‘বাংলাদেশের সিনেমা থেকে থিয়েটার অনেক এগিয়ে’
২৮ জুলাই ২০১৮ ১৮:৫০
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
অনিন্দ্য ব্যানার্জী সু–অভিনেতা। অভিনয়ে তিনি দ্যুতি ছড়াচ্ছেন অনেকদিন। টালিগঞ্জের সিনেমায় অভিনয় করছেন, অভিনয় করেছেন বলিউডেও। তার অভিনয় সমাদৃত হয়েছে সকল শ্রেণীপেশার মানুষের কাছে। অনিন্দ্য অভিনয় শুরু করেন থিয়েটারের মঞ্চে। এই মাধ্যমটিতে তিরিশ বছর অভিনয় করেছেন তিনি। এরপর শুরু হয় তার চলচ্চিত্র জীবন। ক্যামেরার সামনেও পনেরো বছর ধরে অভিনয় করছেন। নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্রও।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন অনিন্দ্য। অংশ নিয়েছেন একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালায়। সেই কর্মশালার ছোট্ট বিরতিতে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বলেন তার থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জীবনের নানা গল্প।
- মঞ্চ নাটক নিয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ২০১৮তে দ্বিতীয়বার এলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি কর্মশালায় অংশ নিতে। তখনকার বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে কোন পার্থক্য চোখে পড়েছে আপনার?
পার্থক্য তো অবশ্যই রয়েছে। নব্বই দশকের সেই সময়টায় ঢাকায় এতো যানবাহন ছিলো না। লোকসংখ্যা কম ছিলো। প্রচুর রিকশা ছিলো। তবে সব থেকে বড় পার্থক্যটা হলো তখন এতো বন্ধুবান্ধব ছিলো না। এখন অনেক বন্ধু হয়েছে। সত্য বলতে কি বাংলাদেশ শব্দটি আমার ভিতরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কলকাতা থেকে আলাদা মনে হয় না কখনও।
- এর আগে যেহেতু মঞ্চ নাটক নিয়ে এসেছিলেন সেহেতু ধরে নিতে পারি বাংলাদেশের থিয়েটার সংস্কৃতি নিয়ে আপনার ধারণা আছে। বাংলাদেশের থিয়েটার সংস্কৃতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
খুব যে বেশি ধারণা আছে সেটা বলবো না। বাংলাদেশ বরাবরই থিয়েটারের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের সিনেমা থেকে থিয়েটার অনেক বেশি এগিয়ে। এখানকার থিয়েটারকর্মীরাও অনেক বেশি শ্রম দেয় থিয়েটারে। থিয়েটার এদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে। আমার কাছে এটা খুব অবাক লাগে।
- দুই বাংলার থিয়েটার নিয়ে কি বলবেন?
পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটার বলতে যা বোঝায় এখানেও থিয়েটার বলতে সেটা বোঝায়। নাটকের বিষয়বস্তু ভাগ হয় দেশ-কাল-পাত্র ভেদে। পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু টেলিভিশনের লোকেরা এখন বেশি থিয়েটারে চলে এসেছে ব্যবসার জন্য। থিয়েটার কিন্তু মানুষকে তারকা বানাতে পারে না। আমার কথা যদি বলি, আমাকে মানুষ যতোটা চেনে সেটা টেলিভিশনের কারণে। থিয়েটার আমাকে মানুষের কাছে চেনাতে পারেনি। কলকাতার থিয়েটারে টেলিভিশন তারকাদের নেয়া হয় যেনো তাদের জন্য হলেও দর্শক হয়।
থিয়েটার যদি তার নিজের মেরুদন্ডের ওপর না থাকে, অন্যের নাম যশ-খ্যাতির ওপর নির্ভর করতে হয় তাহলে সেটা দূর্ভাগ্য। এই চর্চাটা কিন্তু একটা সময় ছিলো না। ইদানিং চর্চা হচ্ছে। আমি জানি না বাংলাদেশে একই অবস্থা কিনা! আমি চাইবো বাংলাদেশে যেনো এমনটা না হয়।
- থিয়েটারে অভিনয়, পর্দা নাকি পরিচালনা, কোন জায়গাটা বেশি চ্যালেঞ্জের?
