সিনেমার গল্প, নেইকো অল্প
১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:৩৪
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
সিনেমার গল্পকে অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অক্সিজেন যেমন মানব দেহকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমন গল্পও সিনেমা বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিরা প্রায়ই তাদের বক্তব্যে বলেন বাংলা সিনেমা এখন কোমায় আছে। এ অবস্থার জন্য সিনেমার মানহীন গল্পের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েক দশক ধরে এই অভিযোগ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন কেউ কেউ।
বাংলা সিনেমার গল্প মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেম, মন্দ লোকদের আক্রমন, প্রধান খলনায়কের বাধা এবং সবশেষ মারপিট করে নায়কের জয়। এই একই কাহিনীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মানুষকে দেখানো হচ্ছে। অনেকটা পুরোনো মোড়কে নতুন লেভেল লাগিয়ে পণ্য বাজারজাত করার মতো।
আশার কথা হলো, এখন সিনেমার গল্প বদলাতে শুরু করেছে। ব্যাপক আকারে না হলেও সীমিত আকারে। কিছু কিছু পরিচালক পুরনো ধাঁচের গল্পের বাইরে গিয়ে মারদাঙ্গা, রগরগে দৃশ্য না রেখে বিষয়ভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ করছেন। সেসব সিনেমা মানুষ দেখছেও। ‘খাঁচা’, ‘গহীন বালুচর’, ‘অজ্ঞাতনামা’ ‘আয়নাবাজি’, ‘হালদা’, ‘জান্নাত’, ‘পোড়ামন ২’, ‘দেবী’, ‘দহন’-সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব সিনেমার অনেকগুলোই ব্যবসা সফল। আবার কিছু সিনেমা আছে যেগুলো ব্যবসা সফল না হলেও আলোচনায় ছিল।
তবে কি ধীরে গতিতে হলেও বদলে যাচ্ছে বাংলা সিনেমা গল্প? ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার পরিচালক অমিতাভ রেজা এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার পরিবর্তন ঘটে অনেক সময়। আশির দশকের পর থেকে বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসার পতন ঘটেছে। এটার মূল কারণ হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ভারতীয় সিনেমার সাথে লড়াই করে আমাদের সিনেমা টিকতে পারেনি। এই যে ভালো গল্পের সিনেমা হচ্ছে এটা বাজার তৈরীর চেষ্টা মাত্র। এরকম বাজার তৈরীর চেষ্টা পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থায় সব জায়গায় ঘটে। এটার সাথে গল্পের বাক পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। বাজারের প্রয়োজনে সিনেমার গল্প ঠিক হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভালো গল্পের সিনেমা সবসময়ের জন্য প্রয়োজন ছিল। ‘আয়নাবাজি’ এমন কোন ভালো সিনেমা না। এর চেয়ে অনেক ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে।’
একটা সময় পছন্দের তারকার কারণে প্রেক্ষাগৃহে যেতো মানুষ। হালের জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের কথাই ধরা যাক। তার ভক্তরা তাকে দেখার জন্য সিনেমা হলে যেতো, এখনো যায়। কিন্তু আজকাল তার সিনেমার দর্শক ভালো গল্পে তাদের প্রিয় নায়ককে দেখতে চায়। আবার অনেক ভক্ত-দর্শক সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনকার নির্মাতাদের বিনয়ের সঙ্গে ভালো গল্পের সিনেমা নির্মাণের জন্য অনুরোধ করছেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে সিনেমার গল্প নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
বাংলাদেশের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া ইদানিং প্রচলিত গল্পের বাইরে গিয়ে কিছু বিষয়ভিত্তিক ছবি নির্মাণে আগ্রহী হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিও প্রথম দিকের কিছু সিনেমায় প্রচলিত ধারার সিনেমা প্রযোজনা করেছে। এখন প্রতিষ্ঠানটির সিনেমার গল্পের বিষয়বস্তু বদলেছে।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘মানুষের চাহিদা, রুচির ওপর ভিত্তি করে সিনেমার গল্প পরিবর্তিত হয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিত্য নতুন প্রযুক্তি আসছে। সমাজ ও দর্শকের যেমন ডিমান্ড রয়েছে তেমন সিনেমার ক্ষেত্রেও এরকম কিছু ডিমান্ড রয়েছে।’
