রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার ধ্যান আমার জ্ঞান- তপন মাহমুদ
১২ নভেম্বর ২০১৮ ১০:৫৬
সঙ্গীতশিল্পী তপন মাহমুদ। সঙ্গীত সাধনাই যার জীবনের ব্রত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিরলস নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার সঙ্গীতলব্ধ জ্ঞান। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা। বর্তমানে তিনি সভাপতির দায়িত্বে থেকে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তপন মাহমুদ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সদস্য। প্রায় ৭ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘আনন্দলোক’ গ্রন্থণা, উপস্থাপনা ও পরিচালনা করছেন।
আজ ১২ নভেম্বর বরেণ্য এ কণ্ঠশিল্পীর ৬৮তম জন্মদিন। ১৯৫১ সালের আজকের এই দিনে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দুই কন্যা সন্তানের এ জনকের স্ত্রী বুলা মাহমুদও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। জন্মদিন উপলক্ষে সঙ্গীতজীবন ও বর্তমান রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার নানা দিক নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন এসএম মুন্না
প্রশ্ন : শুরুতেই আপনাকে জানাচ্ছি জন্মদিনের শুভেচ্ছা। দিনটি কিভাবে কাটাবেন কোনো পরিকল্পনা আছে কি ?
তপন মাহমুদ : না জন্মদিনের তেমন বিশেষ কোনো আয়োজন নেই। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সংস্থার উদ্যোগে ঘরোয়াভাবে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে যতটুকু জানি। তাও আবার খুব সীমিত পরিসরে। সেখানে থাকবে একটু আড্ডা আর কেক কাটা।
প্রশ্ন : দেশের রবীন্দ্রচর্চা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
তপন মাহমুদ : আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি রবীন্দ্রচর্চা হচ্ছে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে এ চর্চা তেমন দৃশ্যমান নয়। আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো তেমন প্রচার করে না, এটাই দুঃখ। আমাদের সামনে আগাতে হবে এটা ঠিক কিন্তু শেকড়কে ভুলে গেলে চলবে না। রবীন্দ্র, নজরুল, লোকগান নতুন প্রতিভাদের লালন করা উচিত। এ সবকিছুর পৃষ্ঠপোষকতা তেমন হচ্ছে না। রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : দীর্ঘদিন ধরে আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করে আসছেন। তখন আর এখনকার রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছেন কি ?
তপন মাহমুদ : আমি যখন বরিশাল ব্রজমোহন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকে গান করি। সে সময় রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেছি। মূলত সেখান থেকে আমার গানের জগতে পথচলা শুরু। বরিশালে প্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র সাহা, ঢাকায় প্রয়াত ফজলে নিজামী ও মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় প্রয়াত অরবিন্দ বিশ্বাসের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। তাদের কাছ থেকে যেমন শিক্ষা পেয়েছি। তা আমার গানের পথচলাকে আরও মসৃণ দিয়েছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি যখন গান করতাম তখনকার সময় রবীন্দ্র চর্চা তেমন একটা অনুকূল পরিবেশ ছিল না। তারপরেও আমার চর্চা থেমে ছিল না। রবীন্দ্র গানের চর্চার ক্ষেত্রে এখন অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বছর বছর অনেক শিল্পী তৈরি হচ্ছে। এটা ভালো দিক। আর একটা দিক আমার কাছে ভালো বাড়িতে না হোক নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতে একটা হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম থাকে।
প্রশ্ন : চর্চার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলছেন কি না এখনকার শিল্পীরা ?
