‘নোলক’ বিতর্কে স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ পরিচালক সমিতি!
৪ মে ২০১৯ ১৭:২৭
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ
পূর্বাভাস
পরিচালকদের স্বার্থ রক্ষার্থে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি কাজ করবে দ্ব্যার্থহীনভাবে—এমনটাই সংগঠনটির মূলনীতি। কিন্তু বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র পরিচালকদের এই সংগঠনটি আদৌ কি পরিচালকদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে? ‘নোলক’ ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক পরিচালক প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন পরিচালক সমিতির ভূমিকা নিয়ে। কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন পরিচালক সমিতির কর্মকর্তাদের।
ঘটনার সূত্রপাত
২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর রাজধানীর এক অভিজাত রেস্তোঁরায় জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নোলক’ নামের ছবির নাম ঘোষণা করা হয়। সেসময় ছবির পরিচালক হিসেবে ছোট পর্দার নির্মাতা রাশেদ রাহাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আর প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে সাকিব ইরতেজা চৌধুরীর।
ছবির প্রধান দুই চরিত্র শাকিব খান ও ববি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নতুন পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে আসার জন্য তাকে বাহবাও দেন শাকিব খান। এরপর একই বছরের ১ ডিসেম্বর ভারতের রামুজি ফিল্ম সিটিতে টানা ২৮ দিন শুটিং করার পর দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ছবির পরিচালক ও প্রযোজকের মধ্যে। প্রযোজককে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ছবির কাজ ঠিকমতো না করার অভিযোগ এনে রাশেদ রাহাকে পরিচালকের চেয়ার থেকে সরিয়ে প্রযোজক সাকিব ইরতেজা চৌধুরী বসে পড়েন পরিচালকের চেয়ারে।
সিনেমা ফিরে পেতে রাশেদ রাহা অভিযোগ করেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক সমিতিতে। দুই সমিতি একত্রিত হয়ে প্রযোজক ও পরিচালককে ডেকে পাঠান। মৌখিকভাবে বিষয়টি সুরাহা করার কথা বলে সংগঠন দুটি। এরপর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
সম্প্রতি ছবিটি সেন্সরবোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ছবির টিজার। এই দুই জায়গাতে পরিচালক হিসেবে সাকিব ইরতেজা চৌধুরীর নাম দেখা যায়।
সংশ্লিষ্টরা যা বললেন
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির গঠনতন্ত্র অনুসারে ছবি নিবন্ধনের সময় পরিচালকের ঘরে যার নাম থাকবে তিনিই হবেন পরিচালক। জোর করে তার কাছ থেকে কেউ ছবির পরিচালনার দায়িত্ব ছিনিয়ে নিতে পারবে না। যদিও ‘নোলক’ ছবির ক্ষেত্রে পরিচালক সমিতি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। এক্ষেত্রে পরিচালক সমিতি কি নামমাত্র সংগঠন হয়ে রইলো? সংগঠনটির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার ‘নামমাত্র’ শব্দটিতে আপত্তি আছে।
গুলজার বলেন, ‘পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেন্সরবোর্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়ে সচিবের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। এমনকি তথ্যমন্ত্রীকেও মৌখিকভাবে বিষয়টি সম্পর্কে জানিয়ে এসেছি। এরপরও ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে কীভাবে মুক্তি পেতে চলেছে—সেটা আমার কাছে একদম বোধগম্য নয়। মন্ত্রণালয়ের চিঠি ও এফডিসির কাগজপত্রে পরিচালক হিসেবে রাশেদ রাহার নাম উল্লেখ করা। এরকম অবস্থায় বিএফডিসি কতৃপক্ষ কেনো ছবিটি মুক্তির অনুমতি দিলো সেটার জবাব চেয়েছি।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এটা মারাত্মক একটি অনিয়ম। সেজন্য পরিচালক সমিতি আইনের আশ্রয় নেবে। সেই সাথে প্রয়োজনে আন্দোলন করবো। এরকম অনিয়ম তো মেনে নেয়া যায় না।’