আমি কাজটাকে কিভাবে দেখছি সেটার ওপর নির্ভর করে। যদি চ্যালেঞ্জিং মনে করি তাহলে সেটা চ্যালেঞ্জের। আমি ত্রিশ বছর থিয়েটার করেছি। এখন থিয়েটার আমার কাছে জল-ভাতের মতো। পনেরো বছর ধরে সিনেমায় অভিনয় করছি সেটাও আামার কাছে কঠিন কিছু নয়। পরিচালনাও ঠিক তেমন। সিরিয়ালে যখন অভিনয় করি তখন চরিত্রে এমন তাত্ত্বিক কিছু থাকে না যা খুব চ্যালেঞ্জের মনে হবে। সিরিয়াল তো মানুষকে বিনোদন দেয়ার জন্য। তবে আমি যে ধরনের সিনেমা করি বা করতে চাই সেগুলো দেখার জন্য বাংলার দর্শক তৈরী নয়। সেজন্য আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালকেই ভরসা করতে হয়।
- অভিনেতা নাকি পরিচালক, কোন পরিচয় উপভোগ করেন?
(চায়ে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে) এটা খুব কঠিন প্রশ্ন আমার জন্য। এটাকে এড়িয়ে যেতে চাই। মন্তব্য করতে চাই না। আমি আমার দুই সত্তাকে ভাগ করতে চাই না। তাছাড়া নিজের কাছেই বিষয়টি এখনো স্পষ্ট না।
- এবার টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানতে চাই। আমরা যতোটা জানি কলকাতায় বাণিজ্যিক ছবিগুলোর থেকে আর্টফিল্ম ভলো চলছে। এর কারণ কি বলে মনে হয়?
বাণিজ্যিক ছবি চলছে না এটা পুরোপুরি সত্য নয়। এ ধরনের ছবি দেখার কিছু দর্শক আছে যারা নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহে যায়। তবে এটা বলতে পারি, কর্মাশিয়াল ছবি দেখার দর্শকের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে এই যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে এর সুযোগ লুফে নিচ্ছেন বিকল্প ধারার নির্মাতারা। সবাই কেবল মাত্র কমার্শিয়াল ছবি দেখার জন্য জন্মায়নি। কারও কারও অন্যরকম সিনেমার ক্ষুধা আছে। এই ক্ষুধা বুঝতে পেরে নির্মাতারা বিকল্পধারার ছবি নির্মাণ করছেন। এটা বেশ ভালো। যদিও আমি কমার্শিয়াল ছবি করি, তবু চাইবো এই ধরনের ছবির সংখ্যা আরও বাড়ুক। অভিনেতা হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাহায্য করতে পারলে খুশি হবো।
- কমার্শিয়াল ছবি এবং আর্টফিল্ম, অনেকে চলচ্চিত্রকে এরকম আলাদা মোড়কে রাখতে নারাজ। আবার অনেকে চলচ্চিত্রের এমন বিভাজনের পক্ষে। আপানার চলচ্চিত্রের এমন বিভাজনে বিশ্বাসি নাকি বিভাজন করতে চান না?
আমি একই মোড়কে রাখতে চাই না। সিনেমার ধারা আছে। ধারাগুলো বদলায়। নানান ধরনের ধারার মধ্যে সিনেমা আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এই বদলের কারণে সিনেমার ভাগ তৈরী হয়েছে। এই ভাগ অস্বীকার করার উপায় নেই। সব সিনেমা একই ছাঁচে ফেলতে হবে এমন কথা নেই। বিষয়বন্তুর আলোকে ভাগ হতেই পারে।
- কলকাতার আর্ট ফিল্মগুলো অনেক বেশি যৌনতানির্ভর। এ ধরনের ছবিতে যৌনতা কতোটা প্রাসঙ্গিক?
