‘আমি বাঘের মতো, দুই কদম পেছালে বুঝতে হবে আরো জোরে লাফ দেব’
৩০ আগস্ট ২০১৮ ১৩:২৫
এন্টারটেইনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
বাংলা পপ-ধারার সঙ্গীতে জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন আসিফ আকবর। ১৯৯৭ সালে গানে অভিষেক তার। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় আসিফের প্রথম একক অ্যালবাম ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। এই একটি অ্যালবামই আসিফকে এনে দেয় আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘তুমিই সুখী হও’ দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তাকে আরও পোক্ত করেন তিনি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা গানে সক্রিয় এ গায়ক গেয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি গান। কেবল গানেই নয়, আসিফ আলোচিত তার ব্যক্তিজীবন নিয়েও। আর এ সবকিছু নিয়েই সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলা গানের জনপ্রিয় এই কন্ঠশিল্পী।
- আপনার গান প্রথম যেদিন শুনলো দেশের মানুষ, সেদিন যে শিশুর জন্ম হয়েছিলো তার বয়স এখন আঠারো পেরিয়েছে। অনেক দিন ধরে আপনি গানে আছেন। অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের বর্ণনায় শুনতে চাই সেই গল্প।
১৯৯৭ সালের অক্টোবরে স্বপরিবারে আমি ঢাকায় চলে আসি। তার আগে একবার ঢাকায় আসছিলাম আমার বন্ধু জুয়েলকে দেখতে। সে ভালো গিটার বাজায়। ওকে দেখে ভালো লেগে যায় আমার। তখন আমার এক বড় ভাই, পিন্টু ভাই বলে যে তোমার গানের গলা ভালো, শুনেছি কুমিল্লায় তুমি ভালো গান করছো। তোমার ভয়েসটা আসলে প্লেব্যাকের জন্য উপযোগী। তখন আমি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবো। আমাদের সংসারে একটা বাচ্চাও চলে এসেছে। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। পড়াশোনা শেষ করেই আমাকে জবে ঢুকতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি ওনাকে বললাম আমার হাতে তো সময় কম, যদি প্রতিষ্ঠা পাই তাহলে হয়তো আমার পক্ষে সময় দেয়া সম্ভব। নাহলে চা বাগানে আমার চাকরী হয়ে গেছে। অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার, ফিনলে গ্রুপ। তখন আম্মারও প্রেসার ছিলো। আমি আম্মাকে বলতাম, একটা বড় জাল ফেলছি সেটা ঘুচাতেও তো একটা সময় লাগে। বললাম, দুই বছরের মধ্যে যদি সাফল্য আসে তাহলে মিউজিকে থাকবো নাহলে ঢাকা ছেড়ে চলে আসবো। আল্লাহর রহমতে দুই বছরের মধ্যেই আমি সফলতা পাই। ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ গানটি মানুষ পছন্দ করে।
