‘জামায়াতকে নিয়ে বিজয়ের ৫০ বছর পালন করবে এমন সরকার চাই না’
১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:৫০
সৈয়দ হাসান ইমাম-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, পরিচালক এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক। আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। এ উপলক্ষে সারাবাংলা ডট নেট-এর বিশেষ আয়োজন বিজয়ের ভাবনার শেষ পর্বে গুণী এই ব্যক্তিত্ব নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন পাঠকদের জন্য। যেখানে এসেছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। একইসঙ্গে উঠে এসেছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথাও। দেশ-বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এসএম মুন্না ও সালেহীন বাবু
- আজ বাঙালি জাতির গৌরবের ৪৭তম বিজয় দিবস। আর তিন বছর পর বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তি হবে। আপনার অনুভূতি কী?
সৈয়দ হাসান ইমাম: অনুভূতি এখন নির্বাচন ঘিরে। কারণ আমরা ২১ বছর স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে ছিলাম। সেটা আমরা আরেকবার হতে দিতে চাই না। জামাতিরা এখন ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। বামপন্থি যারা, তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আর বিএনপি তো আগে থেকেই ছিল। ফলে নির্বাচনের আগের এই সময়টায় প্রত্যাশা করি স্বাধীনতা স্বপক্ষের শক্তি যাতে আবারও ক্ষমতায় থাকে। তাদের কিছুটা ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে। তার চেয়ে স্বাধীনতা বিপক্ষের শক্তির ভুল-ভ্রান্তি অনেক বেশি।
আরও পড়ুন : ‘৪.৩১’ বিজয় ক্ষণে হাজার কণ্ঠে জাতীয় সংগীত
- এই ৪৭ বছরে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনে আমরা কতটুকু সফল?
সৈয়দ হাসান ইমাম: আসলে এখানে ৪৭ বছর হবে না। কারণ ৪৭ বছরের মধ্যে ২১ বছর তারাই (জামায়াত–বিএনপি–সামরিক সরকার) ক্ষমতায় ছিল। আমরা একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যখন ক্ষমতায় আসি তার সাড়ে তিন বছর পরেই জামাতিরা ক্ষমতায় এসে গেলো আবার। সামরিক শাসন চালু হলো। তারা মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হল। ওই সময় যতটুকু না বাংলাদেশ এগিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়েছে। সেই জন্য ৪৭ বছর বলা যাবে না। এখন থেকে যে সময় শুরু হয়েছে এ সময় থেকে আমরা ধরব। কারণ এই সময় থেকে ধরলে আমাদের ২২-২৩ বছর হবে। এরই মধ্যে বহু সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড হয়েছে। আমাদের বাঙালির যে সংস্কৃতি এটা তারা (জামাত-বিএনপি) নিজেদের মনে করেনা। তারা মনে করে এটা হিন্দুদের সংস্কৃতি। বাংলা ভাষাকেও তারা আমাদের ভাষা মনে করে না। তারা উর্দু ভাষাকে মনে করে আমাদের ভাষা। সেই সব লোক যখন আবার ক্ষমতায় এলো তখন দেশের অবস্থা যা হয়েছে সেটা থেকে আবার দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে।
- সংকটের মূল সমস্যা কোথায় এবং তা থেকে উত্তরণের পথ কি?
