‘বাংলার বুলবুল, যেখানেই যান, ভালো থাকেন যেন’
২২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:২৬
এন্টারটেইনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
দেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার সুর করা অসংখ্য জনপ্রিয় গান। দেশের প্রায় সব গুণী কণ্ঠশিল্পী গান করেছেন বুলবুলের সুরে। সেসব গুণীশিল্পীদের মধ্যে কনকচাঁপা অন্যতম। বুলবুলের সুর করা অনেক জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী তিনি।
জনপ্রিয় সেই গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে’, ‘সাগরের মতই গভীর, আকাশের মতই অসীম’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘আমার হৃদয় একটা আয়না’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’।
সংগীতের কারণেই কনকচাঁপা অনেক কাছ থেকে দেখেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। আর সেইসব স্মৃতি হাতরে কনকচাঁপা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আমাদের আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আসলে বাংলার বুলবুল। একাধারে তিনি ছিলেন শক্তিমান লেখক, সুরস্রষ্টা এবং মিউজিক কম্পোজার। গানের জগতে তিনি ছিলেন সব্যসাচী। সারাজীবন তিনি গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। আঞ্চলিক সুর থেকে শুরু করে আরব্য, পারস্য, ভারতীয়, স্পেনীয় সুর নিয়ে নাড়াচাড়া করে তার সাথে নিজের ভালবাসা মিশিয়ে সুরের আবহ তৈরি করেছেন।
তার গানে প্রেম, বিরহ, কটাক্ষ, অনুরাগ, দেশপ্রেম, শিশুর সারল্য, সামাজিক নাটকীয়তা, বিদ্রোহ, চাওয়ামাত্রই পাওয়া যেতো। তাই ছবির গানের ফরমায়েশি জগতে তার কদর ছিল আলাদা। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল নিজেই গান লিখতেন তাই সুর আরও সুন্দর করে বসে যেতো। মনে হত এই গানের সুর ও কথা একসাথেই জমজ হয়ে জন্ম নিয়েছে।
তিনি আসলে একজন স্বভাবকবি ছিলেন। মুখে মুখে গান বানানোর অসম্ভব দক্ষতা তার ছিল। একই সাথে নিজের সৃষ্টিকে অবহেলা করার দারুণ স্পর্ধাও ছিল। গান রেকর্ড হয়ে গেলে সে লেখা তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন। আমরা আপত্তি জানালে বলতেন আমার গান আমি কেনো সংগ্রহ করব। গান ভালো হলে কালের প্রবাহেই তা জমা থাকবে।
ব্যক্তিগত জীবনে বোহেমিয়ান টাইপ মানুষটা নিজের জন্য কিছুই করেন নাই। গান গান গান করেই জীবন পার করলেন। জীবনের প্রথম দিকে বেহালা-গিটার বাজাতেন, মাঝ বয়সে এসে সেগুলোকেই আবার নতুন করে শেখার জন্য কি প্রচেষ্টাই না ছিল তার। কিন্তু নিজেকে আরও জ্ঞানের গভীরে নিতে নিজেই নিজের শিক্ষক ছিলেন।
অসম্ভব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন তার গানেও অপার দেশপ্রেম, দ্রোহ, প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন।
ছবির গানেও তিনি নিজে বায়না করে দেশের গান ঢোকাতেন। ভালো কণ্ঠের জন্য তিনি শিল্পী খুঁজে বেড়াতেন আজীবন। আমাকে তিনিই নিজে খুঁজে বের করেছিলেন। ৯২ সালের কথা, একটা অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী শাকিলা আপা বললেন কনক, বুলবুল ভাই তোকে খুঁজছেন, তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কর। এর পর উনিই আবার ফোন দিলেন। পয়লা গান ছিল ‘‘সাদা কাগজ এই মনটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম’’। মিলু ভাইয়ের সাথে ডুয়েট। সেদিনই বুলবুল ভাই বললেন ভাবী, ইনশাআল্লাহ অনেক গান হবে, আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো যে কখনো পিছনে তাকাতে হবে না। সত্যিই সেদিন থেকেই আমার আর অবসর ছিল না। বুলবুল ভাই মাসে গড়ে প্রায় দশটা ছবি হাতে নিতেন এবং তার বেশির ভাগ গান আমাকে দিয়েই গাওয়াতেন। নিজে অনেক গবেষণা করতেন কিন্তু গানের কণ্ঠের ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে চাইতেন। এর পর আসলেই আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রায় প্রতিটি গানই মাইল ফলক হয়ে যাচ্ছিল। তার গানেই প্রায় সব পুরস্কার পাওয়া আমার। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কদিন আগে তিনি যখন অসুস্থ হলেন, খোঁজ নিতে ফোন দিলাম, তখন গানপাগল মানুষটা সব কথা বাদ দিয়ে বললেন ভাবি ‘‘অনেক সাধনার পরে আমি’’ গানটি ধরেন তো, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই আমার হাজবেন্ড বললেন গাও, আমি আরও বিপদে পড়তেই বুলবুল ভাই গানটি নিজেই শুরু করলেন। আমি তার সাথে গলা মিলিয়ে পুরো মুখটি গাইলাম। হঠাৎ উনি আমাকে অনেক দোয়া করলেন। আমি হচকচিয়ে গেলাম। এটাই আমার ওনার সাথে শেষ কথা।
পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওনার দোয়া পেয়ে গেলাম, সাথে পেলাম অসংখ্য অনবদ্য গান, যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কি দিয়ে আমি তার ঋণ শোধ করি আমি আসলেই জানিনা। আমার গাওয়া গান ‘‘প্রেমের তাজমহল’’ ওনাকে প্রথম বারের মত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির সম্মান এনে দিয়েছিল, এটা আমার একটি গর্বের অনুভব বটে।
আমি বিশ্বাস করি আমরা পুরো জাতিই ধন্য যে আমাদের একজন ‘‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’’ আছে। আর একটি কথা আমি উচ্চ কণ্ঠে বলতে চাই ‘‘সব কটা জানালা খুলে দাওনা’’ এই গানটি ছাড়া আর যদি কোন গানই সুর না করতেন তাহলেও বাংলাদেশ তার কাছে সমান কৃতজ্ঞ থাকতো।
আমি এই সব্যসাচী সংগীতজ্ঞের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি। আল্লাহ ওনাকে ওপারে শান্তি দিন।’
আজ (২২ জানুয়ারি) ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান দেশের বরেণ্য এই সুরস্রষ্টা।
সারাবাংলা/পিএ