ফিরোজা বেগমের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার
২৮ জুলাই ২০১৮ ১৬:৫৪
।। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এসএম মুন্না ।।
ফিরোজা বেগম-এই উপমহাদেশে নজরুলসঙ্গীতের ভুবনে এক কিংবদন্তি শিল্পী। প্রখ্যাত এই শিল্পী-সাধকের অসাধারণ সাফল্যের পেছনে যেমন রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা, তেমনি প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত (কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য গানের সুরকার) এবং চিত্ত রায়ের (নজরুলের প্রধান সহকারী) মতো খ্যাতিমান ওস্তাদের সান্নিধ্য লাভ। চল্লিশের দশকের শুরুতে তৎকালীন বিখ্যাত রেকর্ডিং কোম্পানি এইচএমভির এক রিহার্সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় নবীন শিল্পী ফিরোজা বেগমের। এ সময় ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে গান শুনে কবি বড়ই মুগ্ধ হন। আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করেন এবং এই শিল্পী যে একদিন বড় শিল্পী হবেন-সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন। সেই দিনের সেই নিষ্ঠাবান ও দৃঢ়চেতা তরুণী ফিরোজা তার কণ্ঠের জাদু দিয়ে নজরুলের করা ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করেছেন। হয়ে উঠেছিলেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের প্রতীকিরূপ। নজরুলের গান গেয়ে ‘নজরুল-সম্রাজ্ঞী’ উপাধিও পেয়েছেন।
২০০৮ সালে কোনো এক ঝড়-বৃষ্টিসন্ধ্যায় বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ সম্পাদিত পত্রিকা ‘এখন’ এর জন্য বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নজরুল সঙ্গীতের এই সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম। পরবর্তীতে কোনো এক কারণে সাক্ষাৎকারটি আর প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি পুরনো ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে সাক্ষাৎকারটি পাওয়া গেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাপ্তাহিক এখন এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসএম মুন্না। সেই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ফিরোজা বেগমের ৮৮তম জন্মদিনে (২৮ জুলাই) ‘সারাবাংলা ডট নেট’ এর পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।
সেদিনের বিশেষ সাক্ষাৎকারে ফিরোজা বেগম নজরুল-সঙ্গীতের সঙ্গে তার সখ্যতা, দেশে নজরুলসঙ্গীত চর্চার সমস্যা ও ঘাটতি, নজরুলসঙ্গীতে বাণী ও সুরের বিকৃতির অভিযোগসহ নানা বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য অনেক মন্তব্য ও মতামত তুলে ধরেন। একইসঙ্গে তিনি কবি নজরুলের একটি অজানা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেন। কবির সঙ্গে তার আনন্দ-বেদনা জড়িত কিছু ঘটনারও স্মৃতিচারণ করেন।
প্রশ্ন : সঙ্গীত শেখার আগ্রহ বা প্রেরণা পেলেন কার কাছ থেকে?
ফিরোজা বেগম : (স্মিত হেসে) এগুলো সবাই জানে। তারপরেও বলছি আমার প্রথম রেকর্ড বের হওয়ার আগে কারও কাছে গান শিখিনি। তবে স্কুলজীবনে গান, নাচ, আবৃত্তি করতাম। অনেক পুরস্কারও পেয়েছি। বেশিরভাগই প্রথম পুরস্কার। সঙ্গীতজগতে নিজেকে যুক্ত করার সমর্থন পেয়েছিলাম আমার পরিবারের কাছ থেকে। পরিবারের সবাই নজরুল অনুরাগী ছিলেন। আমার বাবা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল নজরুলসঙ্গীত অসম্ভব পছন্দ করতেন ও নিয়মিত শুনতেন। ’৪৩ সালে যখন কলকাতায় আমার বোনের বাসায় নিয়মিত যেতাম। আমার বোন ও ভগ্নিপতি ওই সময় আমাকে গান শেখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। সঙ্গীত জীবনে সাফল্য পাওয়ার পেছনে তাদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের কথা আমি সব সময় স্মরণ করবো।
প্রশ্ন : কিভাবে গানের চর্চা করতেন?
