাটিতে এক তরুণ ভক্ত বিশাল কালিতা তার প্রিয় শিল্পী জুবিন গার্গের স্মৃতিতে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য সংগীত জাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে ৩৮ হাজার গান, শত শত সিডি-ক্যাসেট আর দুর্লভ পোস্টার।
জুবিন গার্গ— আসামের সংগীতের প্রতীক, উত্তর-পূর্ব ভারতের আত্মার কণ্ঠস্বর। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর সফরে তার মৃত্যু হয়। প্রথমে শোনা যায়, দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মারা গেছেন তিনি। কিন্তু দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রশ্ন, রহস্য, আর আবেগের ঢেউ।
এই শোকের ভেতরেই উঠে আসে এক অসাধারণ গল্প— ভক্ত বিশাল কালিতার। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে জুবিনের গান, অ্যালবাম, ক্যাসেট ও পোস্টার সংগ্রহ করেছেন। তার নিজের বাড়িটিই এখন এক পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর— ‘মিউজিক্যাল মিউজিয়াম’— যেখানে প্রতিটি কোণে বাজে ভালোবাসার সুর।
‘আমার সংগ্রহে থাকা অনেক ক্যাসেটই এখন বিরল। আমি চাই এগুলো আবার মানুষের স্মৃতিতে ফিরুক,’ বলেছেন বিশাল কালিতা, যিনি এখন এই জাদুঘরটি সাধারণের জন্য খুলে দিয়েছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য—জুবিন নিজে মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে এই জাদুঘরে গিয়েছিলেন। বিশাল কালিতাকে তিনি তখন বলেছিলেন— ‘এই বিশাল সংগ্রহ আমাকে আমার ভুলে যাওয়া বহু স্মৃতি মনে করিয়ে দিল।’ এই একটি বাক্য আজ যেন কালিতার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় বারবার। তার বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে এখন জুবিনের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, ভক্তদের প্রার্থনা, আর এক অশেষ শ্রদ্ধার নিদর্শন।
ত্রিশ বছর বয়সী বিশাল কালিতার সংগ্রহে রয়েছে এমন কিছু গান, যা পৃথিবীর আর কোথাও নাও থাকতে পারে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— কালিতার জাদুঘর ‘বিশ্বের অন্যতম ব্যক্তিগত সঙ্গীত সংরক্ষণাগার’, যেখানে দুর্লভ ও অপ্রাপ্য রেকর্ডিং সংরক্ষিত আছে।
জুবিনের মৃত্যুতে শোকাহত আসাম আজও স্তব্ধ, কিন্তু কালিতার সংগ্রহ যেন সবার জন্য এক আশ্রয়— স্মৃতি থেকে না মুছে যাওয়া সুরের আশ্রয়।
‘আমি শুধু চাই মানুষ যেন জুবিন গার্গকে গান দিয়ে মনে রাখে,’ বললেন কালিতা। ‘এই জাদুঘর আমার নয়, এটা আসামের মানুষের।’
ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না— শুধু রূপ বদলায়। জুবিন গার্গের গলায় যে সুরে মানুষ কেঁদেছে, আজ সেই সুরই আবার ভেসে আসে তার এক ভক্তের বাড়ি থেকে। একটা ছোট ঘর, দেয়ালে হাজার পোস্টার, তাক জুড়ে পুরোনো ক্যাসেট আর অদম্য আবেগ, সেখানে দাঁড়িয়ে সময় যেন বলে যায় —
‘একজন শিল্পী মরেন না, যদি কেউ তাকে ভালোবাসতে থাকে।’