Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লোকার্নো থেকে পাওয়া


১৫ আগস্ট ২০১৮ ১৮:৪৯

মেহেদী হাসান

প্রতীক আকবর

নির্মাতা মেহেদী হাসান ও তার বিড়াল- এই দুইয়ের সঙ্গে দেখা হলো রোববার (১২ আগস্ট) সকালে। সিনেমা নিয়ে কথা হবে- এটাই একটা আনন্দ মেহেদীর কাছে- এ জন্য অভ্যাস ভেঙেছেন। সকালে ওঠার কষ্ট সয়ে নয়টাতেই প্রস্তুত ছিলেন রাজধানীর কল্যানপুরে তার বাসায়।

সেদিনই মেহেদীর সঙ্গে প্রথম দেখা, তার বিড়ালটার সঙ্গেও। মেহেদী চা বানাতে গেলে বিড়ালটা তাই গন্ধ শুকে নিল বাসায় আগত অতিথির। হয়ত গন্ধটা মস্তিস্কে সেভ করে নিজ স্থানে চলে গেল বিড়াল। আর দুই হাতে দুই মগ চা নিয়ে সিনেমার আড্ডায় বসলেন নির্মাতা মেহেদী হাসান।

মূল কথায় যাবার আগে মেহেদী হাসানকে একটু পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেড়িয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন মেহেদী। কাজ করেছেন সংবাদপত্রেও। তবে চলচ্চিত্রের স্বপ্ন তাকে অনেক কিছু থেকেই সরে আসতে আগ্রহ জুগিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে সিনেমার সঙ্গে লেগে থাকতে। আর এই স্বপ্ন তাকে কোথায় নিয়ে গেল দেখুন। সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে মেহেদী ছিনিয়ে আনলো পুরস্কার।

হ্যাঁ, ছিনিয়েই বলতে হবে। কারণ লোকার্নো ওপেন ডোর্স হাবে এবার মেহেদীসহ অংশ নেন ৮ জন প্রতিযোগী। তাদের মধ্যে অন্যতম দুজন হলেন ‘সিদ্দীক বার্মেক’ ও ‘সাবিহা সুমার’। আফগানিস্তানের পরিচালক সিদ্দীক বার্মেক, ‘ওসামা’ সিনেমার জন্য সুপরিচিত তিনি। আর ‘খামোশ পানি’ সিনেমার জন্য খ্যাত পাকিস্তানি সাবিহা সুমার। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রথম স্থানটি অর্জন করতে হয়েছে মেহেদীকে। পেয়েছেন সিএনসি পুরস্কার। এটি একটি ফরাসি অনুদান। এখান থেকে ৮ হাজার পাউন্ড পাবেন তিনি, সিনেমা বানানোর জন্য। লোকার্নো ওপেন ডোর্স হাবে জমা দেয়া মেহেদীর সিনেমার নাম ‘স্যান্ড সিটি’।

বিজ্ঞাপন

‘স্যান্ড সিটি’ সিনেমাটি কেমন? এর উত্তরে পাবার আগে মেহেদীর সঙ্গে কথা হলো তার সিনেমা দর্শন নিয়ে। ‘আমি এখন পর্যন্ত চারটি সিনেমা বানিয়েছি। যার প্রতিটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের। এসব সিনেমা আমি আমার মেজাজে আমার ঢংয়ে নির্মাণ করেছি। সিনেমায় আমি আমার চারপাশকেই যুক্ত করতে চাই। যেমন আমার একটি সিনেমা ‘‘আই অ্যাম টাইম’’। সিনেমায় আমার সঙ্গে বড় হওয়া সময়কে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি। বোঝাতে চেয়েছি সময় অন্য কিছু নয়। আমিই সময়। আমার আরেকটি সিনেমা ‘‘ডেথ অব আ রিডার’’ বা ‘‘পাঠকের মৃত্যু’’। একটা সময় খেয়াল করলাম আমি আর পড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। যেমন কম্পিউটারে অনেকগুলো ট্যাব খুলে রাখি আমরা। সব কিছু কিন্তু ভালো করে খেয়াল করা হয়না। এমন একটা ভাবনা থেকে ছবিটি বানানো।’ বললেন মেহেদী।

তাহলে ‘স্যান্ড সিটি’ সিনেমাটা কেমন হবে? ‘স্যান্ড সিটিকে বাংলায় বলা যায় বালুর শহর। এখানে আমাদের সুখে থাকা বা খুশি থাকার বিষয়টাকে বালুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বালু যেমন হাতে আটকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বা বালু কখনও স্টেবল না, সেরকম খুশিটাও। ‘‘স্যান্ড সিটি’’ আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। ২০১৯ সালের শেষে সিনেমার শুটিং শুরু করব।’ জানালেন মেহেদী।

এমন একটি সিনেমার প্লট নিয়ে তিনি অংশ নিয়েছিলেন লোকার্নো ওপেন ডোর্স হাবে। মাত্র ১৫ মিনিটে বিচারকদের বোঝাতে হয়েছে সিনেমার তাৎপর্য। আর সেখানেই সেরা হয়েছেন দেশের মেহেদী।

কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হওয়ার চেয়ে নাকি অংশগ্রহণটাই বড় বিষয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সিএনসি পুরস্কার বাদ দিলে মেহেদী আর কী শিক্ষা পেয়েছেন লোকার্নোর মতো আসর থেকে? যা কি না দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে?