ফিরোজা বেগম : আমাদের বাড়িতে একটি গ্রামোফোন এবং বেশ কিছু রেকর্ড ছিল। গ্রামোফোনে সে সব রেকর্ড বাজিয়ে গান করতাম। তখন আমি সব ধরনের গানই গাইতাম। তখন জানতাম না আমি কী শিখছি। আমাকে যা বলা হতো, তাই করতাম। একবার যা শুনতাম, তা গাইতে পারতাম-এটা আমার একটি বিশেষ গুণ যেটা ওপরওয়ালা আমাকে দিয়েছেন। সে কারণেই যাই শুনি না কেনো, তাই রপ্ত করতে অসুবিধা হতো না। হারমোনিয়ামটাও বাজাতে শিখেছি নিজে নিজেই।
প্রশ্ন : আপনার গুরু কে?
ফিরোজা বেগম : আমি আগেই বলেছি আমার প্রথম রেকর্ড বের হওয়ার আগে কারও কাছ থেকে গানের তালিম নেওয়া হয়নি। প্রথম রেকর্ড বের হওয়ার পর সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও নজরুলের প্রধান সহকারী চিত্ত রায়ের কাছ থেকে সঙ্গীতে তালিম নেই। কমল দাশগুপ্ত ছিলেন আমার সঙ্গীত জীবনের প্রধান গুরু। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমার জন্য তিনি সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন। আমার সঙ্গীতে যা শিক্ষা তার সব পেয়েছি কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে। আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন কমল দাশগুপ্ত সর্ম্পকে যিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহু গানের সুর করেছেন। যেগুলো শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীত।
প্রশ্ন : কমল দাশগুপ্ত কাজী নজরুল ইসলামের কতটি গানে সুর দিয়েছেন?
ফিরোজা বেগম : কমল দাশগুপ্ত নজরুলের কত গানের সুর করেছেন, এটা সঠিক করে বলা মুশকিল। কাজী নজরুল ইসলাম কতটি গান রচনা করেছেন-এটাই এখনও গবেষকরা বের করতে পারেনি। আমি সঠিক করে কী করে বলি ? এটা খুব কঠিন কাজ। বর্তমানে এমন কেউ নেই, যিনি সবটা বলতে পারেন। সে জন্য বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এখনও সমাপ্তহীন। তবে নজরুলের গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার-এ কথা বলা হয়। সত্যিকার অর্থে রেকর্ড বা অন্যান্য সূত্রে প্রায় দেড় হাজার গান পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন : কাজী নজরুল ইসলাম সর্ম্পকে অজানা কিছু বলুন?
ফিরোজা বেগম : আমি যখন কলকাতায় গান করেছি, তখন জীবিতদের অনেকেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে কাজ করতেন। তারা তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমি তাদের মুখ থেকে সেসব কথা শুনেছি। সেটাই সঠিক এবং আমি আরও অনেক বেশি কিছু জানি-যা এখনও বলা হয়নি বা গবেষকরা পুরোটা জানতে পারেননি। বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাগুলো। ব্যক্তিগত জীবনে তার ওপর যে ঘাত-প্রতিঘাতগুলো এসেছে, সে প্রসঙ্গে। আমি যাদের কাছ থেকে কবির কথা শুনেছি, তাদের কবির প্রতি যে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা-সেটা আমি খুব কম লোকের মধ্যেই দেখেছি। নজরুল ইসলাম যে দু’জনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাদের একজন চিত্ত রায়। তিনি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান সহকারী। নজরুলের সবই তিনি জানতেন। প্রায় সব সময়ই নজরুলের সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। আরেকজন ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। যিনি ছিলেন নজরুলের পরম বন্ধু। যার সাথে কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত গান নিয়ে পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা এমনকি সুর ভাঙা-গড়া ইত্যাদি সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সেই কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকেও অনেক কিছু জেনেছি নজরুল সম্পর্কে।
প্রশ্ন : নজরুল ইসলামের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি?