এর আগে আমি একটা মিক্স অ্যালবাম করেছিলাম। পরে ‘ও প্রিয়া’ আসার পর সেটা আমি বাজার থেকে উঠিয়ে দিয়েছি। আমি আমার ক্যারিয়ার সচেতনার জন্য ওই গানগুলো মুছে ফেলি। ‘ও প্রিয়া’ যখন হিট হলো তখন মনে হলো স্বাধীনতা পেলাম আমি। আর্থিক, মানসিক সব জায়গায় নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ আসলো। পরে আমার সেকন্ড অ্যালবাম ‘তুমিই সুখী হও’ থেকে ‘ও পাষাণী বলে দাও কেন ভালোবাসনি’ গানটাও হিট করে। এতে করে মিউজিকে আমার সফলতাটা পোক্ত হয়। প্রথম অ্যালবামে যদি স্বাধীনতা প্রাপ্তি হয় তাহলে সেকন্ড অ্যালবামে হয় রক্ষা। এরপর থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দুই হাজারের উপর গান গাইলাম সিনেমায়। আমার ঢাকার জীবনটা অনেক কষ্টের ছিলো। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সংগীতে আমার প্রথম লড়াই ছিলো হিন্দী গানের বিরুদ্ধে। মানে বাজারে যেন হিন্দী গান র্যান্ডম না চলতে পারে সেই চেষ্টা করেছি। এখনো করছি।
খেয়াল করে দেখবেন বাজারে হিন্দী গান এখন আর খুব একটা হিট হচ্ছে না। কারণ আমি চলে আসছি। আমরা চেষ্টা করছি। নিজেরাও লাভবান হচ্ছি, পাশাপাশি বাংলা গানকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করছি। যারা আমার সব গান শুনেন তারা বুঝতে পারবেন বৈচিত্রটা কোথায়। তার মধ্যে ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আট বছরের গ্যাপ ছিলো। সিনেমায় অশ্লীলতা, গানের রাইটসহ নানা কারণে এই সময়টায় আমি মিউট ছিলাম। সেক্ষেত্রে আমি বলবো, আজকে যে মানুষ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে আসছে, গানের রাইট চাচ্ছে, আমি মনে করি আমার আন্দোলনটা সফল। আমিও এটা থেকে লাভবান হচ্ছি। এই জার্নিতে ব্যাক্তি আসিফকে কখনোই পেশাদারিত্বের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি নাই। কখনো কাজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করি নাই। এই সংগীত জীবনে লক্ষ্যের প্রতি আমার দৃঢ়তা একটা বড় ভূমিকা রাখে। সেটাই এখন পর্যন্ত আমাকে টিকিয়ে রেখেছে।
- আপনি যে বয়সে সফলতার দেখা পেয়েছেন। সে বয়সে অনেক মানুষের বোধ-বুদ্ধিরই বিকাশ ঘটেনা। তো ওই সফলতার আলো নাকি সফল হবার আগের আগের সংগ্রাম, কোনটা আপনাকে এতো দূর নিয়ে এসেছে?
আমি আসলে বাস্তববাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি কাজের কোন বিকল্প নাই। আমার কাজ হচ্ছে গান গাওয়া। আমি নিজে কখনো গান লিখতে জানিনা, সুর করতে জানিনা, সেই অর্থে জ্ঞানী না। আমাকে মিউজিক ডিরেক্টর বা গীতিকারদের উপর ভরসা করতে হয়। আর আমার অবস্থানের পেছনে বিশাল একটা বাহিনী কাজ করে, গীতিকার, মিউজিক ডিরেক্টর, কম্পোজার। ওদের চেষ্টাটাই আমার বেসিক ভিত্তি। তাই আমি মনে করি যে অনেকের সঙ্গে কাজ করার ফলে আমার কাজের পরিধি অনেক বেশি। আমি বিশ্বাস করি মানুষের নিজস্ব শক্তির উপর মনোযোগ দেয়া উচিৎ।
- আপনার মনোযোগ তো পরে রাজনীতিতে চলে গেছে!
না রাজনীতিতে আমি আগে থেকেই। আমার পরিবারও রাজনৈতিক পরিবার। হয়তো তখন আমি ফোকাসে ছিলাম না… কিন্তু এখন আমি ফোকাসড। এটাই।
- আপনি রাজনীতিতেও আছেন। আপনার কি মনে হয়, রাজনীতির কারণে শিল্পী আসিফ কিছুটা পিছিয়ে?
না, পিছাইনি আমি। কখনোই পিছাইনি। আমি হচ্ছি বাঘের মতো, দুই কদম পিছিয়ে গেলে বুঝতে হবে আরো জোরে লাফ দেয়ার জন্য পিছিয়েছি। রাজনীতি করার কারণে যেটা সমস্যা হয়েছে, শেষ বারো বছর আমি ঢাকার বাইরে কনসার্টে আমি শো করতে পারি না। এমপি সাহেবরা অনুমতি দেন না, ডিসি-এসপি সাহেবরা অনুমতি দেননা। এটা তাদের হয়তো কোন টেকনিক্যাল কারণ থাকতে পারে, এতে করে আমি স্টেজ শো থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আর মানুষ আমাকে দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমার গানগুলো যদি আমি পথে প্রান্তরে গাইতে পারতাম তাহলে হয়তো মানুষ আরও শুনতো। কারণ অনেক শ্রোতা আছেন যারা ভার্চুয়াল জগতের বাইরে বাস করেন। স্টেজে গেলে দেখা যেত অনেক মানুষ আছে যারা আমার গান দেখেনি বা শোনেনি। তারা তখন আমার ব্যাপারে আগ্রহী হতো।
- তাহলে কী বিষয়টিকে বাঁধা হিসেবে দেখছেন?
এটা আসলে আমাদের রাজনীতির একটা প্রক্রিয়া। একজন আরেকজনকে দাবায় রাখে। এটা আসলে ব্যাড প্র্যাকটিস, বাজে চর্চা। এখন আমি এটার শিকার হয়ে গেছি। কিন্তু আমি যদি কখনো এটার মধ্য দিয়ে যাই আমি এই চর্চাটা করবো না। আমি মনে করি, সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে কোন বিভাজন থাকা উচিত না। যে যেই দল করুক কাজটা করতে হবে তার দেশের জন্য।
- রাজনৈতিক যে মতাদর্শ ও দলের প্রতি আপনি ঝুঁকে আছেন তার কী সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ আছে?
দেখেন, আমি জাতীয়তাবাদী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের ভেতরে বা আমার দেশে যে রিসোর্সেস আছে বা আমার যে জাতীয়তাবোধ আছে সেটার সঙ্গে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দলের জাতীয়তাবোধের সাথে মিলে যায়… শুধু মাত্র বিএনপি কিন্তু অন্য কিছু না। তাদের কি শরীক আছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি জিয়াউর রহমানের একজন অনুসারি। আমি কাব লিডার ছিলাম। সেই সময় খুব সম্ভবত ক্লাশ ফোরে থাকতে জিয়াউর রহমানকে আমি রিসিভ করেছিলাম। ওই বছরের মে মাসেই উনি মৃত্যুবরণ করেন। ওনাকে কাছ থেকে দেখেছি আমি দুইবার। তার আচরণ ভালো লাগতো। উনি কোন প্রটোকল মানতেন না, মন চাইলেই চলে যেতেন মানুষের কাছে। এই ব্যপারগুলো আমার ভালো লাগতো। ওনার দল বা আমার দল, ভুল-ভ্রান্তি সেটা মানুষ বিবেচনা করবে কিন্তু আমার তাকে ভালো লাগাতেই তার অনুসারি হওয়া।
- অন্যপ্রসঙ্গে যাই, একটা সময় আমাদের অ্যালবাম কেনার সংস্কৃতি ছিলো। সব উৎসবে আপনার বা আপনাদের গান বাজতো। এখন সেটা আর নাই। নতুন নতুন প্রযুক্তি এসে জায়গাটা নিয়ে গেছে। এটা কি মিস করেন আপনি? ওই সময়টাকে?
