Saturday 13 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাজল ইব্রাহীম: ৩৫ বছর পর মীরা’র বেশে প্রত্যাবর্তন


৮ এপ্রিল ২০১৯ ১৯:৩৯ | আপডেট: ৯ এপ্রিল ২০১৯ ১২:৩২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাজল ইব্রাহীম – একসময়কার মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো কত্থক নৃত্যশিল্পী।

‘একসময়কার’ বলছি কেন? কারণ – একটাই। ষাটের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি ছিলেন বাংলাদেশের নৃত্য জগতের একজন প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী। পেয়েছেন একের পর এক স্বীকৃতি। ১৯৭৫-এ প্রবর্তিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নৃত্যশিল্পী। বয়স তখন মাত্র ২২। ১৯৬৪ সালে তার নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।

যার ঝুলিতে এতকিছু সেই তিনিই কিনা আশির দশকের মাঝামাঝি এসে সরে দাঁড়ালেন নাচের জগত থেকে। চিরচেনা সেই মঞ্চ ছেড়ে অনেক বছর কাটিয়ে দিলেন নিভৃতে। খুলে রাখলেন প্রিয় ঘুঙুর। কিন্ত কেন? একান্তই অভিমানে নাকি দায়িত্ববোধের তাগিদে?

বিজ্ঞাপন

কিন্তু চাইলেই কি সরে থাকা যায়? যার অস্তিত্বে চেতনায় শুধুই শিল্পসত্বা। রক্তে যার নৃত্যঝংকার। যিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন শুধুই নৃত্যচর্চায়, তিনি কি করে সরে থাকবেন নৃত্যপিপাসুদের কাছ থেকে। পারলেন না। আবারও ফিরে এলেন সেই চিরচেনা নৃত্যভুমিতে। খুলে রাখা প্রিয় ঘুঙুরগুলো আবার বেজে উঠছে চক্কর ও তাতকারের বোলে। ফিরলেন মঞ্চে। এক আধ্যাত্মিক নারীর জীবনালেখ্য নিয়ে। এক মহীয়সীর ভূমিকায় আরেক মহীয়সী।

আগামী ১৩ এপ্রিল যাকে মীরার বেশে আবার দেখা যাবে মঞ্চে।

আসুন তার উত্থান, বিরতি ও প্রত্যাবর্তনের গল্প শুনি …

  • ৩৫ বছরের দীর্ঘ বিরতি …

আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে সবসময় ছিলাম। ৩৫টা বছর, আমি হয়তো দর্শকের সামনে আসতে পারিনি, কিন্তু পেছনে ছিলাম। তার কারণ হচ্ছে, আমার জুনিয়র কিছু শিল্পী – নীপা, শিবলী, ডলি, এদের কথা বলতেই হবে। এরা সবসময় আমাকে বলতো যে, কিছু না কিছু একটা করো। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েকে বড় করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে, আমার এখন প্রথম কাজ হচ্ছে ওদের বড় করা। যার জন্য মঞ্চে বা টিভিতে পারফর্ম করতে পারিনি। টিভিতে শেষ অনুষ্ঠান করেছিলাম আমার ছেলের বয়স যখন ছ’মাস। প্রোগ্রামটা করার পর নিজেকে নিজে দেখলাম। মনে হল আমি বেশ মুটিয়ে গেছি। তখনই ভাবলাম আমার এখানেই ইতি টানা উচিত। আর সেটাই ছিল আমার ভুল সিদ্ধান্ত। একবারও ভাবলাম না যে একটু প্র্যাকটিস করলেই আমি আমার ফিটনেস আবার ফিরে পেতাম। নিজেকে আবার তৈরি করতে পারতাম। যাইহোক সেজন্য যে খুব কষ্ট পেয়েছি, তা নয়। কারণ এটার বদলে আমি যেটা পেয়েছি সেটা হলো আমার চমৎকার একটা সংসার। আমার বাচ্চাদের বড় করেছি। প্রত্যেকের ভালবাসা পেয়েছি। এটা আমার বিরাট পাওয়া। যা হয়তো অনেকের ভাগ্যে হয়না। তাই সরে থাকায় একেবারেই ব্যাথিত নই।