ফিরোজা বেগম : সে এক বিষ্ময়কর বিষয় ছিল আমার কাছে। ১৯৪০ সালের দিকে এইচএমভির রিহার্সেল রুমে তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। তখন অনেক ছোট ছিলাম। ওই কক্ষে অনেক গুণী গায়ক-গায়িকা ছিলেন। তখন তিনি আমার গান শুনে উল্লাস প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এতদিন পর আমি সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একটি মেয়েকে রিহার্সেল রুমে দেখলাম। সে যদি গানের জগতে প্রবেশ করে, তাহলে আমি খুবই খুশি হবো।’ তিনি এও বলেন যে, ‘গান শুনে মনে হলো সে খুব বড় গায়িকা হতে পারবে এবং আমি তার জন্য এটাই কামনা করি।’ আর উপস্থিত সবার উদ্দেশে কবি বলেছিলেন, ‘তোমরা ওকে সব রকমের সহযোগিতা করবে। এটা তার জন্য নতুন জায়গা।’
প্রশ্ন : এতো গেলো নজরুলকে নিয়ে আপনার সুখকর স্মৃতি। এমন কোনো স্মৃতি আছে যা আপনাকে আলোড়িত করেছে?
ফিরোজা বেগম : তাহলে তোমাকে একটা ঘটনা বলি। তাকে আমি একদিন খুব বিমর্ষ অবস্থায় দেখেছি। নানা কারণে শেষ দিকে তিনি প্রায় বিমর্ষ থাকতেন। বলতে দ্বিধা করবো না, কারণে হোক বা অকারণে তিনি খুবই অবহেলিত ছিলেন। আমি যখন তার ঘরে আসতাম-যেতাম তখন তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত থাকলে তার দিকেও তাকিয়ে থাকতেন। কাজী সাহেবকে কমল দাশগুপ্ত প্রায়ই বলতেন, ‘কী কাজীদা চিনতে পারেন? তখন আবার আমার মুখের দিকে চোখ মেলে তাকাতেন এবং কী যেন বলতে চাইতেন। আমার মনে হলো তিনি একটু উত্তেজিত। কিছু একটা আমাকে বলতে চাইছেন। কলকাতায় থাকাকালে এ রকম প্রায় হতো, তখন প্রমীলা নজরুল আমাকে বলতেন, তিনি অশান্ত হয়ে উঠেছেন, তুমি বরঞ্চ তাকে একটি গান শোনাও। তখন হারমোনিয়াম আনতে বলা হতো। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যে দরজার দিয়ে হারমোনিয়াম আনা হয়, ওদিকে কাজী সাহেব তাকিয়ে থাকতেন আর কী যেন খুঁজতেন। হারমোনিয়ামটা যেই আসত, তখন তিনি হেসে ফেলতেন। হারমোনিয়াম আনার পর তিনি নিজে কাছে এসে হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন। তখন আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। আমাকে অভয় দিয়ে তখন প্রমীলা নজরুল বললেন, ‘তুমি তাড়াতাড়ি গান কর, দেখবে তিনি শান্ত হয়ে যাবেন।’ তখন আমি গান করলাম এবং তারপর কমল বাবুও গান গাইলেন। তিনি খুব শান্ত-সুন্দরভাবে শুনলেন। তারপর খাট থেকে নেমে এসে আমার পাশে বসে ডান কাঁধে হাত রাখলেন। ওইদিন তার জন্মদিন ছিল না। কিন্তু তার জন্মদিনে আমি যখন গেছি, তখন তিনি আমার পাশে বসে কি যে হাসতেন, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না। আর যদি তার কোনো দুঃখের গান গাইতাম, তাহলে কেঁদে ফেলতেন। একদিন আমি যখন গাইলাম- ‘মুসাফির মোছরে আঁখি জল…’, তখন দেখলাম তার দু’চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে, তিনি আমার হাত ধরে আছেন, আর আমার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি যখন কাঁদতেন, তখন আমারও দু’চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কবির চোখে পানি দেখলে নিজেকে সামলাতে পারতাম না। তিনি তার জন্মদিনের উপহার পাওয়া মালা একটি একটি করে তুলে এনে আমাকে দিতেন এবং হারমোনিয়ামটা ফুলের মালা দিয়ে ভরে ফেলতেন।
ধানমণ্ডির বাড়িতে গিয়েও কাজী সাহেবকে গান শোনাতাম। আমি গেলেই তিনি যে কী রকম করতেন, তা দেখে সবাই অবাক হতো। আরও একটি ঘটনা বলি- কোনো এক কারণে একদিন আমি তার বাসায় গান করতে চাইছিলাম না। তখন তিনি কী যেন বলতে চেষ্টা করছেন। এটা করতে করতে তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেছে। এক পর্যায়ে হঠাৎ ‘গান’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। আর আমি গান গাইতে বসলে তিনি একটি বই এনে খুলে আমার হারমোনিয়ামের ওপর রাখলেন। অনেকেরই গান গাওয়ার সময় হারমোনিয়ামের ওপর খাতা রাখার অভ্যাস, এটা তার মস্তিষ্কে আছে। যদিও আমি খাতা দেখে গান গাইতাম না।
প্রশ্ন : এবার কমল দাশগুপ্তের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই?
