সুচিত্রার যে চরিত্র তাদেরকে টানে
১৭ জানুয়ারি ২০১৮ ২০:১১
খায়রুল বাসার নির্ঝর
চোখে চোখে নির্নিমেষে প্রেম বিনিময়, অপাঙ্গে তাকিয়ে কটাক্ষ, প্রত্যাখ্যানে অশ্রুসজল, প্রতিরোধে দৃপ্ত… ক্যামেরার যে অ্যাঙ্গেল থেকে যে ভাবমূর্তিতেই আমরা তাকে দেখি না কেন, বুকের ভেতরের তোলপাড়টুকু উপেক্ষা করার সাধ্য নেই কারও। তিনি সুচিত্রা সেন। ১৭ জানুয়ারি ২০১৪, মহানায়িকার প্রস্থানের দিন।
নওশীন, নওশাবা, ভাবনা, প্রসূন ও ফারিয়া- এ পাঁচ নায়িকার কাছে সারাবাংলা প্রশ্ন রেখেছিলো, সুচিত্রা অভিনীত কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলে তারা কোনটা বেছে নেবেন?
নওশীন নাহরিন মৌ
প্রিয় চরিত্র:
‘দীপ জ্বেলে যাই’ চলচ্চিত্রের রাধা
রাধাকে যে রকম দেখেছি:
১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিতে রাধা একটি মানসিক হাসপাতালের নার্স। তার ভেতরে-চোখে-চেহারায় প্রচন্ড মায়া। ভালোবাসা-আদর-আন্তরিকতা দিয়ে সে জয় করে ফেলতে পারে সব। এমনকি সারিয়ে তুলতে পারে বিপর্যস্থ মানুষটিকেও। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার তার কাছেই অনুরোধ নিয়ে আসে, তীব্র মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী এলে। তবে ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে রাধাও যে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে না, তা নয়।
দীর্ঘদিন খুব কাছের মানুষের মতো, প্রেমিকার মতো সেবা করতে করতে মানুষটির প্রেমে হয়তো সেও পড়ে যায়। মায়ায় পড়ে যায়। কিন্তু সে জানে, তাকে এ মায়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে রোগীটি মানসিক সুস্থতা ফিরে পেলে। এই বাস্তবতা রাধাকে ভেতরে ভেতরে পোড়ায়।
কাজী নওশাবা আহমেদ
প্রিয় চরিত্র:
‘আঁধি’ চলচ্চিত্রের আরতি দেবী, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ চলচ্চিত্রের রাধা, ‘সাগরিকা’ চলচ্চিত্রের সাগরিকা, ‘শিল্পী’ চলচ্চিত্রের অঞ্জনা, ‘দেবী চৌধুরানী’ চলচ্চিত্রের প্রফুল্লমুখী
সাগরিকাকে যে রকম দেখেছি:
পঞ্চাশের দশকে এক ধনী নারী, তদুপরি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, বিশাল এক বাড়িতে একাই থাকেন। তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। সেইসঙ্গে আবার প্রেমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। সাগরিকা চরিত্রটি সুচিত্রা সেন অভিনীত অন্য চরিত্রগুলো থেকে বেশ খানিকটা আলাদা।
অঞ্জনাকে যে রকম দেখেছি:
ভীষণ উচ্ছ্বল। অনেকটা বাচ্চামো লুকিয়ে আছে কথায়, আচরণে। অঞ্জনার মুখে ‘লক্ষ্মীটি’ সংলাপ আজও ধরা দেয় পরম প্রেমের এক্সপ্রেশন হয়ে। ধনী পরিবারের সন্তান সে। প্রেম হয় তাদেরই বাসায় আশ্রিত ধীমানের সঙ্গে। প্রেম, সংকট এই সরল মেয়েটিকে অনেকটা পাল্টে দেয়।
‘সাগরিকা’ ও ‘শিল্পী’ একই বছর মুক্তি পায়, ১৯৫৬ সালে।
আশনা হাবিব ভাবনা
প্রিয় চরিত্র:
‘সপ্তপদী’ চলচ্চিত্রের রিনা ব্রাউন, ‘হসপিটাল’ চলচ্চিত্রের শর্বরী, ‘চম্পাকলি’ চলচ্চিত্রের চম্পাকলি, ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রের পারু, ‘ইন্দ্রাণী’ চলচ্চিত্রের ইন্দ্রাণী
শর্বরীকে যে রকম দেখেছি:
