সালতামামি: ঢালিউড সাতকাহন- ২০১৮
২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৮:১৮
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
প্রতি নতুন বছর শুরু হয় ভালো থাকার প্রত্যাশা নিয়ে। তারপর যখন বছরটি শেষ হয় তখন হিসেব নিকেশ করতে বসেন সবাই। বছরটা কেমন গেল? ভালো না মন্দ? সফলতার পাল্লা ভারি নাকি হালকা? এরকম নানা প্রশ্ন এসে মনের কোনে নিঃশ্বাস ফেলে।
সফলতার কোন মাপকাঠি নেই। এটি আপেক্ষিক বিষয়। তবে কেউ কেউ সফলতার মাপকাঠি বলতে আত্মতৃপ্তিকে বোঝায়। আত্মতৃপ্তি মানুষ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পেয়ে থাকে। কেউ আছেন গল্প থেকে তৃপ্তি পান, কেউ আবার চলচ্চিত্রের বিনোদনের দিকটাই উপভোগ করেন। ২০১৮ সালে দেশে গল্প নির্ভর ও বিনোদনধর্মী- দুই ধরনের সিনেমাই নির্মিত হয়েছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির তথ্য মতে চলতি বছর দেশের প্রেক্ষাগৃহে সবমিলিয়ে ৫৬টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এরমধ্যে ৪টি যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবি (নূরজাহান, পাষাণ, স্বপ্নজাল, তুই শুধু আমার)। আর ১১টি আমদানিকৃত (জিও পাগলা, ইন্সপেক্টর নটি কে, চালবাজ, সুলতান, ভাইজান এলো রে, ফিদা , পিয়া রে, নাকাব, ভিলেন, গার্লফ্রেন্ড, আমি শুধু তোর হলাম) ।
‘পুত্র’ সিনেমা দিয়ে শুরু হওয়া বছর শেষ হয়েছে ‘অর্পিতা’র মাধ্যমে। মজার ব্যাপার হলো, শুরু আর শেষ- দুটো ছবিই গল্পনির্ভর। এর ভেতরে কিছু বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও বাণিজ্যিক ছবির সংখ্যা বেশি ছিল।
আরও পড়ুন : শীতের নিউইয়র্কে জেমস উত্তাপ
বাংলাদেশে বিষয়ভিত্তিক ছবির বাজার কোনকালেই ভালো ছিল না। তবে ‘দেবী’ সেই মিথ ভেঙেছে। সব সফলতা যে বাণিজ্যিক ছবি পেয়েছে তা নয়। বছরের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ছবি সাফলতা পায়নি।
- বাণিজ্যিক ছবি নয়, গল্পনির্ভর ছবির চর্চা শুরু
বাণিজ্যিক ছবির জন্য এই বছরটি তথৈবচ। কোন সিনেমা সেভাবে ব্যবসা করতে পারেনি। এমনকি শাকিব খানের ছবিও বছরজুড়ে দর্শক টানতে হিমশিম খেয়েছে। গত দুই দশক ধরে ঢালিউড শাকিব খানের যুযুধান হলেও এবছর তার ছবি আলো আঁধারির মাঝে অবস্থান করেছে। ৮টি ছবিতে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। এরমধ্যে একটি যৌথ প্রযোজনার, বাকি দুটি পশ্চিমবাংলার ছবি। দেশীয় প্রযোজনায় ৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। যা এই সুপারস্টারের ক্যারিয়ারের বিগত কয়েক বছরের চেয়ে কম সংখ্যক।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক এবং বুকিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এই ছবিগুলোর মধ্যে ‘ভাইজান এলো রে’ গাটের টাকা খরচ করে মানুষ দেখেছে। আরেক আমদানিকৃত সিনেমা ‘চালবাজ’ নিয়ে আলোচনা ছিল ভালোই। এই দুটি সিনেমাই দেশের নয়। শাকিব খান অভিনীত দেশের চলচ্চিত্রগুলোর ব্যবসা ছিল গড়পড়তা। কয়েকটি সিনেমা দর্শক শূন্যতায়ও ভুগেছে। মানে ফ্লপের খাতায় নাম লিখিয়েছে।
বাণিজ্যিক ছবির বাজার মন্দা গেলেও বিষয়ভিত্তিক গল্পনির্ভর ছবি তার জায়গা করে নিয়েছে। বছরের মাঝামঝি সময়ে ‘পোড়ামন ২’ মুক্তি পায়। মুক্তির পর সিনেমাটি নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহ দেখা যায়। এরপর অক্টোবরে পর পর দুই সপ্তাহে মুক্তি পায় দুটি গল্পনির্ভর সিনেমা। একটি ‘দহন’ অন্যটি ‘দেবী’। ছবি দুটি নিয়ে নজরকাড়া আগ্রহ ছিল মানুষের মধ্যে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বুকিং এজেন্ট সমিতির সভাপতি সারোয়ার আলী দীপুর মতে, ‘আলোচনায় থাকা আর লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসা এক নয়। এ বছর শুধু ‘পোড়ামন ২’ এবং ‘দেবী’ সিনেমার টাকা উঠে এসেছে। কারণ ছবি দুটির বজেট কম, তাই টাকাও উঠে এসেছে। শাকিব খানের ছবির বাজেট বেশি, লোকসান হলে কোটি ছাড়িয়ে যায়।’
এরকম ছবির মাধ্যমে পুরনো সস্তা একঘেয়েমি গল্পের কচুঁরিপানা সরে গিয়েছে অনেকখানি। সৃষ্টি হয়েছে বিকল্পধারা।
- ইন্ডাস্ট্রি পেল তিনমূর্তি
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি রায়হান রাফি, সিয়াম ও পূজা ম্যাজিক দেখেছে। এই তিনমূর্তি ২০১৮ সালে সিনেমার রুপালী মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। আবির্ভাবেই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। ওপরে উল্লেখিত ‘পোড়ামন ২’ ও ‘দহন’ ছবির পরিচালক রায়হান রাফি। তাতে কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে সিয়াম-পূজা অভিনয় করে সিনেমাপ্রেমীদের চোখের মণিতে পরিণত হয়েছেন।