  • বিরতি ভেঙ্গে আবার মঞ্চে …

মনের ভেতরে কোথায় যেন আমার নাচ লুকিয়ে ছিল। সেটা করতে না পারার ব্যাথা তো থাকবেই। আমার গত জন্মদিনের আগে আমার মা (বদরুন্নেসা আব্দুল্লাহ – যিনি একসময় বিটিভি’র প্রযোজক ছিলেন) সহ কলকাতায় গিয়েছিলাম। মায়ের সঙ্গে জন্মদিন পালন করলাম। ওখানে সুকল্যাণ ছিল। সুকল্যাণ ভট্টাচার্য – কানাডা প্রবাসী বিখ্যাত ভারতীয় কোরিওগ্রাফার। এর আগে ও যখনই ঢাকায় আসতো আমাকে শুধু বলতো দিদি তুমি নাচ নিয়ে কিছু একটা করো। ও চেয়েছিল আমাকে দিয়ে চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যটা করাতে। যেখানে আমি চন্ডালিকার মা, আর নীপা (শামীম আরা নীপা) চন্ডালিকার ভূমিকায় থাকবে। কলকাতায় সুকল্যাণ আবার এ প্রসঙ্গ তুলে আমাকে অনুরোধ করলো। ও যে আমাকে খুব ভালো জানে তা নয়, কিন্তু আমার প্রতি ওর যে আন্তরিকতা, আমি সেটাতে মুগ্ধ। আর যখন সে আমাকে মীরার গল্পটা বললো, তখন আমার মনে হল, এই বয়সে হয়তো আমি এটা করতে পারি। মীরার যে আধ্যাত্মিক প্রেম, সেটাকে ভালবেসে, শ্রদ্ধা রেখে, সেই চরিত্রটা আমি করতে পারি। সর্বোপরি সুকল্যাণের কাজের প্রতি আমার ভীষণ ভাললাগা রয়েছে। প্রতিটা কাজে কত্থক, মনিপুরী ভরতনাট্যম সবগুলো মাধ্যমের মিশ্রনে এতো বৈচিত্র্য রেখে কাজ করে যে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। ভীষণ মেধাবী একজন কোরিওগ্রাফার। মীরা নৃত্যনাট্যের স্ক্রীপ্টটা সে এমনভাবে করেছে, যেটা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি মীরাতে কাজ করবো। আমি মঞ্চে ফিরবো, আবার আমার ক্ষেত্রে, আমার নাচের জগতে কাজ করবো।

  • বিরতি কি সংসারের কথা ভেবেই …

অনেকটা। আমার তিনটা ছেলেমেয়েই আমার সঙ্গে এতো বেশি ঘনিষ্ট যে, মা ছাড়া তারা কিছুই বোঝেনা। আর সেই সময়টা আমি যখন টিভিতে কোন অনুষ্ঠান করতে যেতাম, তখন দীর্ঘ সময় ধরে রিহার্সাল হতো। প্রায় এক সপ্তাহ সময় ধরে রেকর্ডিং হতো। আমি দেখলাম, রেকর্ডিংয়ের সেই সপ্তাহটাতেই স্কুলে আমার ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট খুব খারাপ হতো। যেটা আমাকে কষ্ট দিতো। আমি ওদের সময় দিলে রেজাল্ট বেশ ভালো, আর সময় দিতে না পারলে ওরা পিছিয়ে পরছে। আমি চিন্তা করলাম, আমার নাচটার চাইতেও বাচ্চাদের পড়াশুনাটা অনেক বেশী জরুরি। নাচ করতে গিয়ে আমি আমার এডুকেশনটা পুরোপুরি করতে পারিনি। সেই কষ্টটা আমার ছিল। তাই ছেলেমেয়ের এডুকেশানে কোন ব্যাঘাত ঘটুক সেটা চাইনি।

