স্মরণে তারেক-মিশুক
১৩ আগস্ট ২০১৮ ১৫:১৮
এন্টারটেইনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
তাকে বলা হয় সিনেমার ফেরিওয়ালা। সিনেমা ফেরি করে বেড়াতেন ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সিনেমাকে করতে চেয়েছিলেন সার্বজনীন। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ।
তারেক মাসুদ তার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক বিষয়বস্তু দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরতেন। বিষয়বস্তু এবং নির্মাণশৈলীর কারণে তারেক মাসুদকে পরিচিত করেছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও। তিনি কখনও গতানুগতিক চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশ্বাসী ছিলেন না। সবসময় চেয়েছেন প্রথা ভেঙে নতুন এক ধারার প্রচলন করতে। এই নতুনধারা যে মহাজাগতিক কিছু তা নয়। তারা সবগুলো চলচ্চিত্রে ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া। সেইসব নান্দনিক চলচ্চিত্রগুলো ছিল পুরোপুরি বক্তব্যধর্মী। যদিও কখনও কখনও সেইসব বক্তব্যের কারণে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে বিতর্কের। তাতেও দমে যাননি তিনি। কোন বিতর্কই তাকে তার লক্ষ্য থেকে থামাতে পারেনি।
আরও পড়ুন : তারেক মাসুদ, রানওয়ে ও রুহুলের গল্প [ভিডিও স্টোরি]
কিন্তু কোনও বিতর্ক তাকে থামাতে না পারলেও তাকে থামিয়ে দিয়েছে ঘাতক বাস। ২০১১ সালের আজকের দিনে (১৩ আগস্ট) মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জুকা নামের একটি জায়গায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তাকে বহনকারী মাইক্রোবাস এবং একটি যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। শুধু তিনি নয় তার ক্যামেরার কবি প্রখ্যাত ভিডিওগ্রাফার মিশুক মুনীরও একই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তারেক মাসুদের সবগুলো চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রহণ করেছেন মিশুক মুনীর।
তারেক মাসুদ বাল্যকালের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে মাদ্রাসায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি সাধারণ শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেন এবং একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছেন। তারেক মাসুদ ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫) এবং ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে, মাটির ময়নার জন্য তিনি অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড অন্যতম।
তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আদম সুরত’, ‘নরসুন্দর’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’, ‘অন্তর্যাত্রা’ ‘রানওয়ে’।
আরও পড়ুন : শোক দিবসের নাটক ‘তখন পঁচাত্তর’
প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘মাটির ময়না’ অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তারেক মাসুদ বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কাজ করছিলেন তার নতুন চলচিত্র ‘কাগজের ফুল’ নিয়ে। ডেস্ক ওয়ার্ক শেষ করার পর সে বছরই শুরু হওয়ার কথা ছিল এর শুটিং।
অন্যদিকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পাঠ চুকিয়ে ওই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। চিত্রগ্রাহক ও সম্প্রচার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মিশুক মুনীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসি’র হয়ে কাজ করেন।
সোমবার (১৩ আগস্ট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল-সংলগ্ন সড়কদ্বীপে তারেক-মিশুক স্মৃতিস্থাপনা প্রাঙ্গনে তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০১৮ এবং তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণ আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচি শুরু হবে বিকাল ৫টায়।
এ বছর তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতার বক্তা চলচ্চিত্রকার আকরাম খান। বক্তৃতার বিষয় ‘দেশভাগের চলচ্চিত্র: পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ’। তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের পর ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালা’ এর সমাপনী ও কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
আরও পড়ুন : আগস্টে লুমিনের গান ‘বঙ্গবন্ধু’
সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হবে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণ আলোচনা। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ এবং তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী।
সন্ধ্যা ৭টায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ সড়কে-মহাসড়কে নিহত সকল মানুষের স্মরণে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বোলনের মাধ্যমে আয়োজন সমাপ্ত হবে।
সারাবাংলা/আরএসও/পিএ/পিএম