একজন সঞ্জীব দা ছিলেন, আছেন
১৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৪:১৬
খায়রুল বাসার নির্ঝর ।।
বাংলা গান আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর ছিলো বলেই। ১৯৬৪-র এদিন জন্ম নেন একজন ক্ষণজন্মা। সঞ্জীব চৌধুরী নাম তার। কণ্ঠে দ্রোহ নিয়ে, মনে নিয়ে প্রেম-মায়া-অভিমান তিনি হেঁটে গেছেন বিরান পথে। বিষণ্নতার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যে পথ মিশে গেছে অপার সম্ভাবনায়। ১৯ নভেম্বর তার প্রয়াণ দিবস।
ফিক্সড শট… সঞ্জীবের চোখমুখ নির্বিকার। গালে হাত। আঙ্গুলের ফাঁকে আয়েশি ভঙ্গিতে ধরা রূপালি কলম। মুখে খানিক অস্পষ্ট বলিরেখা, রাত জাগার ক্লান্তি। বাইরে গভীর রাত। দু’টো ট্রাক দাপিয়ে চলে গেলো রাস্তায়। তাতে, শীতে জুবুথুবু ঘরহারা লোকটা, যে শুয়ে ছিলো ল্যাম্পপোস্টের নিচে, ঘুম ভেঙ্গে বসে থাকে অনভ্যাসে। ঘুম নেই সঞ্জীবের চোখেও। কলম বলছে, কলম লিখছে- ‘গল্প ভাঙে তবু গল্প জমে, এই চোখে রাত্রি নিঝুম।’ সঞ্জীব ভাবছে- এই রাত শেষে আসবে যে সকাল, তার আলোয় মানুষের মনের অন্ধকার ঘুচে যাবে হয়তো! হয়তো পৃথিবীতে আর ঝরবে না রক্ত! সাম্য এনে দেবে শান্তি! সঞ্জীব উঠে দাঁড়ান। পায়চারি করেন কিছুক্ষণ। জানলার পাশে দাঁড়ান। বাইরে, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ইমেজে ডাস্টবিনের খাবার ভাগ করে খাচ্ছে একজন মানুষ ও দু’টো কুকুর।
ফ্ল্যাশব্যাক… উত্তাল প্রাঙ্গণ। বহিরঙ্গে চুপচাপ থেকেও অন্তরঙ্গে কী পরিমাণ উত্তাল-উত্তেজিত হয়ে পড়ে সমবেত- তার এক অদ্ভুত উদাহরণ সামনে নিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী গাইছেন, ‘সবুজ পাতা, একটি গাছ, স্মৃতির বৃক্ষ, পাতারা জানে নিজের চাষবাস’ অথবা ‘পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে ফিরেও আসবে না।’ এ নিরব কষ্ট ছড়িয়ে যায় উপস্থিত তারুণ্যে। সঞ্জীব চৌধুরী, একজন নাগরিক বোহেমিয়ান, স্বপ্ন গুঁজে দেন অজস্র চোখে। তারপর কোলাহল এড়িয়ে আরও আরও স্বপ্নের খোঁজে তিনি হেঁটে যেতে থাকেন বিরান পথে। …লং শট।
এরপর ইমেজ ক্রমেই পেছনে সরে যেতে থাকে। অসংখ্য স্পটলাইটে ধরা পড়ে অশোক কর্মকারের ইন্সটলেশন আর্ট, এখানেও রাত, ‘কালরাত্রি’। লাইট, সাউন্ড, পেইন্টিং, স্ট্যাচু সহযোগে শিল্পকলা একাডেমিতে ওই আয়োজনে প্রথমবার পাশাপাশি দাঁড়ান সঞ্জীব ও বাপ্পা। আটাশ মিনিটের মিউজিক তৈরি করেছিলেন অনেক খেটেখুটে, তারা একসঙ্গে। তখন বোধ জাগে- যদি কিছু করা যায় মিলেমিশে! অসংখ্য এলোমেলো নামকরণের প্রক্রিয়ায় সংযোজন-বিয়োজন শেষে স্থির হয় নাম হবে ‘দলছুট’। ’৯৬-এর নভেম্বর তখন। পরের বছর আসে ‘আহ্। ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠাটি উল্টানো হলো ‘আহ্’ দিয়ে। তৈরি হতে থাকে এরপর একেকটি অধ্যায়- ‘হৃদয়পুর’, ‘আকাশচুরি’, ‘জোসনাবিহার’।
সময় তবুও অস্থির থাকে। অরাজকতার রাক্ষস গিলে খায় সৌন্দর্য, জীবনযাপন। সঞ্জীবের বুকের ভেতর জমা হাহাকার-প্রতিবাদ উগরে আসে লিরিক হয়ে- ‘এদিকে তহবিল জমে, ওইদিকে চোখের পানি।’ তৈরি হয় ‘রাশপ্রিন্ট’। বিষণ্নতার খেরোখাতা থেকে উঠে আসে স্বপ্ন-সম্ভাবনার বার্তা। স্বপ্ন খেলা করে সঞ্জীবের ঢিলেঢালা শার্টে, অবিন্যস্ত চুলে। পুরুষ্ঠ গোঁফের আড়াল থেকে ঠিকরে বের হয় মহাকালের স্টেটমেন্ট- প্রেম থেকে দ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা থেকে জমায়েত। তার গান তাই হয়ে ওঠে সময়ের আশ্চর্য দলিল।
ব্যাকওয়ার্ডে দৃশ্য সরে যায় দ্রুত। সাংবাদিকতার দিনরাত, নব্বইয়ের উত্তাল আন্দোলন, ইউনিভার্সিটি, টিএসসির লাল দেয়াল, নিরব হোটেল, শাহবাগ মোড়, প্ল্যাকার্ড, গণিত ক্লাস ছেড়ে গণযোগাযোগ; পেরিয়ে হবিগঞ্জের মাকালকান্দি গ্রামের অভিজাত বাড়িটায় গিয়ে ফ্রেম ফিক্সড হয়।
ওখানে, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪-তে, গোপাল চৌধুরী এবং প্রভাষিনী চৌধুরী দম্পতির সপ্তম সন্তান হিসেবে জন্ম নিচ্ছে যে ছেলেটা, তার নাম হবে সঞ্জীব চৌধুরী। ক্লাস এইটের পর তিনি শহর ঢাকায় পা রাখবেন এবং ১৯৭৮-এর মাধ্যমিকে দখল করবেন জাতীয় মেধা তালিকার ১২তম স্থান। দখল করবেন শহর। বাংলা গানের শীর্ষ মুকুট জ্বলে উঠবে তার মাথায়। ওই মুকুটের ছবিকে আঁকড়ে ধরে এ ভূখন্ড বলবে, এ মানচিত্র বলে চলবে- ‘আমাদের একজন সঞ্জীব দা ছিলেন!’
সারাবাংলা/পিএম