‘রিয়াজ-শাবনুর জুটি পলিটিক্সের শিকার’
৩০ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:১১
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।
দুই দশকেরও বেশি সময় আগে সিলভার স্ক্রিনে পথচলা শুরু করেন রিয়াজ। সুন্দর চেহারা আর অনবদ্য অভিনয় রিয়াজকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের চূড়ায়। পেয়েছেন আকাশসম জনপ্রিয়তা। হয়েছেন প্রিয় নায়ক।
কয়েক বছর ধরে বড় পর্দায় অনুপস্থিত রিয়াজ। তবে মাঝেমধ্যে টেলিভিশন নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায় তাকে। অভিনয়ের পাশাপাশি বর্তমানে রিয়াজ নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সহ-সভাপতি পদে দায়িত্বরত আছেন। পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা সিনেমা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী করার জন্য তিনি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। তিনি মনে করেন সিনেমার প্রতি ভালোবাসা এবং সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এদেশের সিনেমা শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
সম্প্রতি রিয়াজ কথা বলেছেন সারাবাংলার সঙ্গে। একান্ত আলাপে তিনি তার ক্যারিয়ার, যৌথ প্রযোজনার সিনেমা এবং জীবনের নানা অজানা বিষয় সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলেছেন।
- দীর্ঘদিন যাবত আপনি বড় পর্দায় নেই। তারমানে কি রিয়াজ পরোক্ষভাবে সিনেমাকে বিদায় জানিয়েছেন?
বড় পর্দায় নেই এটা সত্য কথা। এর পেছনে কারণও রয়েছে। আমরা জানি এখন সিনেমার সংখ্যা কমে গেছে। তাছাড়া যে ধরনের সিনেমা নির্মিত হচ্ছে. এই সময়ে সে ধরনের সিনেমা করা সম্ভব না। পরোক্ষভাবে বিদায় নিয়েছি এমনটা না। আমার সঙ্গে মানানসই হবে এমন কোন চরিত্র পেলে সিনেমায় অভিনয় করব। আমি সিনেমা করছিনা, তবে টেলিভিশনে নাটক, বিজ্ঞাপনে কাজ করছি।
- নাটকে এবং বিজ্ঞাপন- দুই মাধ্যমে এখন ব্যস্ত থাকছেন। টেলিভিশনের এসব কাজ কি নিজের ভালোলাগা থেকে করছেন, নাকি অনুরোধে ঢেঁকি গিলছেন?
একজন অভিনয় শিল্পীর মধ্যে যে অভিনয়ের ক্ষুধা থাকে সেটি নিবারণ করার জন্য টেলিভিশন নাটকে কাজ করছি। সব নাটক যে ভালো হয় তা নয়। কিছু কিছু নাটক ভালোলাগা থেকে করি। আবার কিছুক্ষেত্রে অনুরোধে ঢেঁকি গিলি। অন্যদিকে বিজ্ঞাপন একটি সৃজনশীল জায়গা। কম সময়ে ভালোকিছু দেখানোর সুযোগ থাকে। অর্থনৈতিক কারণেও মাঝে মাঝে টেলিভিশনের জন্য নির্মিত নাটক বা বিজ্ঞাপনে কাজ করি।
- যতদূর জানি আপনি ব্যবসা করছেন। আপাদমস্তক অভিনয়ের মানুষ হয়ে ব্যবসায় কেনো নিজেকে সপে দিয়েছেন?
আমি মনে করি একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিটি শিল্পীর উচিত ব্যাকাপ রাখা। আমাদের দেশের যে প্রেক্ষাপট তাতে শিল্পীদের একটু বয়স হলেই অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। আমার ক্ষেত্রে যেন এমনটি না ঘটে সেজন্য ব্যবসা করা।
- সিনেমার ক্যারিয়ারে শাবনূর ও পূর্ণিমার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেছেন। কোন নায়িকার সঙ্গে জুটি সবথেকে এগিয়ে রাখবেন?