  • কিন্তু এ সিদ্ধান্তে নিজের শিল্পীস্বত্বাকে কি বঞ্চিত করা হলনা? …

আমি আসলে যখন যে কাজটা করি, সেটাতে পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে নিজেকে সঁপে দিয়ে করি। যখন নাচ করতাম, তখন শুধু নাচ নিয়েই সারাদিন কাটতো। যার ফলে আমার লেখাপড়াটা তেমন এগোয়নি। আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা জন্মাবার পর আমি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। কিন্তু যাইনি। আগে সন্তান, পরিবার, তারপর বাকিসব। তবে একটু দুঃখ যে, এতটা সময় বিরতি দিয়ে দিয়েছি। আমি যখন কোনো নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাই, তখন নাচে কোনোরকম ভুল দেখলেই ইচ্ছা করে গিয়ে ঠিক করে দিই। মনে হয় ওদের চেয়ে আমি আবেগটা আরো বেশি দিতে পারতাম। যাহোক আবার ফিরে আসছি। যদিও এটা আমার শেষ জীবন। এই শেষ জীবনে যদি ভালো কিছু করতে পারি, নতুন প্রজন্ম আমাকে জানবে, আর এটাই আমার প্রাপ্তি।

  • শুরুর গল্প …

আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, আমার মা তখন বুলবুল একাডেমীতে রবীন্দ্রসংগীত শিখতেন আতিকুল ইসলাম স্যারের কাছে। ক্লাসে মা সবসময় আমাকে তার পাশেই বসিয়ে রাখতেন। কিন্তু মা যখন গান শেখায় মগ্ন থাকতেন, আমি আস্তে করে উঠে গিয়ে যেখানে নাচের ক্লাস হতো, সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন সেখানে নাচ শেখাতেন জি এ মান্নান স্যার, রাইসা খানম ঝুনু আপা। আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উনাদের নাচ দেখে নিজে নিজে তোলার চেষ্টা করতাম। একদিন আমার এই নাচ তোলার ব্যাপারটা দেখে ফেললেন ডালিয়া নিলুফার, ঝুনু আপা আর লায়লা আপা। উনারা আমাকে কোলে করে মার কাছে নিয়ে আসলেন। বললেন, খালা আপনি ওকে নাচে দেন। মা চেয়েছিলেন আমাকে গানে দিতে। কিন্তু আমার আগ্রহের কথা শুনে নাচে ভর্তি করে দিলেন। আমার হাতেখড়ি হল জি এ মান্নান স্যার ও রাইসা খানম ঝুনু আপার কাছে। এটা ১৯৫৯ বা ৬০ সালের দিকে।  প্রথম বছরই আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে যখন সেকেন্ড ইয়ারে গেলাম ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে। মজার বিষয় হচ্ছে প্র্যাক্টিক্যালে ১০০ মার্কস পেলেও থিয়োরিতে পেয়েছিলাম শূন্য। থিয়োরি মানে নাচের ইতিহাস মুখস্থ করতে আমার ভালো লাগতোনা। এরপর আমার যখন ৮/৯ বছর বয়স, ততদিনে আমার নাচের মৌলিক শিক্ষাটা হয়ে গেলো। তখন বাফাতে মনিপুরী নাচ শেখাতেন বাবুরাম সিং, কত্থকে সমর ভট্টাচার্য এবং ফোক শেখাতেন জি এ মান্নান স্যার। আমি দেখলাম আমার মনটা কত্থক নৃত্যে। আমার মধ্যে সেই স্পীডটা ছিল, আমি যখন কত্থকে তাতকার করতাম, আমার সঙ্গে অন্য মেয়েরা পেরে উঠতোনা। তখন মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে কত্থক শেখাবেন। উনি কত্থক গুরু সমর ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করলেন, আমাকে বাড়িতে নাচ প্রশিক্ষণ দেয়ার। উনি সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে এসে আমাকে কত্থক শেখাতেন। সেই শুরু, আজও কত্থক নিয়েই আছি। আমার বয়স যখন ১৫, সেই সময়টা রোজি আপার চিত্রাঙ্গদা করার কথা ছিল। কোন কারনে উনি পারলেন না। ঝুনু আপাও করলেন না। তখন আতিক ভাই আমাকে বললেন, তুমি একবার করে দেখাও তো। আমি তখন ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে যে বাজায় বাঁশী’ গানটাতে নেচে দেখালাম। আমাকে সিলেক্ট করলো। আমি ভাবতেও পারিনি যে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি কত্থক থেকে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে সুযোগ দেয়া হবে। তখন চিত্রাঙ্গদার কুরুপা ও সুরুপা দুটো চরিত্রই আমি একাই করলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই চিত্রাঙ্গদা দেখেই আমার বর তারেক ইব্রাহীম আমাকে ভালবেসে ফেলেন এবং তার নয় বছর পর আমরা বিয়ে করে সংসার শুরু করি। আগে আমার নাম ছিল কাজল মাহমুদ। বিয়ের পর হয়ে যাই কাজল ইব্রাহীম।