বিজ্ঞাপন

‘দেখেন, আমার অর্জিত শিক্ষা হয়ত এক দিনে বা কয়েক দিনে বোঝা যাবে না। এটা একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমি আমার জায়গা থেকে অনেককেই দেখিয়েছি কিভাবে সিনেমা প্রজেক্ট পিচ করতে প্রস্তুতি নিতে হয়। আমাদের মাঝে মধ্যেই এরকম পাঠচক্র হয় যেখানে আমরা এই অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি। আমার অর্জিত জ্ঞান যখন আরও কয়েকজনকে আলোকিত করবে তখন সেটার গুরুত্ব পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় এর জন্য সময় দিতে হবে।’

এই আলোচনার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন মেহেদী। সাউথ এশিয়ান অঞ্চল থেকে যেসব সিনেমা লোকার্নো বা ইউরোপের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যায়, সেসব সিনেমার অধিকাংশের নাকি সাউন্ড ভালো হয় না। অনেকের সঙ্গে কথা বলে মেহেদী এর প্রমাণ পেয়েছেন।

ফেস্টিভ্যালে মেহেদীর এক দিনে প্রায় ১৪টা করে মিটিং করতে হয়েছে। ‘স্যান্ড সিটি’ সিনেমার জন্যই এই মিটিং করতে হয়েছে তার। প্রযোজক বা সিনেমা ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পরিচালক, গল্পকারদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন মেহেদী। আর সেখান থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড সিনেমার গল্প ও বিষয়বস্তু। যুদ্ধ, সামাজিক ইস্যু, সম্পর্কের ক্রাইসিসের বিষয়গুলো এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবখানে।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে অংশ নেয়া সিনেমাগুলোর বিষয়ও অনেকটা একইরকম। অর্থাৎ শক্ত ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েই অনেকে সিনেমা নির্মাণ করছেন, কিন্তু দেশের বাইরে সমাদৃত হলেও, দেশের দর্শকরা তা গ্রহণ করছেন না। গতানুগতিক এই চিত্রর গতানুগতিক বিশ্লেষন এলো মেহেদীর কাছ থেকে।

‘ঐ যে বললাম এর সুফল আসলে কয়েক বছরে পাওয়া যাবে না। মার্কেজ একজন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি কি জনপ্রিয় না? তাই বলে কি সবাই তার পাঠক। তেমন সব সিনেমা হয়ত সবার জন্য না। ঢাকা শহরে বইয়ের দোকান কয়টা পাবেন? কিন্তু অনেক দেশেই কিন্তু প্রচুর বইয়ের দোকান। টেস্ট অ্যান্ড প্রেফারেন্সের একটা বিষয় থাকে। এদেশের দর্শকদেরও চাহিদাও নিশ্চয়ই পরিবর্তন হচ্ছে, হবে। অনেক ধরনের সিনেমা হওয়ার পক্ষে আমি। তাহলে সিনেমা দেখার প্রবণতা ও ইচ্ছা বাড়বে।’

তবে সিনেমা নির্মাণের পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে এখনই এত ভাবছেন না মেহেদী। এখন তিনি পুরোটা সময় ব্যয় করবেন ‘স্যান্ড সিটি’ সিনেমার চিত্রনাট্যের কাজে। অক্টোবর ও নভেম্বরে জুরিখে থাকবেন মেহেদী। লোকার্নো থেকে পাওয়া বিশেষ একটি সুবিধা এটি। জুরিখে থেকে সিনেমার চিত্রনাট্যসহ বিভিন্ন কাজ করবেন এই নবীন নির্মাতা। ‘স্যান্ড সিটি’ সিনেমার বাংলাদেশী প্রযোজক খনা টকিজ।

চা খাওয়া কিন্তু অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। প্রশ্ন উত্তর পর্ব কেমন থেমে থেমে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল অনেক কথা বলে ফেলেছেন মেহেদী। তাই এবার স্মৃতি থেকে ধার নেয়া শুরু হলো। ২০১৬ সাল থেকে সাউথ এশিয়া ছিল লোকার্নো ওপেন ডোর্স-এর ফোকাসে। আর তখন থেকেই এর সঙ্গে লেগে ছিলেন মেহেদী হাসান। শেষ পর্যন্ত ২০১৮-তে এসে তিনি সুযোগ পান সেখানে যাবার। তিনি একাই নন, দেশের আরিফুর রহমান, অং রাখাইন, মোহাম্মদ সাদ এবছর বিভিন্ন বিভাগে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর আগে দেশের কামার আহমেদ সাইমন, রুবাইয়াত হোসেনরা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন এই পথ। এদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার সুফল নিশ্চয়ই দেখবে বাংলাদেশ, নিশ্চয়ই দেখবে দেশের চলচ্চিত্র জগৎ, সবার মতো এই প্রত্যাশা তাদের নিজেদেরও।

সারাবাংলা/পিএ

মেহেদী হাসান লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল স্যান্ড সিটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর