রুপালি গিটারের প্রেমে ‘ঘরছাড়া’ একজন আইয়ুব বাচ্চু
১৮ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:০৬
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্কুলজীবনের দুরন্ত কৈশোরবেলায় সহপাঠী, বন্ধুদের অনেকের বইয়ের বাইরে আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ফুটবল কিংবা ক্রিকেট। কেউ কেউ সঙ্গীতেও মজেছিলেন। আবার ছাত্ররাজনীতির জটিল পথে পা বাড়িয়েছিলেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সবার থেকে আলাদা। ক্রিকেট, ফুটবল, রাজনীতি— কিছুই টানেনি তাকে। তার প্রেম ছিল গিটারকে ঘিরে, রুপালি গিটার। স্কুলজীবনেই গিটারের প্রেমে পড়া সেই ছেলেটি আইয়ুব বাচ্চু।
রক্ষণশীল পরিবারে গিটার প্রেম নিয়ে অনেক ঝক্কিই পোহাতে হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুকে। প্রচণ্ড ডানপিটে ছিলেন। প্রায় রাতেই ঘর থেকে পালিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বাসায় থাকলেও নিজের কক্ষে রাতভর টুং টাং গিটারের সুর তুলতেন। রক্ষণশীল বাবা সেই শব্দে প্রায়ই ঘর থেকে বেরও করে দিতেন। তখন ঠাঁই হতো রুপালি জগতের গুরু কিংবা সহপাঠীদের ঘরে।
কখনও কখনও স্কুলে এসে সহপাঠীদের বলতেন, ‘কাল রাতে চিটাগং ক্লাবে গুরু আজম খানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছি।’ কিংবা শোনাতেন ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে গিটার বাজানোর কথা। বন্ধুরা প্রায়ই ধরে নিতেন আইয়ুব বাচ্চু মিথ্যা বলছেন, তারা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু সেই পাত্তা না পাওয়া ছেলেটিই একদিন চট্টগ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠলেন গোটা দেশের মঞ্চ কাঁপানো ‘গিটার গুরু’।
চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই স্কুলে তার সহপাঠী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ, পরে যিনি হয়ে ওঠেন বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মৃত্যুর পর আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে সারাবাংলা’র কাছে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। আমার বাসা ছিল শহরের হেমসেন লেইনে। বাচ্চুর বাসা এনায়েত বাজারে। আমরা স্কুল ছুটির পর বিকেলে আউটার স্টেডিয়ামে বসতাম, আড্ডা দিতাম। মাঝে মাঝে ফুটবল খেলতাম। কিন্তু বাচ্চুকে দেখতাম, তার সব সাধনা গিটার নিয়েই। সব স্বপ্ন গিটার নিয়েই।‘
‘আজম খান কিংবা ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে গিটার বাজানোর কথা সে বলত, কিন্তু আমরা সেগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নিতাম না। কিন্তু পরে জেনেছি, আসলে সেগুলো সত্য ছিল। এমন না যে আজম খান কিংবা ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে তাকে গিটার বাজানোর জন্য কেউ নিয়ে যেত। চিটাগং ক্লাব কিংবা অন্য কোথাও তাদের প্রোগ্রাম হবে— শুনলেই সুযোগ খুঁজে চলে যেত সে। সেখানে গিটার বাদকদের কোনোভাবে ম্যানেজ করে বাজিয়ে নিত। আমরা যখন ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি, এগুলো তখনকার কথা। বন্ধু হিসেবে বলছি না, বাস্তবে আমাদের আইয়ুব বাচ্চু তো আজম খান কিংবা ফেরদৌস ওয়াহিদের সমকক্ষ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাদের চেয়েও জনপ্রিয় শিল্পীতে পরিণত হয়েছিল,’— বলেন তিনি।
আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের কথা বলতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিভিন্ন প্রোগ্রামে সারারাত গিটার বাজাত। ঘরে বসেও গিটার বাজাত। পড়ালেখায় খুব মনযোগী ছিল না। আবার রাত-বিরাতে গিটার বাজাতে গিয়ে অনেক ঝামেলাও করে বসত। স্বাভাবিকভাবেই তার বাবা সেটা পছন্দ করতেন না। ঘর থেকে বের করে দিতেন। রাতের পর রাত তাকে আমরা বন্ধুদের বাসায় অথবা যার কাছে গিটার শিখতেন, তাদের বাসায় কাটাতে হয়েছে।’
প্রথাগতভাবে অর্থাৎ স্বরলিপির মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চু গিটারের তালিম নেন চট্টগ্রামের প্রথম ব্যান্ডদল ‘স্পাইডারে’র প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকব ডায়াসের কাছে। বাসা থেকে যখন বাবা বের করে দিতেন, তখন বাচ্চুকে শহরের লালখান বাজার এলাকায় নিজের বাসায় আশ্রয় দিতেন জ্যাকব।