সৈয়দ হাসান ইমাম: এখন আমরা মনে করি দেশ একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এক সময় নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। সেই নতুন প্রজন্ম আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে এসেছে এবং এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। তবে সবকিছুই যে সফল হয়েছে তা না। যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম সে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে গড়ে তুলতে পারিনি। সেটা যাতে ভালভাবে গড়ে তোলা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
- ৭১ এ বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেদিনকার কিছু স্মৃতি যদি তুলে ধরেন।
সৈয়দ হাসান ইমাম: একাত্তর সালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ গঠন করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে। এর আহ্বায়ক ছিলাম আমি। ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমরা অনুষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। টেলিভিশন-রেডিওতে তাদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠান- এটা ছিল দারুণ-মানে শত্রুপক্ষের অস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা।
- আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দ সৈনিক। সেখানকার কিছু গল্প শুনতে চাই।
সৈয়দ হাসান ইমাম: ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নাটক ও কথিকা বিভাগের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করি। সে সময় জল্লাদের দরবার, চরমপত্র এসব অনুষ্ঠান দারুণ শ্রোতাপ্রিয় হয়। সে সময় সালেহ আহমেদ ছদ্মনামে খবর পাঠ করতাম। পরে যখন কামাল লোহানী আসলেন তখন তিনি সংবাদের দায়িত্বে গেলেন, আমি নাটক আর কথিকা বিভাগের দায়িত্ব পালন করি। সে সময় আমরা নাটক, কথিকা আর সংগীতের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করেছি। যারা হতাশার মধ্যে পড়েছিল তাদের মধ্যে দেশ স্বাধীন হবেই এমন বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছিলাম। সে সময় যে সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মীরা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম আমরা। আমাদের অনুষ্ঠানগুলো সারা বিশ্বে দেখানোর ব্যবস্থা করতাম। দেখাতাম পাকিস্তানিরা কিভাবে আমাদের ওপর অত্যাচার করছে। এগুলো বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা, জনমত বাড়ানো। এভাবেই চলে যেত সময়।
- মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আছে যা আপনাকে এখনও প্রেরণা দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়?
সৈয়দ হাসান ইমাম: নওগাঁ সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিংয়ের জন্য একটা ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেটার দায়িত্বে ছিলেন আবদুল জলিল, যিনি পরে আওয়ালীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি এখন প্রয়াত। রিক্রুটের পর সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বুটি ভাই (গাজীউল হকের ছোট ভাই) একদিন মুজিবনগরে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন অন্তত একবার ওই ক্যাম্পটা ঘুরে আসি। এতে মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হবেন। এটা মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের কথা।
আমি তখন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক বিভাগের প্রধান। সিনেমার নায়ক হিসেবে আমার একটা সু-পরিচিতি ছিল। একদিন বালুরঘাটের সেই ক্যাম্পে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন নায়ক জাফর ইকবাল। তিনিও এখন প্রয়াত। আমাদের তখন খুব অস্বচ্ছল অবস্থা। ক্যাম্পে কেবল এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বসে এক দুপুরে ডাল-ভাত আর পাপড় ভাজা খেলাম। সেদিন একটা ছেলেকে দেখিয়ে জলিল বললেন, ‘হাসান ভাই, ছেলেটিকে দেখে রাখুন। পরে ওর ঘটনা বলব।’ আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। গ্রামের সাধারণ একটা ছেলে। জলিল কেন তাকে দেখে রাখতে বললেন, ধারণাও করতে পারিনি। রাতে ঘটনাটি শুনে আমি শিঁউরে উঠেছিলাম।
