বেরিয়ে এসো মেয়েরা, কথা বল, প্রতিবাদী হও: মনীষা কৈরালা
৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৮:২৪
।।এসএম মুন্না, লিট ফেস্ট থেকে ।।
আমি সব সময় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অন্যায়-অবিচার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালও সমর্থন করি না। যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তবে তদন্ত ও প্রমাণ-সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দোষ প্রমাণিত হলে কোনো ছাড় নয়। কথাগুলো বললেন বলিউড তারকা মনীষা কৈরালা। একই সঙ্গে সামাজিক নিপীড়নের শিকার হয়ে নিশ্চুপ না থেকে বিচারের দাবিতে নারীদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান এই বলিউড অভিনেত্রী।
বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ঢাকা লিট ফেস্টের অষ্টম আসরের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (৯ নভেম্বর) ‘ব্রেকিং ব্যাড’ নামের এক সেশনে এসে তিনি এ সব কথা বলেন ঢাকার ভক্ত-অনুরাগীদের। লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক সাদাফ সায সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় এই সেশনে মনীষা কৈরালার সঙ্গে ছিলেন এ সময়কার আরেক বলিউড অভিনেত্রী ও নির্মাতা নন্দিতা দাশ। এই সেশনে মনীষা তার বলিউড যাত্রা, অভিনেত্রী হিসেবে পদে পদে আসা বাধা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বলিউডের #মি টু আন্দোলনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। সম্প্রতি বলিউড অভিনেতা নানা পাটেকর ও পরিচালক সাজিদ খানের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগের সূত্র ধরেই প্রশ্ন আসে মনীষার কাছে।
নারীদের উদ্দেশে মনীষা কৈরালা বলেন, ‘তোমরা যে কোনো নিপীড়নের শিকার হলে মুখ বন্ধ করে রেখো না। সাহস করে বেরিয়ে এসো। কথা বল তোমরা। তোমরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারো, অথচ নিজেদের উপর হওয়া জুলুমের কথা কেন বলছ না? তোমাদের কঠোর প্রতিবাদী-উচ্চারণ থামাতে পারে এসব নিপীড়ন।’
অভিনয় জীবনের শুরুতে একটি ভালো চরিত্র পেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মনীষাকে। সে সব কথা তুলে ধরেন তিনি। বললেন, ‘বাণিজ্যিক সিনেমাতে গতানুগতিক চরিত্রে অভিনয় করতে আমার মোটেও ভালো লাগত না। আমি একটু ব্যতিক্রম হতে চাইতাম। সবাই যা করছে, তার চেয়ে একটু আলাদা কিছু করতে পারলে খুব ভালো লাগত। হ্যাঁ, তখন আমি বাণিজ্যিক সিনেমাতে প্রচুর কাজ করেছি। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকত আর্ট ফিল্মে।’
মনীষা বলেন, ‘তখন আমি হন্যে হয়ে গল্প খুঁজতাম, বিষয় খুঁজতাম। একটি ভালো চরিত্রের জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম। তবে আমি ভাগ্যবতী যে পরিচালকরা তেমন গল্প আর চরিত্র নিয়েই এসেছিলেন আমার কাছে। সুযোগটা আমার কাছে এসেছে, কিন্তু অপেক্ষাও করতে হয়েছে। নিজেকেও প্রমাণ করতে হয়েছে।’
অভিনয় জীবনে মনীষা সবসময়ই জীবনঘেঁষা চরিত্রের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। এ চরিত্রগুলো তার কাছে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং মনে হয় বলে উল্লেথ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে যে তখন চ্যালেঞ্জটা নিতে হত। তখন আমার উঠতি সময়। এমন একটি চরিত্র যখন করতাম, তখন নিজের আনন্দ বেড়ে যেত বহুগুণে। আমি আজও সেই জীবনঘেঁষা চরিত্র খুঁজি।’
বলিউডে নারী অভিনেত্রীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথাটি জানান মনীষা কৈরালা। তিনি বলেন ‘এখনও মনে করা হয়, বয়স ৪০ পেরিয়ে গেছে তো ওকে মা-নানীর চরিত্রে দিয়ে দাও। অথচ একজন অভিনেত্রী যে যেকোনো বয়সে যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করতে পারে, এটা এখনও অনেকে মানতে চায় না। হ্যাঁ, অনেক অভিনেত্রী সেই বয়সের সীমারেখা পেরিয়ে এসে ভীষণ সাহসী চরিত্রে অভিনয় করছেন, প্রশংসাও কুঁড়িয়েছেন। কিন্তু সেই অভিনেত্রীদের দেখার দৃষ্টিকোণ এখনও সীমাবদ্ধ। মনীষা কৈরালা আরও বলেন, ‘চল্লিশের পর নারীদের এজিং সমস্যা শুরু হয়। তখন বলিউডে কাজ পেতে যদি সমস্যা হয়, তখন অনেকে সার্জারিও করতে গিয়েছে। এসব ধারণা পরিবর্তন হওয়া উচিৎ।’