যদি শৈল্পিকভাবে যৌনতা তুলে ধরা হয় তাহলে সেটা প্রাসঙ্গিক। আমি কয়েকটি ছবি দেখেছি যেখানে একদম অপ্রাসঙ্গিকভাবে যৌনদৃশ্য সংযোজন করা হয়েছে। গল্প যদি যৌনতা ডিমান্ড করে তাহলে সমস্যা নেই। এ ধরনের ছবিরও দরকার আছে।
- তাহলে কি বলবো পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের রুচি বদলেছে? তারা আরও বেশি পরিণত হয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের কাছে যৌনতা খুব একটা নতুন কিছু না। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ছবি মুক্তি পায়। তবে যৌনতাকে সামলানো খুব কঠিন। ভারতবর্ষে রাজ কাপুর ছাড়া কাউকে দেখিনি। সত্যজিৎ রায় যৌনতাকে সামলেছেন ইন্দ্রিয়গতভাবে। ‘সেক্সুয়ালিটি’ আর ‘সেনচুয়ালিটি’র মধ্যে ফারাক আছে। যেটা অন্যান্য বড় বড় নির্মাতারা তফাৎটাকে পরিস্কার করে দিয়ে গেছেন। কলকাতার মানুষ সিনেমায় যৌনতা দেখে অভ্যস্ত।
- আমরা জানি টালিগঞ্জে বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে রিমেক ছবিতে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যদিও সেখানকার অনেক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা রিমেক ছবিকে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির জন্য অভিশাপ মনে করছেন। আপনার মতামত জানতে চাই এ বিষয়ে।
ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রাখতে রিমেক ছবির দরকার আছে। বাঁচাতে হবে সিনেমাকে। ‘শিব আর শব’-বলে একটা কথা আছে। যদি তোমার যোগ্যতা থাকে তাহলে তুমি ‘শিব’, যোগ্যতা যেদিন চলে যাবে সেদিন তুমি ‘শব’ হয়ে যাবে। ইন্ডাস্ট্রি মরে যাওয়ার আগে তাকে তো ভেন্টিলেশনে নিতে হবে। আমি মনে করি টলিউড ভেন্টিলেশনে আছে। সব জায়গায়ও আমি বলি যে, বাংলা সিনেমা ‘শব’-এ পরিণত হয়েছে। বাংলা সিনেমায় যে ঐতিহ্য ছিলো সেটা এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা দেখলেই বোঝা যাবে।
- নির্মাণ হোক বা অভিনয়–আপনার দর্শণ সম্পর্কে জানতে চাই।
প্রতিষ্ঠিত মতবাদের বিপরীত মতবাদকে দাঁড় করানো। যুক্তি দিয়ে শিল্প হয় না। পৃথিবীতে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা ছাড়া আমার কোন কাজ নেই। মানব জাতির ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চাই।
- বাংলাদেশের সিনেমা সম্পর্কে ধারনা আছে কি?
আমি তেমন একটা ছবি দেখি না। তবে যে ছবিটা দেখি সেটা অনেকবার দেখি। জীবনের সময় খুব কম। যে কোন ধরনের ছবি দেখে সময় নষ্ট করতে চাইনা। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি সম্পর্কে টুকটাক খোঁজ রাখি। শঙ্খচিল দেখেছি। তবে একদম বাংলাদেশের ভিতরকার ছবি সম্পর্কে জানিনা। তবে জানার আগ্রহ আছে।
- বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ আছে?
অবশ্যই। আগে থেকেই বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা আছে। এবার আমার বন্ধু বাংলাদেশের লেখকদের বই কিনে দিলো। শেখ মুজিবর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনি বইটি কিনে দিয়েছে। এখনও পড়া হয়নি। দেশে ফিরে পড়বো। জুনায়েদ স্যার তার লেখা এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মের তিনটি বই দিয়েছেন। এবার শুরু হবে বাংলাদেশকে আমার আবিস্কার করার মিশন।
ছবি: আব্দুল্লাহ আল মামুন এরিন
সারাবাংলা/আরএসও/এএসজি/টিএস