একসময় রিয়াজ-শাবনুর জুটি অপ্রতিরোধ্য ছিল। এরপর এই জুটি ফিল্মে নানা পলিটিক্সের শিকার হয়। তারপর দূর্ভাগ্যজনকভাবে জুটিটা ভেঙে যায়। পরবর্তীতে রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটি গড়ে ওঠে। এই জুটিও জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমরা অনেক ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিয়েছি। তাই বলব, এই দুটি জুটি আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তারা নন, আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তারা সবাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
- ফিল্ম পলিটিক্সের কথা বললেন। কি ধরনের পলিটিক্সের শিকার হয়েছিলেন?
আমি অভিনয়ের দিকেই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। অভিনয়ের বাইরেও একধরনের যোগাযোগ রাখতে হয় বুকিং এজেন্টদের সঙ্গে। তাদের সাথে আড্ডা দেয়া, মনরক্ষা করা, হিট ছবিকে ফ্লপ বানানো, ফ্লপ ছবিতে হিট বানানো, এধরনের বিষয় সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না তেমন।
- আজকাল পূর্ণিমার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছেনা। একজন অন্যজনের মুখ দেখাদেখিও করছেন না। ইন্ডাস্ট্রিতে এটা নিয়ে বেশ কানাঘুষাও হচ্ছে।
এরকম হওয়ার কোন কারণ নেই। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। তার সঙ্গে আমার সু-সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মধ্যে এমন কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি, যার কারণে এমন কানাঘুষা হতে পারে। এমন হতে পারে, অনেকে রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিকে নাটক বা অন্যকোন ছোট জায়গায় চেয়েছিলেন। সেকারণে মনে হতে পারে আমাদের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। আমাদের জুটি দর্শকের মনে দাগ কাটা একটি জুটি। সেজন্য আমি কখনো চাইনা এই জুটি অন্যকোন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হোক। বড় পর্দায় আমাদের আবেদন ছিল, আমি চাই দর্শকদের মধ্যে সেটাই বেঁচে থাক।
- অনেক শাকিব ভক্তদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে সমালোচনায় মুখরিত হতে দেখা যায়। শাকিব খানের সঙ্গে আপনার কোন মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব চলছে?
কেউ যদি আমার সমালোচনা করে, বাজে মন্তব্য করে তাহলে আমি বিচলিত হইনা। তাতে কর্ণপাত করিনা। কারণ আমি কেমন মানুষ সেটা আমি জানি। আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন।
শাকিব ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো করছেন। তিনি একা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে বহন করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো ভালো সিনেমাতে অভিনয় করছেন। কলকাতাতেও কাজ করছেন। এগুলো ভালোলাগার মতো বিষয়। কিন্তু শাকিব খানের একটি জিনিস আমার ভালো লাগেনা। শাকিব খানকে নায়ক বানিয়েছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। কলকাতার কেউ তাকে নায়ক বানায়নি। সে হিসেবে তার কাছে সবার আগে নিজের দেশর কথা ভাবতে হবে। তিনি কলকাতার সিনেমার গুণকীর্তন করছেন। সেখানকার সিনেমা এখানে মুক্তি দেয়ার পেছনে ভূমিকা পালন করছেন। এসব আমার কাছে ভালো লাগে না।
- যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়ে আন্দোলন করেছেন। নতুন নীতিমাল করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় নতুন করে কোন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মিত হচ্ছেনা। তাহলে কি আপনাদের আন্দোলন সফল?
এখন যে নীতিমালা হয়েছে তাতে আগের নীতিমালার ক্রটি সংশোধন হয়েছে। কলকাতার ৯৫ শতাংশ আর বাংলাদেশের ৫ শতাংশ শিল্পী নিয়ে সিনেমা বানিয়ে যেসব সিনেমা মুক্তি দেয়া হচ্ছে তা যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ছিল না। কলকাতার লোকাল সিনেমাকে যৌথ প্রযোজনার নমে চালানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। মোটেই যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করিনি। এখন যৌথ প্রযোজনার সিনেমা করতে হলে সমান সমান শিল্পী, কলাকুশলী নিতে হবে।
- আপনাদের আন্দোলনের বিপক্ষে যারা ছিলেন তারা আপনাদের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিকে ‘বেকার সমিতি’ অভিহিত করে হেয় করছেন। এ বিষয়ে কি বলবেন?