ইন্ডাস্ট্রির অনেক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ত্রয়ীকে ধ্বংসস্তূপ থেকে গজানো নতুন চারা মনে করছেন। তিন তরুণ তুর্কিকে নিয়ে বড় বাজিটা ধরেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আব্দুল আজিজ তিনজনকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসালেন। বললেন, ‘পূজা এ বছরের এক নম্বর নায়িকা। তার দুটি ছবি হিট। সিয়ামও সেরা নায়কের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। ইন্ডাস্ট্রি রায়হান রাফির মতো পরিচালক পেয়েছে। ঢালিউডের জন্য এটা আশীর্বাদ।’
এদিকে পূজার যৌথ প্রযোজনার ‘নূরজাহান’ ছবি মুক্তি পেয়েছে চলতি বছরের প্রথম ধাপে। কলকাতার অদ্রিতের সঙ্গে তার রসায়ন সেভাবে জমেনি। ফলাফল, ছবিটি সেভাবে আলো ছড়াতে পারেনি।
- আমদানি সিনেমার আশাভঙ্গ
চলতি বছর ১১টি আমদানি করা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। দেশি ছবির সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করা হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের যুক্তি, এতে করে সিনেমা হল কিছুটা হলেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু দুঃসংবাদ হলো, আমদানি করা সিনেমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে প্রধাণ কারণ হিসেবে হল মালিকরা দেরিতে সেন্সর ছাড়পত্র দেয়াকে দায়ি করছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের দেশি কনটেন্ট নেই। থাকলে আমরা ভারতীয় বাংলা ছবি চালাবো না। দেশি সিনেমা দেবেন না, আবার সিনেমা আমদানি করলে নানা বাধার সৃষ্টি করবেন সেটা তো ঠিক না। এভাবে একের পর এক বাধা সৃষ্টি করলে সিনেমা হল বন্ধ হতে যাবে আরও। যদি পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বা কাছাকাছি কয়েকদিন পর সিনেমা মুক্তি দিলে সেটা দেখতে মানুষ প্রেক্ষাগৃহে আসতো।’
তিনি আরও জানান, দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে। একজন হল মালিক লোকসান দিয়ে কতোদিন আর সিনেমা হল টিকিয়ে রাখবেন! সিনেমা হল ভেঙে সেখানে শপিং মল করলে বরং সেখান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। তবুও যারা সিনেমাকে ভালোবেসে লোকসান দিয়ে সিনেমা হল টিকিয়ে রেখেছেন তাদের স্যালুট না জানালে অন্যায় হয়ে যাবে।
- সেরা পাঁচ সিনেমা
গত তিন বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা কমেছে। ২০১৫ সালে দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ৬৩টি, ২০১৬ সালে ৫৭টি এবং ২০১৭ সালে ৬৩টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। সিনেমার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে দেশের সিনেমা যে ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে সেটা অনেক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
আবার এতোগুলো ছবির মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ছবি নিয়ে আলোচনা হওয়া, দুটি ছবির লগ্নিকৃত টাকা ফেরত আসা ঘন অন্ধকারের আভাস দেয়।
তবে এ বছর দেশি ও আমদানি মিলিয়ে সেরা পাঁচ সিনেমার মধ্যে রয়েছে, ‘পোড়ামন ২’, ‘দেবী’, ‘দহন’, ‘ভাইজান এলো রে’, ‘সুলতান দ্যা সেভিয়র’। তবে কেউ কেউ আবার ‘চিটাগাইঙ্গা পোয়া, নোয়াখাইল্যা মাইয়া’ সিনেমাকে হিট বলছেন। ‘সুলতান’কে সেরা ছবির তালিকায় রাখছেন না। দেশিয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বক্স অফিস না থাকায় ব্যবসার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয় না। যার ফলে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা।
দেশের চলচ্চিত্রের পুরো বছরের সিনেমা বিষয়ে কয়েকজন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বর মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেই আশঙ্কা করছেন, ২০১৯ সালে আরও কম সিনেমা মুক্তি পাবে। সেই সাথে অনেক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সারাবাংলা/আরএসও/পিএ
আরও পড়ুন :
. বছর জুড়ে নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন
. চলচ্চিত্রশূণ্য শুক্রবারের প্রেক্ষাগৃহ
. পরিবেশের জন্য লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর দান
. নির্বাচনের টেলিছবি ‘খেলারামের খেলা’
. অন্ধকারেই থাকছে শাকিব-অপু’র ‘মাই ডার্লিং’
. বিয়ে করলেন মাইলি সাইরাস ও হেমসওয়ার্থ