মঞ্চে আলো ঝলমলে, ক্যামেরার শত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণী— আত্মবিশ্বাসী, স্থির, আর গর্বে উজ্জ্বল। তিনি তানজিয়া জামান মিথিলা, মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের মুকুটধারী। তবে তার সামনে দাঁড়ানো দর্শকদের দৃষ্টি শুধু তার সৌন্দর্যে নয়— বরং তার পরনে থাকা সোনালি-রুপালি আলোয় ঝলমলে জামদানি শাড়িতেও আটকে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার ৭৪তম আসরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনি যে বার্তা নিয়ে এসেছেন, তা শুধু ফ্যাশনের গল্প নয়— এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পরিচয়ের গল্প।
জামদানির রাজকীয়তায় বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ
মিথিলা যখন বললেন— ‘প্রতিটি সুতোয় আছে শিল্প, পরম যত্ন আর জাতির ইতিহাস’—তা শুধু একটি পোশাক বর্ণনা নয়, বরং শত বছরের উত্তরাধিকারকে নতুন করে ব্যাখ্যা করা। জামদানি সবসময়ই ছিল বাংলার অভিজাতদের পোশাক— মুঘল সম্রাট, নবাব, জোতির্ময় রানীদের পছন্দের শাড়ি। সেই একই ঐতিহ্য আজ রূপ নিয়েছে আধুনিক মঞ্চে।
এই শাড়িটি বোনা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে, যেখানে আজও তাতশিল্পীরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে অতুলনীয় নকশা তৈরি করেন। মিথিলার শাড়িটি তৈরি করতে লেগেছে ১২০ দিনেরও বেশি সময়। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা যেন দেশের শিল্পের প্রতি এক নিঃশব্দ সম্মান।
ডিজাইনার আফ্রিনা সাদিয়া সৈয়দা শাড়িটিকে সাজিয়েছেন সূক্ষ্ম শাপলা মোটিফে— যা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। শুধু শাড়িতেই নয়, মিথিলার গয়নায়ও ফুটে উঠেছে একই শাপলার ছায়া; এতটা সমন্বিত পরিকল্পনা যেন দেশের গল্পকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরার এক অনবদ্য চেষ্টা।
মিথিলার অনুভূতিতে দেশপ্রেম
মিথিলা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন— ‘এটি এমন একটি কাপড়, যার প্রতিটি সুতোয় রয়েছে শিল্পকলা, নিষ্ঠা এবং চিরন্তন কমনীয়তা।’ তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস শুধু প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আনন্দ নয়; বরং বাংলাদেশের প্রতি তার তারুণ্যের গর্ব। নিজের পরিচয় তিনি শুধু নিজের নাম বা সাফল্যে নয়— এ ঐতিহ্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন।
মিস ইউনিভার্স মঞ্চে একটি নতুন বাংলাদেশ
থাইল্যান্ডের পাক ক্রেটে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মিস ইউনিভার্সের গ্র্যান্ড ফাইনালে অংশ নিতে মিথিলা পৌঁছেছেন ২ নভেম্বর। প্রতিযোগিতার প্রতিটি ধাপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর প্রতিটি স্টেজে তিনি যেন শুধু একজন প্রতিযোগী নন— বরং বাংলাদেশের সৌন্দর্য, শিল্প, নান্দনিকতা ও সংস্কৃতির দূত।
বিশ্বের সামনে জামদানির ঝলক দেখানো মানেই শুধু একটি পোশাক দেখানো নয়— এটি এক দেশের গল্প তুলে ধরা। শীতলক্ষ্যার তীরের তাতশ্রমিকদের ঘামে বোনা স্বপ্ন, নারীর শৈল্পিক ছোঁয়া, জাতির ঐতিহ্যের গৌরব— সব কিছু মিলেই মিথিলার জাতীয় পোশাক হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত ক্যানভাস।
ফাইনালের আগে আশার স্ফুলিঙ্গ
বাংলাদেশের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে ২১ নভেম্বরের দিকে। হয়তো মুকুট জয় হবে, হয়তো হবে না— কিন্তু এই মুহূর্তে মিথিলা যা করেছেন, তা ইতোমধ্যেই এক নতুন উচ্চতা তৈরি করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন— বিশ্ব মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, শুধু প্রয়োজন উপস্থাপনার সঠিক সাহস এবং আত্মবিশ্বাস।
বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সবচেয়ে সুন্দর পথ হয়তো এটাই— নিজের শেকড়, নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্যকে গর্বের সাথে প্রদর্শন করা। আর এই পথেই হাঁটছেন মিথিলা— ছয় গজ জামদানিকে রাজকীয়তার প্রতীক করে তিনি যেন নতুনভাবে বলছেন— এটাই বাংলাদেশ, শিল্প আর সৌন্দর্যের দেশ।