সিনেমাতে মুখ্য বা কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন নারী অভিনয় করবেন, বলিউডের অনেক পরিচালকের চোখে এখনও এটা এক ‘হাস্যকর ব্যাপার’ বলে মন্তব্য করেন মনীষা। বলিউডে নারীদের এগিয়ে চলার পথ প্রশস্ত হলেও নারীদের অধিকারের বিষয়ে আরও অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা তার জীবনের নানা কাহিনী, বলিউড যাত্রা আর নিজের মূল্যবোধের কথাগুলো নিয়ে প্রকাশ করেছেন ‘হিল্ড’ নামে একটি বই। সেই বইটি নিয়ে তিনি লিট ফেস্টের তৃতীয় দিন শনিবার (১০ নভেম্বর) বেলা সোয়া ১১টায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে কথা বলবেন ঢাকার দর্শকের সামনে।
শুক্রবার বইটি নিয়ে মনীষা বলেন, ‘নিজের জীবনের নানা কথা, অভিজ্ঞতা, সফলতা আর ব্যর্থতার কথা আমি এই বইতে তুলে ধরেছি। আমার দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতার কথাও কিন্তু উঠে আসবে। স্ত্রী হিসেবে আমি কতটা ব্যর্থ- সে কথা উঠে এসেছে এই বইয়ে। আমি কিভাবে ক্যান্সার জয় করে এলাম, সে কথাও রয়েছে এখানে।’
মনীষা কৈরালার জন্ম ১৯৭০ সালে কাঠমান্ডুর কৈরালা পরিবারে। কমিউনিস্ট নেতা ও নেপালের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বিপি কৈরালা মনীষার ঠাকুরদা, চাচা গিরিজা প্রসাদ কৈরালাও পরে হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মনীষার বাবা প্রকাশ কৈরালা সামলেছেন নেপালের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
কমিউনিস্ট পরিবারের মেয়ে সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা ওড়াবে কোথায়! তা নয়, রূপালি জগতের নেশায়মত্ত মনীষা একেবারে স্কুলবেলাতেই নাম লেখালেন মডেলিংয়ে। পড়তে এলেন ভারতে, সেখানেও মাথা থেকে নামানো গেল না অভিনয়ের ভূত। তারও আগে ১৯৮৯’ তে মনীষা অভিনয় করে এসেছেন ‘ফেরি ভেতওলা’ নামের একটি সিনেমাতে।
বলিউডে থিতু হতে একটু কাঠখড় তো পোড়াতেই হত! তবে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি মনীষাকে। নজরে পড়ে গেলেন ডাকসাইটে পরিচালক সুভাষ ঘাইয়ের। তার সিনেমা ‘সওদাগর’ এর মাধ্যমেই হয়ে গেল মনীষার বলিউডি অভিষেক। এর পর মনীষাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ‘ইয়ালগার’ ‘নাইনটিন ফোরটি টু-আ লাভ স্টোরি’, ‘ক্রিমিনাল’, ‘আকেলে হাম আকেলে তুম’, ‘মন’ ‘ছোপা রুস্তম’, ‘তুম’, ‘অগ্নিসাক্ষী’, ‘গুপ্ত’, ‘দিল সে’, ‘লজ্জা’, ‘কোম্পানি’-র মতো কমার্শিয়ালে গ্ল্যামারাস অবতারে দেখা যায় তাকে।
কমার্শিয়ালের বাইরে এসে মনীষা বেশকিছু বিকল্প চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের হিন্দি, মালায়লাম সিনেমাতে অভিনয় করেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে চারবার ঝুলিতে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও পুরেছেন তিনি।
২০১০ সালে মনীষা বিয়ে করেছিলেন সম্রাট দাহাল নামে এক নেপালি ব্যবসায়ীকে, যার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যম ফেইসবুক। দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তাদের। দু বছরের মাথায় হয়ে যায় বিচ্ছেদ। এরপরই মনীষার ক্যারিয়ারে আসে একটা বিরতি। ওভারির ক্যান্সার সনাক্ত হওয়ার পর নিজেকে গুটিয়ে নেন মনীষা। চিকিৎসার উদ্দেশে যান যুক্তরাষ্ট্রে। টানা ৫ বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসেন বলিউডে। সম্প্রতি তিনি সঞ্জয় দত্তের বায়োপিক ‘সঞ্জু’ ছবিতে সঞ্জয় দত্তের মা নার্গিস দত্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
সারাবাংলা/পিএ