  • প্রাপ্তি …

আমি যেখানেই নেচেছি, প্রশংসা কুড়িয়েছি। পুরস্কৃত হয়েছি, পেয়েছি অসংখ্য গোল্ড মেডেল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার দেয়া হল সেখানে আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসি রহমান, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, কেরামত মাওলার মতো বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে আমিও নির্বাচিত হয়েছিলাম জাতীয় পুরস্কারের জন্য। সত্যি আমি ভীষণ গর্বিত যে, এতো বড় মাপের ব্যাক্তিত্বদের সঙ্গে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র শিল্পী নাচের জন্য পুরস্কৃত হয়েছি। ১৫ বছর বয়স থেকেই আমি কোরিওগ্রাফি করতে পারতাম। আমার নিজের নাচ আমি নিজেই কম্পোজ করতাম। অনেকগুলো নৃত্যনাট্য করেছি, তার মধ্যে চিত্রাঙ্গদা, যেটাতে আমার গুরু বাবুরাম সিং শুধু অর্জুনের অংশটুকু কম্পোজ করেছিলেন। বাকি পুরো নৃত্যনাট্যটাই আমি কম্পোজ করেছি। এরপর বাদল বরিষণে, হাজার তারে বীণা সহ আরো বেশকিছু নৃত্যনাট্য আমার কম্পোজ করা।

  • সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীরা …

আমার সময়ে ছিলেন লুবনা মারিয়াম। সে তো নাচের উপরে গবেষণা করে। যেটা আমি করতে পারিনি। খুব আশা ছিল, কিন্তু হয়ে উঠেনি। লুবনা করছে, কারণ ওর মধ্যে সে সাহসটুকু আছে। কান্তা জামিল ছিল। সেও চমৎকার কত্থক নাচতো। জিনাত বরকতুল্লাহ। ও বাফাতে আমার পরে ভর্তি হয়েছিল। ডালিয়া সালাউদ্দিন, লায়লা রফিক, নাজমা কামাল- এরাও ছিল। কিন্তু ওরা ততটা স্কোপ পায়নি, যতটা আমি পেয়েছিলাম। ওরাও কত্থক নাচতো, কিন্তু ওদের নামটা ততটা প্রচার হয়নি। আরেকজন ছিলেন দুলাল তালুকদার, যাকে আমরা বলতাম সবে ধন নীলমণি। আমির হোসেন বাবু ছিল। যে পরে শাস্ত্রীয় নৃত্য থেকে সরে গিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলো। একবার এক কোনায় দেখলাম ডলি (ডলি ইকবাল) দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা ছিপছিপে গড়ন তার। তাকে ডেকে বললাম, তুই নাচ শেখ। ঝুনু আপার হাতেই হাতে খড়ি হলো ওর। চিত্রাঙ্গদা পুরোটাই আমি ওকে শেখালাম।