ফিরোজা বেগম : বাহ! তুমি দেখি, বাসা থেকে রীতিমতো পড়াশোনা করে এসেছো। এটা ভালো লেগেছে। দ্বিতীয় রেকর্ডিংয়ের সময় কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমার সঙ্গীত জীবনের সৌভাগ্যের শুরু এখান থেকেই। তার মতো শিক্ষাগুরুর সাহচর্য পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। তখনকার সময়ে ভারতবর্ষে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল যে, কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে যদি কেউ একবার ঘুরে না আসে, তাহলে সে বড় শিল্পী হতে পারবে না। পরে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমি গাওয়ার পর ঝড়ের বেগে পশ্চিমবঙ্গ এবং সমগ্র ভারতবর্ষে নজরুলের গান ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর দেশে দেশে ছড়িয়ে গেল। এমন ঘটনা সাধারনত হয় না। অন্য কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে এমনটা তিনি লক্ষ্য করেননি। কিন্তু আমার বেলায় এমনটাই হয়েছে। এটা আমার সৌভাগ্য বলতে হয়। এর পেছনে কবি নজরুলের দোয়া এবং ভালোবাসা ছিল।
প্রশ্ন : আপনার পর নজরুল সঙ্গীতে বাংলাদেশ তেমন বড় মানের কোনো শিল্পী পায়নি, এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?
ফিরোজা বেগম : আমি কোনো বড় মাপের শিল্পী নই। গান করতে করতে নাম হয়ে গেছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। নজরুলের গান গাইতে শুরু করেছি সে সময় যখন নজরুলসঙ্গীত কেউ শুনতো না। যখন শোনে না বলে অবহেলা করে ফেলে রাখা হয়েছিল তখন আমি তা তুলে ধরতেই সফল হয়েছি। এটাই আমার বড় পাওয়া।
প্রশ্ন : চর্চার ক্ষেত্রে নজরুল সঙ্গীত কেনো বেছে নিলেন?
ফিরোজা বেগম : দেশে-বিদেশে নানা মিডিয়ার কাছে এটা নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি বহুবার। উত্তরও দিয়েছি। কিন্তু কেউই আমার সঠিক অনুভূতি বুঝতে পারেননি। তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম, অনেক কিছু করার আছে আমার এবং সেটা নজরুল সঙ্গীত ঘিরে। যারা আমাদের গানের দীক্ষা দিয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন তারাও আমাকে এই একই প্রশ্ন করতেন-এত কঠিন গানের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার হেতু কি? গানের অর্থ জানি-বুঝি কি না। তখন আমি তাদের এর যথাযথ উত্তর দিতে পারিনি। তার কারণ আমার অজ্ঞতা নয়, তখন আমি লাজুক ছিলাম। কিছু বলতে খুবই লজ্জা পেতাম। তবে আমার কাছে নজরুলের গানের কথা খুবই ভালো লাগতো। যেটা পরবর্তীতে আমার হৃদয়ে ওতোপ্রোতভাবে পোক্তভাবে জড়িয়ে যায়।
প্রশ্ন : কবি নজরুলকে কি কারণে পছন্দ করেন?