এটা সময়ের বিবর্তন। দুনিয়া এভাবেই চলে আসলে। একসময় ছিলো লং প্লে, সেটা কেনার ক্ষমতা ছিলো না অনেকের, ওরা দেখলো সিনেমা। তারপর আসলো ক্যাসেটের যুগ, আসলো সিডি-ভিসিডি। এখন আসছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। আমি প্রত্যেকটা পরিবর্তনের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করার চেষ্টা করি সবসময়। ভার্চুয়াল সময়ে প্রথম দিকে পিছিয়ে ছিলাম আমি। জানতাম না, বুঝতাম না। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি। তবে অ্যালবাম কেনাটা আমাদের সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময়টা আমি মিস করি। অ্যালবাম বের হওয়ার দিন ঈদ ঈদ মনে হতো। সবখানে গান বাজতো। কিন্তু পরিবর্তনটাও তো আমাকে মেনে নিতে হবে, খাপ খাওয়াতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিবর্তনটাকে ধরে রাখা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
- পরিবর্বতনের প্রসঙ্গ যখন আসলো, আপনি শুরুর দিকে যে গানগুলো করেছেন তার বেশিরভাগই ছিলো প্রেমবঞ্চিত বা সম্পর্কে প্রতারিত মানুষের জন্য গাওয়া গান। এই ধাঁচের গান থেকে আপনি আর বেরিয়ে আসেননি। মানে গানের বক্তব্যে পরিবর্তন আনেননি…
না, আমার গানের আসলে নির্দিষ্ট কোন ধরণ নেই। সবাই জানে যে আমি বিরহ কাতর গান গাই। সেটা আছে, আবার আমি যে রোমান্টিক গান সমপরিমান গেয়েছি সেটা সবাই বলে না। সাধারন দৃষ্টিভঙ্গি, কারণ মানুষের মন্তব্য বিভিন্ন রকম হবে। যেহেতু আমাদের গান পপুলার ক্যাটাগরিতে পড়ে, সে কারণে আমাদেরকে মানুষের কথা মাথায় রাখতে হয়। সেভাবেই গান করি। মন্তব্য বা মতামত হয়তো সেভাবে নেই না। শ্রোতাদের মানসিকতা কি হতে পারে সেটা সুরকার বা গীতিকার বোঝেন, যিনি গানটা ক্রিয়েট করেন তিনিও বোঝেন।
- বাংলাগানের বাজার তো আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আপনার কি মনে হয়…
এটা আর বাজার নাই, মহাবাজার। এখানে সব প্লাটফর্ম ওপেন ফর অল। আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে রেভিনিউ আর্নিংটা, এটা কোথায় থেকে আসছে। আমরা সবাই ইউটিউবের পেছনে দৌঁড়াচ্ছি, সেটা কিন্তু মুখ্য ব্যাপার না। সেটা একটা প্রচারের প্লাটফর্ম। সারা দুনিয়াতে দুইশ বাহাত্তরটা পোর্টাল আছে যেখানে নক করতে পারলে আপনি রেভিনিউ পাবেন। যখন আপনার পকেটে টাকা আসবে, সিস্টেমও তখন ডেভেলপ করবে। গান এমন একটা জিনিস যে এটা সবাই শোনে। মানুষ যাই করুক না কেন সে কিন্তু গান শুনবে ঠিকই। গান গানের জায়গায় থাকবে তবে প্লাটফর্মটা চিহ্নিত করতে হবে। এর জন্য কিছু লোক থাকা দরকার। কিন্তু এখানে সেটা হয় না। বাংলাদেশে সবাই ওয়ানম্যান আর্মি। সবাইকে যার যারটা বুঝে নিতে হয়। আপনি যেটা শুনতে চাচ্ছেন, যে হচ্ছেটা কি? হচ্ছে। পজিটিভলি হচ্ছে। এখন যারা গান করবে তারাই ভালো করবে।
- একটা সময় প্রচুর হিট গান আসতো। যেমন আসিফ বললেই কানে লাগে, ‘ও প্রিয়া’, তপু বললে ‘একটা গোপন কথা’ এরকম। দেখা যেত ওই গানটাই গায়কের সবচেয়ে বড় আইডেন্টিটি হয়ে গেছে। এখন তেমনটা হয় না। হিট গানও নেই খুব একটা…