সত্তরোর্ধ জ্যাকব সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাদের ফ্যামিলি, বিশেষ করে তার বাবা খুবই কনজারভেটিভ ছিলেন। গিটার বাজানো কিংবা গানবাজনা একেবারেই পছন্দ করতেন না। এমনও হয়েছে, প্রোগ্রাম করে এসে রাতে বাসায় ঢুকতে পারেনি। চলে এসেছে আমার বাসায়। তখন তার বাবা-মামারা আমাকে টার্গেট করেন। মামাদের রিয়াজউদ্দিন বাজারে জুতার ব্যবসা ছিল। খুবই প্রভাবশালী ছিলেন তারা। অনেকবার এসে আমাকে বলে গেছেন, আমি যেন বাচ্চুকে গিটার না শেখাই।‘
‘স্বাধীনতার পর এনায়েত বাজারে আলী হোসেন নামে একজন সন্ত্রাসীর খুব নামডাক হয়েছিল। বাচ্চু একদিন তার রেকর্ডিং সেট নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়। আলী হোসেন বারবার ফেরত দেওয়ার কথা বললেও দেয়নি। এটা নিয়ে আলী হোসেন তার বাসায় বিচার দিয়েছিল। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিল, যে আঙুল দিয়ে বাচ্চু গিটার বাজায়, সেটা সে কেটে ফেলবে,’— বলতে থাকেন জ্যাকব।
‘এটা নিয়ে খুব ঝামেলা বেধে গেল। বাচ্চুর মা তাকে খুব সাপোর্ট করত। এই ধরনের ঝামেলার পর তার মা-ও একদিন ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। কান্না করে আমাকে বললেন, আমার ছেলেটাকে রেহাই দাও। তোমার আর তাকে দলে রাখার দরকার নেই। কিন্তু বাচ্চুকে গিটার ছাড়ার কথা কোনোদিনই শোনানো যায়নি। গিটারের প্রতি ছিল তার এমনই প্রেম,’— বলেন জ্যাকব ডায়াস।
১৯৭২ সালে স্কুলে পড়া অবস্থায় জ্যাকব ডায়াসের কাছে তালিম শুরু আইয়ুব বাচ্চুর। তখন স্পাইডার ব্যান্ডের গিটারিস্ট ছিলেন স্বপন সরওয়ার। ১৯৭৪ সালে স্বপন কানাডা চলে গেলে বাচ্চু স্পাইডার ব্যান্ডের নিয়মিত গিটারিস্ট হয়ে যান বলে জানান জ্যাকব।
এর মধ্যে বাচ্চু ও তার বন্ধুরা মিলে ‘আগলি ফেস’ নামে একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। জ্যাকব ডায়াস সারাবাংলাকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একবার চট্টগ্রামে এলে আগলি ফেস উনার সামনে গান করে। তখন জিয়াউর রহমান বললেন, আগলি ফেস এটা কোনো নাম হলো? এটা পাল্টে ফেল। তখন আগলি ফেসের নাম হয় গোল্ডেন বয়েজ।
১৯৮৪ সাল পর্যন্ত স্পাইডারের সাথে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। জ্যাকব বলেন, ‘সার্কাস, ভ্যারাইটি শো, বিয়ে, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক— এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যে আমরা গান করিনি। অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল আমাদের এই ব্যান্ডদল।’
১৯৮৪ সালের দিকে চিত্রশিল্পী আহমেদ নেওয়াজ খানদের গড়ে তোলা ব্যান্ডদল ‘সোলস’-এ গিটারিস্ট সংকট দেখা দেয়। তখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হন বাচ্চু।
আহমেদ নেওয়াজ খান সারাবাংলাকে বলেন, শহরে তখন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট তেমন ছিল না। চুংকিং নামে একটি রেস্টুরেন্টে বসে বাচ্চু সঙ্গে আমার সোলস ব্যান্ডদলে বাজানো নিয়ে চুক্তি হয়। নকিব খান, তপন চৌধুরী, বাচ্চুরা মিলে সোলস ব্যান্ডকে তুমুল জনপ্রিয় করে ফেলে। ১৯৯২ সালের দিকে বাচ্চু ঢাকা থেকে ডাক পাওয়া শুরু করে। ১৯৯৩ সালের দিকে সে একেবারে ঢাকায় স্থায়ী হয়।
নেওয়াজ বলেন, ‘স্পাইডারেও ভোকাল হিসেবে মাঝে মাঝে গান করত বাচ্চু। তবে সোলসে এসে ভোকাল হিসেবে বাচ্চু জনপ্রিয়তা পায়। সে অসম্ভব অনুকরণ করতে পারত। গিটারের কথা আর কী বলব! সে ছিল গিটার গুরু। গিটারে সুর তুলে কথা বলতে পারত।’
গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসেন আইয়ুব বাচ্চু। তখন আহমেদ নেওয়াজ খানের সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়। এর আগে, গত ২০ মে বাচ্চুর শেষ দেখা হয় জ্যাকব ডায়াসের সঙ্গে। চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠান করতে এসে উঠেছিলেন হোটেল এভিনিউতে। ফোন করে জ্যাকবকে বললেন, ‘গুরু, আপনার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। হোটেলে চলে আসুন।’
গত সপ্তাহে আইয়ুব বাচ্চু যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন অনুষ্ঠান শেষ করে স্পাইডার ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত অনেকের বাসায় ঘুরে যান। কিন্তু জ্যাকব ডায়াসের বাসায় যাননি। ফেরার পথে বাচ্চুর ব্যান্ডের ড্রামবাদক সাইফুদ্দিন দুলালকে বলেন, ‘জ্যাকব ভাইয়ের বাসায় যাওয়া হলো না। একটা বড় ভুল হয়ে গেছে।’
‘আইয়ুব বাচ্চু আর কোনোদিন আমার বাসায় আসবে না। সেই স্পাইডার ব্যান্ডের সময় লালখান বাজারের শাহীন হোটেলে বসে ডিমের ঝোল দিয়ে পরোটা খাওয়া আর কখনোই হবে না’— কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন জ্যাকব ডায়াস।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর