কলকাতা— এই শহর জানে কীভাবে আবেগ জমাতে হয়। ফুটবল আর সিনেমা— দুই আলাদা জগতের দুই রাজাকে এক ফ্রেমে দেখার স্বপ্নে ভোর থেকেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের দিকে ছুটেছিল মানুষ। গ্যালারিতে ঢেউ তুলেছিল অপেক্ষা। কিন্তু মাঠের কোলাহল ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত হয়ে রইল মাঠের বাইরের এক নীরব সাক্ষাৎ— লিওনেল মেসি আর বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের।
শাহরুখ খান নিজেই জানিয়েছিলেন, মেসির সঙ্গে দেখা করতে তিনি কলকাতায় আসছেন। পরিকল্পনায় ছিল যুবভারতীতে উপস্থিতি। কিন্তু বাস্তবতা বদলে দেয় দৃশ্যপট। ভিড়, উত্তেজনা আর নিরাপত্তাজনিত জটিলতায় মাঠের কর্মসূচি বাতিল হয়। তারকাদের মিলন ঘটল হোটেলের শান্ত পরিসরে— দূরে নয়, কাছাকাছি; উচ্চস্বরে নয়, নিঃশব্দে।
হোটেল লবিতে মেসির সঙ্গে দেখা করেন শাহরুখ। সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে আব্রাম। ফুটবলের জাদুকরের পাশে দাঁড়িয়ে আব্রামের সেই ছবি যেন দুই প্রজন্মের স্বপ্নকে এক সুতোয় গেঁথে দিল। একদিকে মাঠে জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি, অন্যদিকে পর্দার রাজা— দু’জনেই যার যার জগতে অনুপ্রেরণার নাম। ফ্রেমবন্দি সেই মুহূর্তে হাসি ছিল, ছিল সৌজন্য— আর ছিল ভক্তদের কল্পনায় ভাসতে থাকা ‘যদি’।
প্রায় প্রতি বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে শাহরুখের উপস্থিতি কলকাতাবাসীর কাছে উৎসবেরই অংশ। এ বছর তার অনুপস্থিতি মন খারাপ করেছিল অনেকের। মেসির সফর সেই শূন্যতায় আশা জাগিয়েছিল— অন্তত যুবভারতীতে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যাবে। কিন্তু কোলাহল যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তারকাদের নিরাপত্তাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।
ভোর থেকে জমা হওয়া হাজার হাজার দর্শক, তার ওপর অতিরিক্ত ভিড়— মাঠে পৌঁছেই মেসিকে ঘিরে ধরেন অনেকে। গ্যালারি থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। হতাশা থেকে ক্ষোভ, আর ক্ষোভ থেকে বিশৃঙ্খলা— মুহূর্তে বদলে যায় পরিবেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে মেসিকে দ্রুত মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাতিল হয় পরবর্তী সব কর্মসূচি। সেই প্রেক্ষিতেই শাহরুখের যুবভারতীতে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল হয়।
এই ঘটনাই মনে করিয়ে দেয়— তারকাখ্যাতি যতটা আলোয় মোড়া, ততটাই ভিড়ের ভারে নুয়ে পড়ে। এক ফ্রেমের জন্য মানুষের উন্মাদনা কখনো কখনো নিজেই নিজের শত্রু হয়ে ওঠে। অথচ হোটেলের শান্ত সাক্ষাৎ দেখায় আরেক ছবি— সীমিত মানুষ, সীমিত মুহূর্ত, অথচ স্মরণীয়।
শাহরুখ খান হোটেল থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে মুম্বাই ফিরে যান। মাঠে তাদের দেখা না হলেও গল্প থেমে থাকেনি। কারণ কিংবদন্তিদের মিলন সব সময় গ্যালারির শোরগোলেই ঘটে না— কখনো কখনো নিঃশব্দ এক করিডর, একটি হাসি আর একটি ছবি দিয়েই ইতিহাসের ছোট্ট অধ্যায় লেখা হয়।
কলকাতা হয়তো এবার মাঠে সেই ফ্রেম পায়নি। কিন্তু পেয়েছে আরেকটা গল্প— যেখানে ভিড়ের বাইরে, আলোচনার কেন্দ্রে, মেসি আর শাহরুখ হয়ে উঠেছেন শুধু দুই তারকা নয়, দুই স্বপ্নের প্রতিনিধি।