এটা বলা যাবে না। কারণ একজন মানুষ তো আর ষোল কোটি মানুষের সার্ভিস দিতে পারবে না। একটা সময় ছিলো আমরা সিনেমাকেন্দ্রিক ছিলাম। সিনেমায় তখন বাঘা বাঘা পরিচালকরা কাজ করতেন। এখন আর ওইটা নাই। যারা কাজ করে তারা তাদের নিজেদের পছন্দ, সিন্ডিকেট নিয়ে কাজ করে। তারা মানুষকে কতটা সার্ভিস দিতে জানে সেটা তারাই জানে। এখানে আমরা অনেক মানুষ। কেউ হয়তো এক পার্সেন্ট মানুষের কাছে জনপ্রিয়, কেউ আবার পাঁচ পার্সেন্ট মানুষের কাছে জনপ্রিয়। এগুলো যোগ করলেই দেখবেন একশ হয়ে যাবে।
- একটা অভিযোগ শোনা যায়, বাংলা গান গ্লোবাল হতে পারছে না। আশেপাশের অনেক দেশের গানই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়ায়। আপনি যেহেতু গানের মানুষ আপনি হয়তো জানেন যে বাংলা গান ছড়িয়ে দিতে হলে কোথায় ভালো করতে হবে…
গ্লোবাল হতে হলে ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্ব করতে হবে। বাংলাভাষা অনেক কাঠখোট্টা একটা ভাষা। মাঝখানে শুনেছিলাম আমাদের ব্যান্ডগুলো বাংলা গানকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যাবে, নতুন একটা চ্যানেল আছে, তারাও নাকি বাংলা গানকে গ্লোবাল করবে। এগুলা কিছু হয় নাই, হবেও না। এগুলো বকাবাজ। আমি যেখানে কাজ করছি সেই জায়গাটা বুঝতে হবে। বাংলা মিউজিকে কাজ করছি, এই ভাষাটার কতটুকো গ্রহণযোগ্যতা আবেগের দিক থেকে আছে আর প্রফেশনের দিক থেকে আছে সেই পার্থক্যটা করতে হবে। গানের দিক থেকে বাংলা গানের আবেদন রবীন্দ্র, নজরুল বা মাইকেল বা ওই লেভেলেই আছে। এই দিকটায় বাংলাভাষা স্ট্রং আছে, আর বাকী সব দিক থেকে দুর্বল আমরা।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই- তেলেগুরা সংখ্যায় ছয় কোটি, আমরা বাঙালীরা সংখ্যায় ৩২ কোটি। তেলেগুরা ছয় কোটি নিয়ে কিভাবে দুনিয়া শাষন করছে? প্রেজেন্টেশন। আমরা নিজেদেরকে কোথাও প্রেজেন্ট করতে পারি না। তামিলরা পারছে। পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপার থাকে। আমাদের দেশে কিছু একটা করতে যান দেখবেন দুনিয়ার শর্ত। এই শর্ত, ওই শর্ত। এতো শর্ত মেনে গানবাজনা বা শিল্পকলা হয় না। এজন্য সরকারকেও উদার দৃষ্টি দিতে হবে। যারা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাদের উদার দৃষ্টি লাগে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত লাগবে। নাহলে আমরা যেমনটা করছি বাংলাদেশে আসলে এমনই হয়। তাদের মতো করে যেটা হচ্ছে সেটাই হচ্ছে। ওয়াসা-ডেসার মতো আরকি। রাস্তা খুড়তেছে, পানির লাইন লাগাচ্ছে। আবার টেলফোনের জন্য রাস্তা খুড়তেছে। কোনো সমন্বয় নাই। এই বাংলাদেশেটা এভাবে চলছে। অনিয়ম যেখানে নিয়ম আরকি।
- আপনি প্রেজেন্টেশনের কথা বলছেন। অনেক চ্যানেল কিন্তু বাংলা গানকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আমরা ‘গানবাংলা’ চ্যানেলের কথা বলতে পারি। তারা কোক স্টুডিও বা এমটিভি আনপ্লাগের মতো কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। তাদের এই উদ্যোগকে কেমন মনে হয়?
