দেবী : রূপালী পর্দায় নারী শক্তির চিত্রায়ন
৩১ অক্টোবর ২০১৮ ১২:০৯
তানজিনা হোসেন ।।
অভিনেত্রী জয়া আহসান তার প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্রের জন্য হুমায়ুন আহমেদের দেবী উপন্যাসকে বেছে নিয়েছেন-প্রথম যখন এ কথাটি শুনি তখন খানিকটা বিরক্তই হয়েছিলাম। মৃত্যুর কয়েক বছর পরও হুমায়ুনের ক্রেজ আমাদের কথাসাহিত্যে মোটেও কমেনি, পাঠকের মধ্যে তো নয়ই, এমনকি নতুন প্রজন্মের লেখকরা এখনো চেষ্টা করেন হুমায়ুনের মতো করে লিখতে, অনুকরণ করেন তার লেখার ধরণ; তাই হুমায়ুনের জীবনী বা হুমায়ুনের জনপ্রিয় কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা এখনো বাণিজ্যিকভাবে ‘নিরাপদ’-হয়তো এ কারণেই জয়া এই গল্প বেছে নিয়েছেন সেটাই ধারণা করেছিলাম তখন। আমাদের চারপাশ কত বদলেছে, বদলে গেছে জীবন, মানুষ, সমাজ, চারদিকে কত নিত্য নতুন ঘটনা, গল্প, বদলেছে আমাদের আনন্দ-বেদনার ধরণ, চারপাশে ছড়িয়ে আছে কত বিচিত্র বিষয় আর অনুভব, সিনেমা বানানোর জন্য সমসাময়িক কাহিনী বা চিত্রনাট্যের কি সত্যিই এত অভাব? তারপরও হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র ‘ মিসির আলি’ আর বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ‘ জয়া আহসান’ এর প্রযোজনা-অভিনয়-এই দুই জনপ্রিয়র মিশেলে কী হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বইকি। আমার ধারণা আরও অনেকেই অপেক্ষা করে ছিলেন। সেই অপেক্ষার ফলাফল কী দাঁড়াল সেটাই বলতে চাচ্ছি।
প্রথম কথা, ছবিটি বাণিজ্যিক দিক দিয়ে একটি অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি হতে চলেছে, তা হলে দর্শকদের ভিড় দেখেই বোঝা যায়। আর হল থেকে বেরোনোর সময় তারা যে ঠকেন নি, পয়সা ও সময় উসুল হয়েছে-সেটাও তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট। না, শুধু ‘হুমায়ুন’ আর ‘মিসির আলি’ গিলিয়ে ছবি ব্যবসা সফল হয় না, যদি না তার নির্মাণে মুন্সিয়ানা থাকে। পরিচালক অনম বিশ্বাস ছবিটিকে উপভোগ্য করে তুলেছেন। ঘটনার পর ঘটনা, দৃশ্যের পর দৃশ্য তৈরি করেছেন সাবলীলভাবে, বেশ কিছু দৃশ্যে দর্শককে ভয় পাইয়ে দিতে বা আঁতকে উঠতে বাধ্য করেছেন, কোন কোন সময় বুক হিম হয়ে এসেছে অনেকের। সাইকো থ্রিলার মুভিতে দর্শকের অনুভূতি আর প্রতিক্রিয়া নিয়ে খেলতে হয় পরিচালককে, তিনি যদি এ খেলায় পারদর্শি না হোন তবে পুরোটাই হাস্যকর হয়ে ওঠে। আলফ্রেড হিচকক এর ছবি দেখার সময়টাতে আপনার অনুভূতিগুলো টান টান হয়ে থাকবে, চোখের পাতা পড়বে না, নিঃশ্বাস জোরদার হবে-এই না হলে আর সাইকো থ্রিলার দেখা কেন? এখানে চিত্রনাট্যের সাথে তার ভিজুয়ালাইজেশনের টেকনিক্যাল দিকটাও খুব জরুরি। বাংলাদেশের ছবিতে এই বিষয়টা নতুন, প্রায় আনকোরা, আর এতে অনম বিশ্বাস বেশ সফল-স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কিছু কিছু দৃশ্যায়ন তো বেশ প্রশংসার দাবিদার। যেমন-ছোট্ট জিতু মিয়া যখন রাতে প্রস্রাব করতে ওঠে ও তার সামনের সাদা দেয়ালে আধো অন্ধকারে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে দুটি বালিকার আবছা অবয়ব, কিংবা রানু ছাদে আনমনে বসে আছে, তার পাশে বসে আছে একটা পেঁচা আর খুব ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে দূরে ওই পাশে মেয়ে দুটির হালকা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো তৈরি করতে জোর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন।