নওগাঁর গা ঘেঁষে ভারতের সীমান্ত। পাকিস্তানি সেনারা যে পথ দিয়ে সেখানে আসবে, সেখানে একটা ছোট ব্রিজ ছিল। ক্যাম্প থেকে সিদ্ধান্ত হয়, ব্রিজটা উঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে গাড়ি নিয়ে ওই পথে আসতে পারবে না। তাদের প্রবেশ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলে আমরা আত্মরক্ষার সময় পাবো। ব্রিজ উঁড়িয়ে দেওয়ার আগে রেকি করতে হবে। মানে কখন, কিভাবে যাওয়া হবে, বিস্ফোরক বসানো হবে সে সবের পর্যবেক্ষণ। এ কাজে ছয়জনের একটি দল করে দেওয়া হলো। ব্রিজটি যে গ্রামে, ওই গ্রামের একটি ছেলে আবদার করল, তাকে যেন এই দলে নেওয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পের সবাই বলল, ‘তুই যে মুক্তিযুদ্ধে এসেছিস, সেটা সবাই জানে। তোর সঙ্গে আরও পাঁচটা ছেলেকে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে।’
রাজাকার, আলবদররা টের পেয়ে যাবে। রেকি করতে রাতে যেতে হবে, দিনের আগে ফিরতে হবে। ছেলেটি বলল, ‘রাতে ফিরতে সমস্যা হলে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবেন। মাকে আমার কথা বললেই হবে। ছয়জনের দলটি রাতের মধ্যে রেকি শেষ করতে পারল না। তারা ওই ছেলের বাড়িতে গেলো। ভোররাতের দিকে দরজায় ধাক্কা দিলে ছেলেটির মা-বাবা বেরিয়ে এলেন। পরিচয় দিতেই মা একটা ঘরে তাদের জন্য বিছানা করে দিলেন। দুপুরে তারা খাবে বলে রান্না চড়ালেন। এর মধ্যে ছেলেটির বাবা পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিলেন। তারা এসে ছেলেগুলোকে ঘুম থেকে তুলে উঠানে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলল। এই খবর চলে গেল ক্যাম্পে। সিদ্ধান্ত হলো, ছেলেটির বাবাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ছেলেটি বলল, ‘যেহেতু আমিই ওদের আমাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলাম, এই অপারেশন আমিই করতে চাই’। রাতের অন্ধকারে ছেলেটি তার বাড়িতে যায়। ছেলেকে দেখে মা তাকে জড়িয়ে ধরেন। বাবা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। ছেলে চাদরের নিচ থেকে স্টেনগান বের করে বাবাকে গুলি করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল।
ছেলেটির সঙ্গে পরে রাজশাহীতে আমার দেখা হয়। নামটা আজ মনে করতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার, আলবদরদের মন্ত্রী হতে দেখে, পতাকা লাগানো গাড়িতে চলাফেরা করতে দেখে ওই ছেলেটি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যায়।
- স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের প্রতি কি বলতে চান…
সৈয়দ হাসান ইমাম: নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা–মৌলবাদের বিরুদ্ধে জাগতে হবে। গোলাম আজমের বিচার দাবি করার কারণে যারা জাহানারা ইমামকে মামলা দিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় আসলে দেশের অবস্থা কি হবে তা সহজেই বোঝা যায়। এই বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা দরকার, বিজয়ের ৪৭তম বছরে পর্দাপণের সময়ে। কারণ এবার যারা সরকারে আসবে তারাই বিজয়ের ৫০ বছর পালন করবে। এমন সরকার আমরা চাই না যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের নিয়ে, জামাতকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পালন করুক। তরুণদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ মানুষের দেশ। কোন জানোয়ারের দেশ না। সে জন্য প্রথমেই নিজেদেরক মানুষ হতে হবে। সৎ হতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে।
সারাবাংলা/পিএ/পিএম
আরও পড়ুন :
আশায় আশায় বছর গেল
বিগ বসে সালমানের সঙ্গে শাহরুখ
অসম্পূর্ণ মানুষ শাহরুখ!
ভালো থাকার গল্প ‘একদিন ভালো থাকি’
‘ক্র্যাক প্লাটুন’ বীরপ্রতীক গাজীর সাহসিকতা নিয়ে টেলিছবি
‘বিজয়ের গল্প’ নিয়ে বিজয় দিবসের গান
আমজাদ হোসেনের সঙ্গে আমার বাজি ধরার কাহিনিটা
সিয়ামের হঠাৎ হলুদ, নতুন বছরে বিয়ে
ব্যাংককে সরকারি ছুটি, আমজাদ হোসেনের মরদেহ দেশে আনতে বিলম্ব
‘শরীরের ক্যান্সার দূর করা যায়, মনের ক্যান্সার দূর করা যায় না’
আরও দেখুন : একজন আমজাদ হোসেন [ভিডিও স্টোরি]