  • গুরু পরম্পরা …

আমরা দেখেছি কলকাতায় যখন নাচ শিখতে যায়, গুরুর হাতে একটা চিহ্ন দিয়ে দেয়। আমাদের সেটা ছিলনা। কিন্তু নাচের আগে আমরা গুরুদের প্রণাম করতাম। অনুষ্ঠান শুরুর আগে মঞ্চকে প্রণাম করতাম। এখনো এটা আছে। বিশেষ করে শিবলীর (শিবলী মহম্মদ) কথা বলবো। সে তার ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছে শুধু নিজের গুরু নয়, অন্য সব গুরুদেরকেও দেখা মাত্র প্রণাম করতে হবে। ঝুনু আপা (রাইসা খানম ঝুনু) ছিলেন আমার গুরু। উনাকে আদর করে আমি মুটু বলে ডাকতাম। কিন্তু নাচের সময় উনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। আমি মনে করি এই প্রথাটা সবসময় থাকা উচিত। বিশেষ করে আজকালকার ছেলেমেয়েদের এটা শেখানো উচিত যে, তোমরা যদি গুরুকে শ্রদ্ধা করো, সম্মান করো, তাহলে গুরু তোমাদের আরো অনেক বেশী ঢেলে শেখাবেন। যদি না করো, গুরু মনে মনে কষ্ট পাবেন, তার মনে তোমাকে নিয়ে একটা ব্যাথা থেকে যাবে। যেটা তোমার এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

  • সেকাল-একাল …

নাচের ক্ষেত্রে তো বিরাট পার্থক্য। তুলনাই হয়না। আমি কত্থক করতাম। কিন্তু এখন শিবলীরা যেটা করে সেটা অনেক বেশী নিখুঁত। ওদের ঘোরা বা হাতের কাজগুলো অনেক সুন্দর। আমার তাতকার এবং চক্কর নিখুঁত ছিল। কিন্তু হাতের কাজগুলো যেগুলো তৎকালীন গুরুরা আমাদের শিখিয়েছিলেন, সেগুলোকে অতটা সুন্দর বলা যাবেনা। যতটা সুন্দর এখনকার কত্থক নৃত্যশিল্পীরা করছে। আমাদের সময়ে কত্থকে শুধু তাতকার ও চক্করকেই প্রাধান্য দেয়া হতো। চক্কর দেয়ার সময় শুধু চক্করই দিতাম। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা চক্করেও কতরকম ভ্যারিয়েশন যে করে, ভাবাই যায় না। আমি মনে করি, এখনকার কত্থক অনেক বেশী উন্নত, সমৃদ্ধ।

  • এ প্রজন্মের স্টার হওয়ার প্রবনতা …

আমাদের সময়ে এটা ছিলনা। তখন টিভিতে তারাই শুধু নাচ করতে পারতো, যারা খুবই উচ্চ পর্যায়ের নৃত্যশিল্পী ছিল। আমরা যখন বাফাতে নাচ করতাম, তখন কোনো অনুষ্ঠান থাকলে আমরা মাসের পর মাস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিহার্সাল করতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নিখুঁত না হতো, ততক্ষন ধরে রিহার্সাল চলতো। কিন্তু এখন খুবই কমার্শিয়াল। এর এখানে প্রোগ্রাম তো ওর ওখানে প্রোগ্রাম, ভীষণ ব্যস্ত, রিহার্সাল করবে কখন। আমি এই সময়ের প্রত্যেকটা নৃত্যশিল্পীদের বলবো, তোমরা আগে নাচটা ভালো করে শিখো। গুরুদের দিকে তাকাও। গুরুরা কিভাবে শেখাচ্ছে। সেটা ভালো ভাবে রপ্ত করো। তারপর পারফরমেন্স করো। এখন টিভি চ্যানেলগুলোতেও ওয়েস্টার্ন নাচকে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে। ওয়েস্টার্নকে আপত্তি করছিনা। কিন্তু আমার দেশীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নয়। সেটাকে ভুলে গেলে হবেনা। আগে নিজের সংস্কৃতি, তারপর অন্যসব। যদি নৃত্যশিল্পী হতে চাও, তাহলে তোমার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চা থাকতেই হবে। এরপর কন্টেম্পরারী বা যা কিছুই করো, তাতে তোমার সূক্ষ্মতা থাকবে।