দ্বিতীয় কথা, যা নিয়ে সবার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বলে মনে করি, মিসির আলি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী কেমন করবেন? হুমায়ুন বেঁচে থাকতে নিজে মিসির আলিকে নিয়ে নাটক বানিয়েছেন, তাতে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, সেই চরিত্রগুলোতে আবুল হায়াতকে বেশ বৃদ্ধই দেখা গেছে। চঞ্চলকে কি সেই চরিত্রে মানাবে? কথা হল, আসলে মিসির আলির বয়স কেমন, তিনি দেখতে কিরকম-এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই আমাদের। পাঠক যার যার মত করে ভেবে নিয়েছেন তাকে। যদিও ‘দেবী’ উপন্যাসেই এক জায়গায় হুমায়ুন লিখেছেন ‘রানু বলল-ইউনিভার্সিটির টিচাররা এমন রোগা হয়, তা তো জানতাম না! আমার ধারণা ছিল তারা খুব মোটাসোটা হন।’ কিংবা ‘ রানু খুব সহজ স্বাভাবিক আচরণ করল। এর প্রধান কৃতিত্ব সম্ভবত মিসির সাহেবের। তিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বললেন।’ হ্যাঁ, চঞ্চল রোগা, চুলগুলো উসকো খুসকো-তার চরিত্রের সাথে মানানসই, আর তিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতেই কথা বলেছেন। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল চঞ্চল আরও ভাল করতে পারতেন। আয়নাবাজি ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন বার বার, নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, মুহুর্তে মুহুর্তে চমৎকৃত করেছিলেন দর্শককে, ‘দেবী’ তে সে তুলনায় তাকে একটু নিস্প্রভ মনে হয়েছে। এর একটা বড় কারণ জয়া আহসান নিজে। দেবী এমন একটি চলচ্চিত্র যেখানে প্রধান চরিত্র দুটো আসলে প্যারালাল-রানু আর মিসির আলি। কেউ কারো চেয়ে কম নন। লজিক আর এন্টি লজিক-এই দুটো জিনিস মুখোমুখি হয় তারা দুজন একত্র হলে। দুটোই সমানভাবে শক্তিমান। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে জয়া ছাড়িয়ে গেছেন মিসির আলিকে, চঞ্চলকে পেছনে ফেলে দু-তিন ধাপ এগিয়ে গেছেন কখনো, দখল করে ফেলেছেন দর্শকদের মানস ও অস্তিত্ব। চঞ্চলের ব্যর্থতা নয় এটি, বরং জয়ার অসামান্য দক্ষতা। রানু নামের মেয়েটির অসহায়ত্ব, দ্বন্দ, বেদনা, অতীত ভুলতে না পারার অসহনীয় বেদনা, নিজের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা নিয়ে অনিশ্চয়তাসব কিছু মিলে মিশে দর্শকদের অভিভুত করে ফেলেছেন তিনি। মিসির আলি তার যুক্তি আর সত্য প্রতিষ্ঠার আকাংখা নিয়ে দর্শককে ততটা নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন নি।
এই ছবির শ্রেষ্ঠ দৃশ্যটি হল যখন মিসির আলি মধুপুর থেকে ফিরে আসার পর রানু তার সাথে দেখা করতে যায়। মিসির আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে রানুর এই আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে থাকেন, উড়িয়ে দিতে থাকেন তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দাবিগুলোকে, যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে তোলেন, ওদিকে রানু তখন প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়তে থাকে, সে কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে না যে কী হয়, সে বলতে চায় মন্দিরের মধ্যে বা নদীতে অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো আসলেই ঘটেছিল। এই যে দুটি বৈপরীত্য মুখোমুখি বসে দৃশ্যটা রচনা করে গেল, দুজনই সমানভাবে সত্য, সমভাবে বলীয়ান, কেউ কাউকে হারাতে পারবে না-তবু দৃশ্যের শেষে দর্শক হিসেবে আপনার সহানুভূতি ও পক্ষাবলম্বন রানুর দিকেই যাবে। না, রানু সুন্দরি ও নারী বলে নয়, রানু আপনাকে প্রভাবিত করতে পেরেছে বেশি। জয়া তার অসাধারণ অভিব্যক্তি, নীরব কান্না আর বুক ঠেলে আসা অভিমান নিয়ে ততক্ষণে আপনাকে অধিকার করে নিয়েছেন।