ফিরোজা বেগম : এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই অন্য কবিদের গানের সঙ্গে কাজী নজরুলের গানের অনেক পার্থক্য আছে। অন্য কবিদের থেকে তার গানের পার্থক্য হচ্ছে তার গানের উপমা একেবারে প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ। অন্যটি তার ভালোবাসার নিবেদন একেবারে সরাসরি। এর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। উদহারণ দিয়েই বলতে পারি- ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’এই সুন্দরের উপমা অনেকেই অনেকভাবে টেনেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম তা করেননি। ‘তুমি’শব্দটা দিয়ে সরাসরি বুঝিয়ে দিয়েছেন কার উদ্দেশে তিনি কথাগুলো বলছেন। এটাই হচ্ছে নজরুলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন : আর কি কি পার্থক্য খুঁজে পান?
ফিরোজা বেগম : অন্যসব কবির মতো, কবি নজরুলও মানুষ ছিলেন। সবারই ভালোবাসার পাত্রী রয়েছে। নজরুলের ভালোবাসার পাত্রীও ছিল। নেহায়েত কম নয়। তবে অনেকের কাছে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ভালোবাসার সাধ তার মেটেনি। তিনি যেভাবে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছেন তা কারও মধ্য থেকে পাননি। সেই না পাওয়া ভালোবাসা তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে। একটা অতৃপ্তি সব সময়ই ছিল তার। যে সম্মান তিনি চেয়েছিলেন, তা তাকে দেয়া হয়নি। সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। রুচিহীন মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দিতে পারেননি। যার তীব্র প্রতিক্রিয়া তার বহু কবিতায় আছে। একটু খোঁজ-খবর নিলে তা বের করা যাবে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেললেন। যে বয়সে সাধারণ মানুষ পরিপূর্ণ হন, ভাব-গাম্ভীর্য, দক্ষতা এবং সৃষ্টিশীলতায় সমৃদ্ধ হন, সে বয়সেই তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এটা আমাকে পীড়া দেয়। এ কথা মনে পড়লে এখনও আমার চোখে পানি চলে আসে। এই অনুভূতি অন্য কারো মধ্যে নেই। তার গানের জন্য আমি আমার সঙ্গীত জীবন বলতে গেলে উৎসর্গ করে দিয়েছি। যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছেন এবং যারা তার গান গেয়ে ধন্য হয়েছেন, তারাও আমার মতো হতে পারতেন। আমি তো তাকে ঠিকমত পেলামই না। তাহলে হয়তো আমার জন্যও তিনি গান লিখতেন।
প্রশ্ন : নজরুল সঙ্গীত চর্চার একাল-সেকাল সর্ম্পকে কিছু বলুন?
ফিরোজা বেগম : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি এখানে ছিলাম এবং তখন নজরুলসঙ্গীত সবচেয়ে বেশি আমি গাইতাম। তখন আমার সুনাম হলেও সুধী সমাজের স্বীকৃতি ছিল না। আর তখন ‘নজরুলসঙ্গীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো না। তখন নজরুলসঙ্গীতকে বলা হতো আধুনিক গান-রচনা করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রেকর্ডের মাধ্যমে ‘নজরুলসঙ্গীত’ শব্দটি আমিই প্রথম প্রবর্তন করি। বাংলাদেশে নজরুলসঙ্গীতের চর্চা বেড়েছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হচ্ছে না। যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সেহেতু আরও অনেক বেশি চর্চা হওয়া উচিত। তবে আমি মনে করি এখন নজরুলসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে সমস্যা ততটা নেই, যতটা ঘাটতি আছে সেটা পৃষ্ঠপোষকতায়। একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই ভালো ভালো শিল্পী উঠে আসবে। বর্তমান সময়ে বেশ কয়েকজন ভালো শিল্পী রয়েছেন। তাদের কণ্ঠে নজরুলসঙ্গীত সবার ভালো লাগার কথা। কারণ তারা পরিশ্রম করে নিজেদের তৈরি করেছেন। কিন্ত আমি আবারও বলছি সেভাবে কারো কোনো ক্যাসেট বা রেকর্ড বের হচ্ছে না। আগামী দিনে যারা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী হতে চাইবেন, তাদের বুঝতে হবে নজরুলসঙ্গীত অন্য গানের মতো নয়। লোকে অন্য গানের যতই গুণগান করুক না কেন, নজরুলসঙ্গীত গাওয়া খুব কঠিন। তারচেয়ে কঠিন নজরুলসঙ্গীত পরিবেশন করে মানুষকে মুগ্ধ করা।
প্রশ্ন : নজরুলসঙ্গীতের বাণী এবং সুর বিকৃতি রোধে আপনার পরামর্শ কী?