  • মীরা প্রসঙ্গে …

আমাকে যখন মীরার চরিত্রটা করতে বলেছিল, তখন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এতো বছর পরে একটা প্রধান চরিত্রে নাচ করবো। আমার সবসময় একটা ইচ্ছে ছিল, যেটা বলতে পারতাম না কাউকে, সেটা হলো আমি একটা কিছু করতে চাই। নীপাকে (শামীম আরা নীপা) বলতাম, তুই যে মাঝেমধ্যে আমাকে সবসময় ছাত্রছাত্রী পাঠাচ্ছিস, ওদেরকে তো আমি নাচ তুলে দিচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে নাচতে চাই। নীপা বলতো, কাজল আপা আমি তোমাকে নাচ করাবোই। তখন আমাদের একটা আইডিয়া ছিল যে, আমি যতগুলো কোরিওগ্রাফি করেছিলাম, সেগুলো সব এক করে মঞ্চে একটা অনুষ্ঠান করবো। সঙ্গে নতুন কিছু। তো এরমধ্যে হঠাৎ করেই সুকল্যাণের প্রস্তাবটা চলে আসলো। আমি আবার উৎসাহিত হলাম। একটু দ্বিধা ছিল যে, এতো বছর পরে নাচবো, আমার পরিবারের সবাই কি বলবে। কিন্তু বাসায় বলার পর ওদের যে উৎসাহ দেখলাম, ওটাতে আমাকে আরো উৎসাহিত করলো। মীরা চরিত্রটা নিয়ে আমি চিন্তা করেছি অনেক। এটা নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছি। গুগলে মীরা নিয়ে যত কাজ রয়েছে, সবগুলো বারবার দেখেছি। কারণ আমি জানতে চেয়েছি যে আমার চরিত্রটা কি হতে পারে। আমার এই বিশ্বাসটা জন্মে গেছে যে, আমি চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পারবো। আমি যেটা করবো, সেটা ভালোই করবো।

  • মীরা নৃত্যনাট্যে দর্শকের প্রত্যাশা পূরন …

শতভাগ। একটা প্রোডাকশন নামছে। সুকল্যাণ বেশ কয়েকদিন ধরে আমাদের নিয়ে কাজ করলো। এখানে রাধাকৃষ্ণের যে চরিত্র, সেখানে রাধা শামীম আরা নীপা আর কৃষ্ণ সুকল্যাণ নিজেই। দর্শক দেখে খুবই আনন্দ পাবে। সম্রাট আকবর ও আয়ান ঘোষ দুটো চরিত্রেই শিবলী মহম্মদ। এই দুটো চরিত্রই ভিন্ন। আর এই দুটোর মধ্যে যে পার্থক্য শিবলী ফুটিয়ে তুলেছে, সেটা অতুলনীয়।

  • দর্শকদের প্রতি …

দর্শকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা ভালো নাচ দেখেন এবং সেটা মূল্যায়ন করেন। তাদেরকে সাহায্য করেন, তারা যেন এগিয়ে যেতে পারে। তারা যেন নতুন কিছু করতে পারে। আর সরকারের কাছে অনুরোধ, নৃত্যশিল্পীদের বঞ্চিত করবেন না।

সবশেষে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না কাজল ইব্রাহীম। আবেগতারিত হয়ে বললেন, আমি ভীষণ খুশী। স্রষ্টা আমাকে প্রচুর দিয়েছেন। সবার মধ্যে কিছু না কিছু কষ্ট থাকেই। সেটা হয়তো রয়েছে, তারপরও আমি সুখি। আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি যে, আমি আবার ফিরে আসতে পেরেছি। আমি ভীষণ উৎসাহিত। জানি না কতটা দিতে পারবো দর্শককে। তবে এটা বলতে পারি, দর্শকরা আমার কাজ দেখে কষ্ট পাবেন না। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা সবার জন্য …

সারাবাংলা/এএসজি/পিএম


আরও পড়ুন :  মীরা: নতুন নৃত্যনাট্যে নৃত্যাঞ্চল


বিজ্ঞাপন

বেনাপোলে ট্রাকের চাপায় কিশোর নিহত
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:৩৮

চলে গেলেন সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:১১

আরো

সম্পর্কিত খবর