এবার ছবির অন্য চরিত্রগুলোর প্রসঙ্গে আসি। শবনম ফারিয়া প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেত্রী হতে যাচ্ছেন-এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হুমায়ুন আহমেদের চিরাচরিত নার্ভাস, লাজুক, বোকাসোকা, রোমান্টিক নায়িকা চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁতভাবে। আর ইরেশ যাকেরের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মিনিট দশ পনেরোর উপস্থিতিতে তিনিই এই ছবির সবচেয়ে উজ্জ্বল পুরুষ চরিত্র। সময় পেলে হয়তো বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালার স্ত্রী, নীলুর ছোট বোন বিলু-এই চরিত্রগুলোকে আরেকটু বিস্তারিত করা যেত, তাতে করে ছবিটা একটু তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়েছে-এমন অনুভূতি হতো না; কিন্তু রানু চরিত্রের অসংলগ্নতা ও অস্বাভাবিকতা দৃশ্যায়ন করতে গিয়ে অন্য দিকে অতখানি সময় দেয়া হয়তো সম্ভবও ছিল না পরিচালকের।
এবার শেষ কথায় আসি। যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কেন জয়া আহসান এই পুরনো কাহিনী বেছে নিলেন? কেন সমসাময়িক ঘটনাবলী ও সমস্যা থেকে গল্প তুলে আনার সাহস নিলেন না? তার মত জনপ্রিয় নায়িকা এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই পারতেন! এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে পুরো ছবিতে। আজ থেকে এক বছর আগে #মি টু আন্দোলন ও সাহিত্যে নাটকে চলচ্চিত্রে এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। লিখেছিলাম যে মি টু আন্দোলন কাঁপিয়ে দেবে আমাদের চেনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতকে, আমরা নারীর চোখে বিশ্ব দেখতে শিখব নতুন করে, আমাদের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র কথা বলতে শুরু করবে নারীর যৌন নিপীড়ন নিয়ে-যা এতকাল রোমান্টিকতার চাদরে যত্ন নিয়ে আড়াল করে রাখা ছিল। বাংলা চলচ্চিত্রে রেপ, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস এর দৃশ্যের কমতি হয়নি কখনো, কিন্তু বালিকার মনের গভীর গোপন বেদনা, অতীতের অন্ধকার থেকে উঠে আসা ক্লেদ আর অপমানের যন্ত্রণা-এই অনুভূতির দেখা কি আগে পেয়েছি? জয়া আহসানের ‘দেবী’ হুমায়ুন আহমেদের ‘ দেবী’ গল্পের ছায়া মাত্র। হ্যাঁ, দেখা গেল নিপীড়নের ধরণ পাল্টেছে। আজকের তরুণীরা সাইবার অপরাধ, ফেসবুক প্রতারণা কি অর্ন্তজালের ফাঁদে পড়ছেন। বিষ্ণু মন্দিরে রানু যে নিপীড়নের শিকার, ঢাকা শহরে নীলুও তাই। অশরীরি গল্পের আড়ালে জয়া আহসান সেই গল্পই বলতে চেয়েছেন। আর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বেছে নিয়েছেন নারী শক্তিকেই। কোন নায়ক কি কোন পুরুষ তাদের বাঁচাতে এড়িয়ে আসে নি। বরং পুরুষ চরিত্রগুলো তাদের অবিশ্বাস করছে, হাসি তামাশা করছে, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে তাদের অনুভূতি আর বেদনাগুলোকে। তাই তারা নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছেন সেই শক্তি। তারা একত্র হচ্ছেন, নারী শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই থিমটুকু পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে অনুভব করা গেছে। আর তার চিত্রায়নের জন্য ‘ দেবী’ উপন্যাসকে বেছে নিয়ে জয়া আহসান ভুল করেন নি-শেষ অবধি সেটা স্বীকার করতেই হল।
তানজিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক।
সারাবাংলা/পিএম