ফিরোজা বেগম : রবীন্দ্রনাথের একাধিক গানের যেমন একাধিক সুর আছে, তেমনি কাজী নজরুল ইসলামের গানেরও কবির নিজের এবং অন্যের করা সুর আছে। কবির নিজের এবং অন্যের করা সুরের মধ্যে কিছুটা মিশ্রণ ঘটে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্যের করা সুরটি সফল হয়েছে, নিজেরটা হয়নি। আবার কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে নিজেরটা সফল হয়েছে, অন্যেরটা পেছনে পড়ে আছে। এগুলো খারাপ কিছু নয়। তাছাড়া কবি তো নিজেই একাধিক সুর করেছেন। আর একটি বড় বিষয় হচ্ছে, কবির নিজের করা স্বরলিপির সঙ্গে তার পরিচালনায় রেকর্ডের অনেক ক্ষেত্রে মিল নেই। অর্থাৎ গায়ক-গায়িকারা নিজের মতো করে কিছু পরিবর্তন করেছেন। আবার কবি নিজেও রিহার্সেলের সময় বারবার পরিবর্তন করিয়েছেন। তার হাতের লেখা বাণী আমার কাছে আছে। এক্ষেত্রে ‘বাণী ও সুরের মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়া ছিলে…’ গানটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু গানটি রেকর্ড করার সময় সুরটা সুন্দর করার জন্য ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে তুলিয়া ধর…’ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এটা পরিবর্তন করা হয়। এখন আমরা যদি মূল লেখাটা পাই, তাহলে তো মহা ধন্দে পড়ে যাবো। তার লেখা ‘বাণী ও সুরের…’ আর রেকর্ড হলো ‘সুরে ও বাণীর…’ এরকম অনেক আছে। এই ছোটখাটো পরিবর্তন এমন কোনো গর্হিত ব্যাপার নয় যে, একেবারে অর্থটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। যারা বলেন, রেকর্ডের মতো করেই গাইতে হবে; আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এখন আমাদের এমন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি প্রয়োজন, যিনি রেকর্ড শুনে সঠিকটি শিখিয়ে দেবেন। আগে-পাছে কী ভুল ছিল-এটা সংশোধনের দায়িত্ব তার ওপরই পড়ে।
প্রশ্ন : এই জলমগ্ন সন্ধ্যায় সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
ফিরোজা বেগম : দেখো বাইরে এখনও বৃষ্টি ঝরছে। তুমি একটু বসে যাও। এর ফাঁকে তোমাকে আর একটা কথা বলি। নজরুল সঙ্গীত নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। সেটা নজরুল ইনস্টিটিউটও জানে। কিন্তু তারা কিছুই করে না। একবার স্বরলিপি প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। তারা আমাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য আরেকজনকে চেয়ারম্যান করেছিল। তখনই ভালো উদ্যোগ মাঠে মারা যায়। যিনি স্বরলিপি করেছেন, তিনিই যে গায়কী দিতে পারবেন-এমন ধারণা তো ঠিক নয়। ওখানে আমি নেই, তবুও কাজ হচ্ছে-এটা কী দেশের সবাই মেনে নিয়েছেন? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বুঝতে হবে কোন গুণে কে গুণাণ্বিত বা গুণাণ্বিতা। মুখ চিনে নিয়োগ দিলে তো হবে না।
সারাবাংলা/পিএম