আমার মনে হয় না ভালো কিছু হচ্ছে এখানে। এখানে শুধু একজনের প্রচার হচ্ছে। আমাদের শিল্পীরা তো সব জায়গায় মিশে যায়, আমাদের শিল্পীরা হচ্ছে একটু হলুদের মত। অনেক ডাকসাইটে শিল্পী আমরা গার্ডিয়ান হিসেবে পেয়েছি, পরে দেখেছি বাটপারিতে গেছে। এগুলোই হয়। ছোট ছোট স্বার্থের জন্য আমরা অনেক বড় স্বার্থ জলাঞ্জলী দেই। এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখন দেখবেন যে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পী আওয়ামী লীগ করে, কয়েকদিন আগে দেখা গেছে অধিকাংশ শিল্পী বিএনপি করতেন। এটা হচ্ছে মানসিক স্লিপ। স্লিপ করে আরকি। একটা জায়গায় শক্ত থাকা, নিজের অবস্থানটা অটুট রাখা, কোন স্লিপ না করা, আমার ব্যক্তিত্বটা কতটা প্রবল সেটার জন্য হলেও অবস্থানটা খেয়াল রাখতে হবে। আমিও সেটা করতে পারতাম। সরকারি দলে জয়েন করলে আমার সব সমস্যা শেষ হয়ে যেত। আমি তা করবো না। স্বার্থের জন্য আদর্শ থেকে সরবো না।
ওদের (গানবাংলা চ্যানেল) প্রেজেন্টেশনে আমি স্যাটিসফাইড না। কারণ একটা বিখ্যাত গান, একটা অদ্ভুত কম্পোজিশনে তারা বাজাচ্ছে এবং ওদের গ্রহণযোগতা বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে নিচ্ছে? আগে তো আমার দেশকে স্যাটিসফাই করতে হবে। আমার দেশের একটা পপুলার চ্যানেল যেমন এটিএন, এটা পপুলার চ্যানেল। নিউজের মাধ্যমে এরা পপুলার হয়েছে। গানবাংলাকেও পপুলার হতে হবে। আর ‘উইন্ড অফ চেঞ্জ’ বলতে আমরা যেটা বুঝি, সংগীতের একটা পিচ থাকে, যেমন ধরেন বাচ্চু ভাইয়ের ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, এটা যদি আপনি মূল গান থেকে সরিয়ে ফেলেন তাহলে কিভাবে গানের মৌলিকত্ব প্রেজেন্ট করবেন সেটা আমি বুঝিনা। রিমেক হয় সেটা? ফিউশনও বলা যায় না। এটা আসলে মিউজিক রি-অ্যারেঞ্জ বা কনফিউশন বলা যায়। ফিউশন নতুন গান নিয়ে করুন বা একশ বছরের পুরনো গানের উপর করুন। এগুলো যা হচ্ছে, তা হচ্ছে কনফিউশন। আমার কাছে এগুলো ভাল্লাগে না।
- বাংলা গানকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার দায়িত্ব যদি আপনাকে দেয়া হয়?
না আমি পারবো না। এতবড় দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। আমি আমার কাজটা করে যাবো। এর মধ্যেই কিছু হলে ভালো। বিভিন্ন দেশে দেখি ওরা ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ গানটা গায়, আমি মনে করি ছোট হলেও এটা একটা বড় এচিভমেন্ট। ‘অপরাধি’ গানটা, কয়দিন আগে যেটা হিট হলো। বিদেশের মানুষ কিন্তু গানটা গাচ্ছে। এই ছেলেটা কিন্তু বাংলা গানকে একটা পজিশনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই ছেলেটাকে কিন্তু কেউ ক্রেডিট লোইন দিচ্ছে না। কেন, কারণ যে জাতির জাতীয় খেলা কাবাডি, সে জাতি আগাবে না। ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/টিএস/পিএম
সারাবাংলা’য় আড্ডা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন আসিফ আকবর। পুরো অনুষ্ঠানটি দেখতে ক্লিক করুন :
https://www.youtube.com/watch?v=LtQWltCxTCU&t=6s