তপন মাহমুদ : বড় আকারের রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা হচ্ছে এটাই তো আজকের দিনে বড় কথ। একটা সময় ছিল এদেশে রবীন্দ্র গান বা রবীন্দ্র উৎসব পালন করতে দেওয়া হতো না। এখন তো সেই পরিবেশ নেই। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার যেমন কণ্ঠ তৈরি হচ্ছে, তেমিন শোনার জন্য কানও তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘিরে প্রায় সারা বছরই কোনো না কোনা উৎসব লেগেই আছে। চর্চা বেড়েছে বলে তো শিল্পী তৈরি হচ্ছে। অনেকেই নিয়ম মেনে রবীন্দ্র গানের চর্চা করছেন।তবে রবীন্দ্রনাথের প্রথা মেনে কতটা শিখছেন বা চর্চা তা ভেবে দেখা দরকার।
প্রশ্ন : একাত্তরে কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
তপন মাহমুদ : একাত্তর সালে জুলাই মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যোগ দেই। সে সময় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখতে প্রচার করা হতো প্রেরণাদায়ী গণসঙ্গীত। আমি গাইতাম রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ শীর্ষক নিয়মিত কথিকা লিখে পাঠ করতাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে অতিথি শিল্পী হিসেবে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছি। এসব করেছি আমার দেশ-মাতৃকার কথা ভেবে। নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য।
প্রশ্ন : এত দিনে পথচলা আপনার উল্লেখ্য কাজগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন ।
তপন মাহমুদ : ১৯৭০ সাল থেকে বৈতালিক শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম নিয়মিত দর্শণীর বিনিময়ে গীতি-নৃত্য-নাট্যের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরিত হয় সংগঠনটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য শ্যামা, শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, মায়ার খেলা এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘মুসাফির’ নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করেছি এবং প্রধান পুরুষ চরিত্রে কণ্ঠদান দিয়েছে। এগুলো আমার সেরা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রুপ হিসেবে রূপান্তরিত ‘বৈতালিকের’ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও চর্চা ক্ষেত্র সুপরিসর করতে।
প্রশ্ন : আপনি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সংস্থার বর্তমান সভাপতি। সংগঠনের কর্মকাণ্ড কেমন চলছে?
তপন মাহমুদ : সন্তান জন্ম দিয়ে পিতা হিসেবে তার যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে, আমিও তেমন পিতা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি সংগঠনটিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে। সন্তান বড় হয়েছে, এটা খুব আনন্দের যে এতদিন সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলতে পারছি। আমার ভেতরে এক অনির্বচনীয় আনন্দ কাজ করছে।
প্রশ্ন : গানের পাশাপাশি আপনার অন্য জগত সম্পর্কে কিছু জানতে চাই…
তপন মাহমুদ : আমি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে দীর্ঘ ২৫ বছর কাজ করেছি। ২০০২ সালে উপ-সচিব হিসেবে ২৫ বছর চাকরি পূর্তিতে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করি। বতর্মানে বাংলাদেশ জেনারেল ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে হেড অব এইচ আর অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট হিসেবে কর্মরত আছি। এত কাজের মধ্যেও রবীন্দ্র চর্চা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছি। একজন শিল্পীর বড় সাধনা হচ্ছে নিয়মিত রেওয়াজ করে শ্রোতার কাছে সঠিক সুর-তাল-লয় তুলে ধরা। আমি সেটাই করছি রেওয়াজ করে। রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার ধ্যান। আমার জ্ঞান।
প্রশ্ন : রবীন্দ্র গানের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন বহু দিন ধরে। বহু জনপ্রিয় গান কণ্ঠে ধারণ করেছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার, চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা। সম্প্রতি ‘উদীচী নিউইয়র্ক’ প্রদত্ত সম্মাননা পেয়েছেন। স্বীকৃতি পেতে কেমন লাগে?
তপন মাহমুদ : আমি প্রাপ্তির জন্য কোনোদিন কিছুই করিনি। একজন শিল্পী হিসেবে শীর্ষে ওঠার ইচ্ছাও কখনও আমাকে পেয়ে বসেনি। তবে কোনো কাজের স্বীকৃতি বড় আনন্দের। এখন যেভাবে পুরস্কার কেনাবেচা হয়, এটা ভেবে খুব কষ্ট পাই। আমার যেটুকু অর্জন সেটা নিয়েই থাকতে চাই। সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আপনার পরিকল্পনার কথা বলুন।
তপন মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথ নিয়েই তো আমার কাজ। নতুনদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি বের করার প্রচেষ্টা আছে। আজ যে নবীন, ৩০-৩৫ বছর পরে সে বয়স্ক হবে। কাজেই এ গানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন করতে শিখবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভিডিও করে ডিভিডি আকারে বাজারজাত ও বিভিন্ন চ্যানেলে দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
তপন মাহমুদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/পিএম