স্মৃতির পাতায় মৃণাল সেন
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:৫৬
এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক ।।
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ীকে নিয়েই এ দিন আলোচনা চলছিল গলির মুখে। অমিতাভ বচ্চনের টুইটেও তিন জনের নাম। ‘ভুবন সোম’-এ ভয়েস ওভারের স্মৃতিচারণ। মৃণালের সমাজ সচেতন দৃষ্টিকোণ আর সপ্রশ্ন স্বভাবের কথা স্মরণ করেছেন শাবানা আজমি। নাসিরুদ্দিন শাহ লিখেছেন, যা বিশ্বাস করেছেন, একমাত্র সেটা নিয়েই ছবি করেছেন মৃণাল। শ্রীলা মজুমদার শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলে গেলেন, ‘আমার মতো রোগা, কালো চেহারার মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে খুব বেশি পরিচালক ভাবতেন না।’
ঘনিষ্ঠ জনেরা বলছিলেন, কয়েক মাস আগে মালায়লাম পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণন কত উৎসাহ নিয়ে মৃণালদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মৃণাল সেন তো শুধু বাংলা বা হিন্দির নন! ওড়িয়ায় ‘মাটির মনিষ’ বা প্রেমচন্দের কাহিনী অবলম্বনে তেলুগুতে ‘ওকা উরি কথা’ও তৈরী করেছেন। ফালকে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকারের জন্য এ দিন শোকবার্তায় মিলে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
ভবানীপুরে পদ্মপুকুরের বাড়িতে শায়িত দীর্ঘ অবয়বটির সামনে রোববার (৩০ ডিসেম্বর) তাই ঈষৎ থমকালেন প্রিয়জনেরা। স্নেহভাজন এক অভিনেত্রী এসে ‘মৃণালদা’র গালে হাত দিয়ে আদর করে গেলেন। বছরের শেষ রোববার সকাল চলচ্চিত্ররসিকদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনল। এ দিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন মৃণাল সেন।
তার দেহ আপাতত তপসিয়ায় ‘পিস ওয়র্ল্ড’-এ রাখা। শিকাগো থেকে পয়লা জানুয়ারি দেশে ফিরবেন তার ছেলে। এর পরেই ৯৫ বছরের প্রবীণ চলচ্চিত্রকারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
গত বছর জানুয়ারিতে স্ত্রী গীতা সেনের মৃত্যুর পরে খুবই একলা হয়ে পড়েছিলেন মৃণাল। তবে মোটের উপরে শরীর সুস্থই ছিল। গত কয়েক দশকের ছায়াসঙ্গী, চিকিৎসক অধৃষ্য কুমারের কথায়, ‘কয়েক বার পায়ের হাড় ভাঙা ছাড়া কোনও সমস্যা ছিল না। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিচ্ছু না। কিছুটা ঠান্ডা লেগেছিল। বয়সজনিত কারণেই চলে গেলেন।’
মৃণালের মৃত্যুপর্ব নিচু তারেই বাঁধা থাকল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তিম শ্রদ্ধা পছন্দ ছিল না মৃণালের। সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন এলেও বাড়িতে ঢোকেননি। পরিবারের সদস্যরা যা চাইবেন, তা-ই হবে বলে জানান তিনি। পরিবারও মৃণালের ইচ্ছানুযায়ী সরকার বা জনগণ, কারও শ্রদ্ধার্ঘ্যই গ্রহণ করবে না বলে চিকিৎসকের দাবি। অন্যথায় সরকার অবশ্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত। শোকবার্তায় এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল।’
তার সিনেমায় দ্রোহের চেনা মেজাজের মতোই এক ধরনের তারুণ্য ছুঁয়ে থাকত তাকে। একমাত্র পুত্র কুণাল সেন, বাবাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকতেন। সচরাচর কাউকে ‘কাকা-মামা’ বলে ডাকার বা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করারও অনুমতি দিতেন না তিনি।
দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল মৃণাল সেন অবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। পরিচালক এবং অভিনেতার সম্পর্ক। তা পেরিয়ে বন্ধুত্বের, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্ক।
মৃণালের চলে যাওয়ার দিনে বাকরুদ্ধ ছিলেন সৌমিত্র। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণায় বিদ্ধ সৌমিত্র বললেন, ‘৬০ বছরের সম্পর্ক আমাদের। বন্ধুত্ব তো বটেই। পারিবারিক সম্পর্ক। আমি অত্যন্ত মর্মাহত। আজ আর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
প্রথমেই আমার নায়ক হওয়ার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন মৃণাল সেন। লম্বা চুল কেটে দিলেন। তার পর তেল মাখিয়ে, রোগা চেহারায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দৌড় করালেন। দৌড়তে দৌড়তে মাঝে মাঝে পরিচালকের কথা শুনতে পারছি না। সে কথা বলতেই উনি রেগে বলে উঠলেন, ‘যা মনে হয়, সে রকম করো। ন্যাচারাল রিঅ্যাকশন।’ ছবির নাম ‘চালচিত্র’। মৃণাল সেনের সঙ্গে নিজের স্মৃতির কথা জানাচ্ছিলেন অঞ্জন দত্ত।
একুশ বছরের উঠতি, উচ্ছৃঙ্খল, পুরোদস্তুর অরাজনৈতিক, তার্কিক, ডেঁপো এক ছেলের সঙ্গে পঞ্চান্ন বছর বয়সি পৃথিবীখ্যাত পরিচালকের বন্ধুত্বের শুরু। বন্ধু কথাটা ভুল নয়। অজস্র তর্ক, ভালবাসায় কেটেছে সেই সব দিন। মৃণালের ছেলে কুনালও তাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকত। মৃণাল সেন আমার বন্ধু, শিক্ষক, পরিচালক, সহকর্মী, বাবার মতো অনেক কিছুই। এমনকি, বাবা যে স্বাধীনতা আমাকে দেননি, উনি সেটাও দিয়েছিলেন। আমাকে পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওখানে আমাকে মৃণাল বলবি। মৃণালদা একদম নয়!’
মৃণাল সেনের এক অদ্ভুত স্বভাবের কথা জনিয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক। মৃণাল সেনকে মৃণালবাবু বলে ডাকতেন রঞ্জিত মল্লিক। খুব সিগারেট খেতেন উনি। যখনই মুখে একটা সিগারেট ধরাতেন, যে সামনে আছে, তার কাছে দেশলাই চাইতেন। তার পর সেটা নিজের পকেটে রেখে দিতেন। সেও লজ্জায় আর চাইতে পারত না। আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘যখন বাড়ি ফিরি, পকেটে গোটা দশ-বারো দেশলাই!’
আরও একটা ঘটনা বলি, খুব শীতকাতুরে মানুষ ছিলেন। শীতকালে একদম স্নান করতে চাইতেন না। বৌদি বলতেন, ‘তুমি যদি স্নান না করো, তোমাকে আমি খেতে দেব না।’ একদিন মৃণালবাবুর বাড়িতে গিয়েছি। শুনছি বৌদি বলছেন, ‘শুনছো, তোমার স্নান হয়েছে?’ উত্তর দিলেন, ‘ক-ও-ও-বে’। এই কবে মানে কিন্তু অনেকক্ষণ আগে নয়! আসলে মানুষটা ছিলেন খুব মজাদার। ‘ফুল অফ লাইফ’ যাকে বলে। তবে বৌদি মারা যাওয়ার পরে ভেঙে পড়েছিলেন খুব।
বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে
সারাবাংলা/পিএ