একজন মধ্যবিত্ত একা মা। সিঙ্গেল মাদার। খুবই প্যাশনেট এবং দায়িত্বশীল এই চরিত্রটি যাকে ভালোবাসতো, তার কাছ থেকে সে পেয়েছে বেদনা। আর পেয়েছে সন্তান। অথচ এই সন্তানটিকে লোকলজ্জার ভয়ে স্বীকারই করতে চায়নি শর্বরীর প্রেমিক। শর্বরীও চায়নি অ্যাবরশন। সন্তানটিকে নিজের পরিচয়ে বড় করার চ্যালেঞ্জ নেয় শর্বরী। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘হসপিটাল’।
ইন্দ্রাণীকে যে রকম দেখেছি:
‘হসপিটাল’-এর দু’বছর আগের ছবি ‘ইন্দ্রাণী’। অনেকটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এ চরিত্রটিও মননে এবং মানসিকতায় আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীনচেতা। যে কোনোভাবে অক্ষুণ্ন রাখতে চায় নিজের চাওয়া। আপন হাতেই গড়তে চায় নিজের ভাগ্য। উত্তম কুমার, মানে ছবির সুদর্শন দত্তের সঙ্গে তার প্রেমটা হয়, পরিবারের অমতে তাকে বিয়েও করে। কিন্তু বিয়ের পর দেখা দেয় দু’জনের ইগোর দ্বন্দ্ব।
প্রসূন আজাদ
প্রিয় চরিত্র:
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চলচ্চিত্রের রমলা
রমলাকে যে রকম দেখেছি:
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপের মতো রমলা চরিত্রটি ‘বাত্তিওয়ালা মাইয়া’। মানে, এনলাইটেনড, আলোকপ্রাপ্ত। হঠাৎ বেকার হয়ে পড়া এবং অনেকটা আলসে বাবার চক্করে পড়ে স্বপরিবারে রমলাদের ঠাঁই হয় একটি মেসবাড়িতে। ছেলেদের মেসবাড়িতে হঠাৎ একটি পরিবার, বিশেষ করে রমলার মতো সুন্দরী; অনেকেই তাদেরকে রাখতে অমত করলেও বাকিদের সমর্থনে রমলারা সেখানেই রয়ে যায়।
ছবির নায়ক, উত্তম কুমার মানে রামপ্রীতি তার সঙ্গে প্রথমে রমলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও অনতিবিলম্বে তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায় এবং মদনের মারফত চিঠি চালাচালি শুরু করে।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ কমেডি ঘরানার ছবি। মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। বলে রাখা ভালো, এটি উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটির প্রথম ছবি।
শবনম ফারিয়া
প্রিয় চরিত্র:
‘সপ্তপদী’ চলচ্চিত্রের রিনা ব্রাউন
রিনাকে যে রকম দেখেছি:
রিনা ব্রাউন সুন্দরী এবং মেধাবী ক্রিশ্চিয়ান মেয়ে। দুই বিপরীত ধর্মের তরুণ হৃদয়ের প্রেমের উপাখ্যান এটি। দু’জনই মেডিকেলে পড়ে। স্বভাবতই প্রথমে রিনা ব্রাউন অপছন্দ করতো নেটিভ বাঙালি কৃষ্ণেন্দুকে। কিন্তু ধীরে ধীরে কাছে আসে তারা, ভালবাসে পরস্পরকে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে রিনার বাবা শর্ত জুড়ে দেয় কৃষ্ণেন্দুকে ক্রিশ্চিয়ান হতে হবে। কৃষ্ণেন্দু ধর্ম বদলায়। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর পিতা রিনার কাছে হাতজোড় করে তাকে ফিরিয়ে দিতে। রিনা তাই করে।
বহু বছর পর রিনার সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুর দেখা হয় মিলিটারি হসপিটালে। রিনা তখন মদ্যপায়ী এবং উচ্ছৃঙ্খল এক তরুণী, যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে নাস্তিক কৃষ্ণেন্দু ঈশ্বরের মাঝে খুঁজে পেয়েছে প্রশান্তি।
‘ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়’ মূলত এ লেসনই দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ‘সপ্তপদী’র এন্ডিং সিনে। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে।
সারাবাংলা/কেবিএন