পরিচালক সমিতির এই নেতার কথার সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)— এর উৎপাদন কর্মকর্তা নুজহাত ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি বললেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ‘নোলক’ ছবি নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটাতে বিএফডিসি কতৃপক্ষের কিছু করার এখতিয়ার নেই বলে তিনি জানান।
নুজহাত ইয়াসমিন বলেন, ‘দেখুন কিছু সিনেমা আছে যেগুলো বিএফডিসিতে তালিকাভুক্ত হয়। যেসব সিনেমা তালিকাভূক্ত হতে চায় তাদের নির্ধারিত ফি দিতে হয়। তালিকাভুক্তির সময় আমরা পরিচালক সমিতির কাগজ, ট্রেড লাইসেন্সসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা দেখি। এসব সিনেমা সেন্সবোর্ডে গেলে অর্থ পাওনা আছে কিনা, সেটার একটা ক্লিয়ারেন্স বিএফডিসি দিয়ে থাকে। সেন্সরবোর্ড ক্লিয়ারেন্স কাগজ দেখতে চায়। এর বাইরে কিছু সিনেমা আছে যেগুলো তালিকাভূক্ত হয় না। “নোলক” বিএফডিসির তালিকাভুক্ত কোনো সিনেমা নয়। এই ছবির শুটিং দেশের বাইরে হয়েছে। যেসব সিনেমা তালিকাভুক্ত হয় না সেসব সিনেমার কাছে আমাদের কোনো টাকা পাওনা থাকে না। সেজন্য ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিতে হয়।’
অনেকটা আগেভাগে ‘নোলক’ ছবিকে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। নুজহাত ইয়াসমিনের মতে, যেসব সিনেমা বিএফডিসির তালিকাভুক্ত নয় সেগুলোর ক্ষেত্রে সেন্সবোর্ডের হস্তক্ষেপ করা উচিত। যদিও এরকম কোনো নিয়ম নেই। তবে এরকম একটি নিয়ম সংযোজিত হতে পারে। তাহলে জটিলতা সৃষ্টি হওয়া ছবিগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হবে।
ওদিকে চলচ্চিত্র সেন্সবোর্ডের কোনো নিয়ম নেই কোনো ছবি আটকে দেয়ার। সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নিজামুল কবীর বলেন, ‘এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সেন্সরে ছবি জমা দেন প্রযোজক। আমরা শুধু দেখি প্রযোজক সেন্সরের শর্তাবলি মেনেছেন কিনা! যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে আমরা ছাড়পত্র দিয়ে দেই। আর পরিচালক নিয়ে যদি জটিলতা হয় সেটা বাইরে তারা নিজেরাই বুঝবেন।’
শেষমেষ তারা যা বললেন
ঈদুল ফিতরে ‘নোলক’ মুক্তি পাওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন সাকিব ইরতেজা চৌধুরী। সকল জটিলতা কেটে গেছে তাই ছবি মুক্তিতে আর বাঁধা নেই। তিনি বলেন, ‘ঈদে ছবি মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কোনো উড়ো খবরে কান দেয়া ঠিক নয়। আসলে শাকিব খানের ‘পাসওয়ার্ড’ মুক্তি পাবে বলে অনেকে ছবিটিকে আবার বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যতোই অপপ্রচার করা হোক, লাভ হবে না। দিন শেষে ভালোর জয় হবে।’
অন্যদিকে রাশেদ রাহা আশা হারাতে চান না। তাই এখনো ভরসা রেখেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির ওপর। তবে সংগঠনটির ওপর তার ক্ষোভ রয়েছে। যা তার কথায় প্রকাশ পাওয়া গেলো। তিনি বলেন, ‘শুনেছি ওপর থেকে চাপ আসার কারণে ছবিটিকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। ওপরে কে বসে আছেন সেটা আমার জানা নেই! পরিচালকদের স্বার্থ রক্ষাই পরিচালক সমিতির কাজ। যদি স্বার্থ রক্ষা নাই করতে পারে তাহলে সংগঠন থেকে কি লাভ? যদিও আমি পরিচালক সমিতির ওপর বিশ্বাস হারাতে চাই না। তারা মামলা করবে বলে জানতে পেরেছি।’
এসময় রাশেদ রাহা সেন্সরবোর্ডের কয়েকজন সদস্যর বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতির অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, ‘সেন্সরবোর্ডের এমন কয়েকজন সদস্য আছেন যারা বলেছিলেন, বিষয়টি আমি দেখছি। কোনো চিন্তার দরকার নেই। কিন্তু দেখা গেলো পরবর্তীতে তারা সেন্সরবোর্ডে বসে ছবিটির সেন্সর দিয়ে দিলো। এটা কেমন নীতি? আসলে আমি একা লড়ে যাচ্ছি। একেক জন একেক রকম কথা বলেন। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রহস্যময়।’
সারাবাংলা /আরএসও /পিএ