আব্দুল আজিজ মনে করেন পুরনো গল্পে পড়ে থাকলে মানুষ সিনেমা দেখবে না। মধ্যবিত্ত মানুষদের হলমুখী করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘আমি ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমা কেবল পুরস্কারের জন্য বানাচ্ছি না। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বানাচ্ছি। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শক সিনেমা না দেখলে সিনেমা হিট হবে না। আর মধ্যবিত্তদের প্রেক্ষাগৃহে আনতে হলে তাদের পছন্দ মতো গল্প দিতে হবে। আগের মতো মারামারি, চার-পাঁচটা গান দেখতে মধ্যবিত্ত দর্শকরা হলে যাবে না।’
বিষয়ভিত্তিক সিনেমা ভালো ব্যবসা করলেও এধরনের গল্পে খুব কম সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। যারা সেই পুরনো ধাঁচের গল্পের সিনেমা নির্মাণ করছেন, বিভিন্ন কারণে সেই সব ছবি আশানুরুপ ব্যবসা করতে পারছে না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যারা সেই পুরনো ঘরানার সিনেমা নির্মাণ করছেন তারা একটি সিনেমা বানিয়ে লোকসান করে লেজ গুটিয়ে ইন্ডাস্ট্রি থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে তারা সিনেমা করতে আসেন না। হয় তারা কালো টাকা সাদা করছেন নতুবা শুধু আনন্দ করার জন্য সিনেমা প্রযোজনা করছেন। সিনেমা কিন্তু মজা করার বিষয় নয়।’
বাংলাদেশের সিনেমার বিপ্লব ঘটাতে চাইলে শুধু গল্পের দিকে নজর না দিয়ে ভালো অভিনয়শিল্পীর দিকেও গুরুত্ত্ব দেয়ার পক্ষে তিনি। সেই সঙ্গে ভালো অভিনয় জানতে হবে শিল্পীকে। নওশাদ বলেন, ‘দর্শককে পুরো প্যাকেজ দিতে হবে। গল্প আছে কিন্তু ভালো মানের অভিনয় শিল্পী নেই। তাহলে সিনেমা ফ্লপ হবে।’
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমার গল্প নেয়া হয়েছে তামিল-তেলেগু সিনেমার গল্প থেকে। একাধিক তামিল-তেলেগু সিনেমা থেকে কাহিনী সংগ্রহ করে ককটেল গল্পেও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। যা দেখে দর্শকরা উপভোগ করার চেয়ে ছবিটি নিয়ে সমালোচনা করেছেন বেশি।
অসংখ্যা বাংলা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন আব্দুল্লাহ জহির বাবু। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সিনেমা এখন শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তার ব্যাখ্যাটি এরকম, ‘যুগের সঙ্গে তাল মেলানো আসল কথা। যারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলাতে পারছেন তারা গল্প নির্ভর সিনেমা নির্মাণ করছেন। আর যারা নিজেকে বদলাতে পারেননি তারা সেই সস্তা কাহিনীর সিনেমায় পড়ে আছেন। সেসব সিনেমা কেউ দেখছে না। অথচ তারা নিজেকে আপগ্রেডও করছেন না।’
এখনো কি কোন প্রযোজক আপনার কাছে তামিল-তেলেগু সিনেমার অনুকরণে গল্প লিখতে বলেন? এমন প্রশ্নে বাবু জানান, অনুকরণ করা গল্প নিতে এখন তেমন কেউ আর আসেন না। এখন অনেকে মৌলিক গল্পের সিনেমা নির্মাণ করতে চাইছেন। আমি এখন দুটি সিনেমার গল্প লিখছি। যেগুলো একদম মৌলিক। আমাদের সিনেমার গল্প পরিবর্তন হচ্ছে। শুয়োপোকার পিউপা অবস্থানে রয়েছি। নিশ্চয়ই খুব শিগগিরই প্রজাপতি জন্ম নেবে। ভালো ভালো গল্পের সিনেমা হবে।’
ভবিষ্যতে বাংলা সিনেমার গল্পের আমূল পরিবর্তন হবে, নাকি দুরকম গল্প কম বেশি অনুপাতে এগোবে সেটা জানতে হলে সময়ের প্রয়োজন। তবে সংশ্লিষ্ট অনেক চলচ্চিত্র ব্যক্তিরা মনে করছেন দেশীয় সিনেমার মান বাড়াতে হলে, বেশি বেশি দর্শক হলে টানতে চাইলে এবং বিদেশে বাংলা সিনেমার বাজার তৈরি করতে চাইলে যতো দ্রুত সম্ভব ভালো গল্পের সিনেমা নির্মাণে মনোনিবেশ করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএসও/পিএ
অমিতাভ রেজা চৌধুরী আব্দুল আজিজ আব্দুল্লা জহির বাবু ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ গল্প ঢাকাই সিনেমা সিনেমার গল্প