তারা আমাদের বেকার বলুক আর যাই বলুক, তাতে আমাদের যায় আসে না। আমরা সিনেমার পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে ভাবছি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে ভাবছি। কেউ যদি অন্যের হাতে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে দিয়ে দিতে চান তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
যারা অসমতার যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করতে আগ্রহী তারা তো অনেক কথাই বলতে পারেন। তারা অনেক অন্যায্য কিছু চাইতে পারেন। তারা ‘মাতাল হয়ে দেয়ালে হিসু’ করতে চাইতে পারেন। তাদের সব চাওয়াকে সমর্থন করতে হবে এমনতো না।
- রিয়াজ কেনো সিনেমা প্রযোজনা করছেন না?
আমি ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমা প্রযোজনা করেছি। তখন বাংলাদেশের সিনেমার অশ্লীল সময় পার করছিল। আমি সাহস করে সিনেমা প্রযোজনা করে দেখিয়েছি। তখন সিনেমার গান এতো জনপ্রিয় ছিলনা। বাংলাদেশের সিনেমার গান গাড়িতে বাজতো না। আমার সিনেমায় হাবিবের গাওয়া গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এমনকি ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমাতে বাংলাদেশের সিনেমায় প্রথমবারের মতো পোস্টারের জন্য আলাদা ফটোশ্যুট করি।
এরপর আরও সিনেমা প্রযোজনা করতে পারতাম। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। প্রথম সিনেমাটিতে আমার সহযোগী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি আর প্রযোজনায় আগ্রহী হয়নি। এককভাবে সিনেমা প্রযোজনা করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
- এবার অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। সম্প্রতি ৪৭ বছরে পদার্পণ করেছেন। এই দীর্ঘ জীবনের এখন পর্যন্ত উপলব্ধির কথা জানতে চাই।
জীবন ক্ষনস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে সুখি থাকা জরুরী। ফেলে আসা বছরগুলো ফিরে পাওয়া যায়না। তাই বিগত বছরগুলোর পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করে সময় নষ্ট করতে চাইনা। যতোদিন বাঁচবো ততদিন কাজ করে যেতে চাই।
- জীবনের সবথেকে কষ্টের সময়।
যখন আমার মা মৃত্যু শয্যায় ছিলেন তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আমাকে শুটিং করতে হয়েছে। মাকে অসুস্থ রেখে শুটিং করা খুবই বেদনাদায়ক ছিল। এটি আমার জন্য সবথেকে কষ্টের একটি সময় হিসেবে মনে করি।
- মৃত্যু নিয়ে চিন্তা হয়?
জন্মেছি যখন তখন মৃত্যু অবধারিত। আমার বাসার পাশেই কবরস্থান আছে। আমি প্রতিনিয়ত সেখানে মানুষের কবর দেখি। আমার কাছে কবর সবথেকে শান্তির জায়গা মনে হয়। মৃত্যু নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। তবে আমি জীবনে আরও কিছু সময় চাই। আমার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে যেতে চাই। এছাড়া আমার আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেগুলো করা প্রয়োজন।
- জীবনের কোন বিষয় নিয়ে আক্ষেপ হয়?
আমি খুব একটা আক্ষেপ করিনা। আর আক্ষেপ করেইবা লাভ কি? তবে সিনেমার ক্যারিয়ারে কিছু ভুল করেছি। নিজেই যেহেতু সেসব ভুল করেছি তাই সেগুলো নিয়ে আর আক্ষেপ করতে চাইনা।
সারাবাংলা/আরএসও/পিএ