আজ আমার কাঁদবারই দিন
৭ মে ২০১৯ ১৮:১১
হৃদয়ের একটা অংশ ক্ষয় হয়ে গেল আজ। চলে গেলেন সুবীর নন্দী! যিনি আমার কাছে কিংবদন্তির চেয়েও বড়। সদালাপী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, ভেতরে বাহিরে এক ভদ্র মানুষ। গানে টান দিলেই যার হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী! তিনি মঞ্চে গাইছেন আর তার সবক’টা গানের প্রতিটা লাইন তার সাথে সাথে গাইছে দর্শক!
‘আমার এ দু’টি চোখ পাথর তো নয়’
‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’
‘দিন যায় কথা থাকে’
‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরণা বলো’
‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’
‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’
‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’
‘তুমি যে আমার কবিতা’
‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’
‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’
‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’
‘একটা ছিল সোনার কন্যা’
‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’…
আমার, এই আমি হয়ে ওঠার পেছনেও যে তার কণ্ঠের মায়া! ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটা না থাকলে আমি যে কুসুম হতে পারতাম না! ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ না থাকলে আমাকে কয়জন মনে রাখতো! ‘আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা’- হুমায়ূন আহমেদ সবার আগে তাকে দিয়েই গাইয়েছেন। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ তার কণ্ঠে প্রথম রেকর্ড করিয়েছেন। ‘যে থাকে আঁখিপল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে’- এ গানটিও প্রথম তিনিই গেয়েছিলেন।
হুমায়ূনের নাটকে গান- তাও তো অনেক! সেই অয়োময় থেকে শুরু!
“তোমার কাছে একটা জিনিস চাই গো দয়াময়
আমার মরণ চান্নিপসর রাইতে যেন হয়!”
কিংবা
“আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে
আমার ঘরে জোছনা কই?”
তারপর আমার ছোট্টবেলার কাজ হুমায়ূন আহমেদ এর ডকুফিল্ম ‘জননী’- যেখানে তিনি গাইলেন “সোহাগ চাঁদবদনী ধ্বনি নাচো তো দেখি!”
‘সবুজ সাথী’ নাটকের জন্য স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়ের গান লাগবে- লিখে ফেললেন হুমায়ূন আহমেদ। গাইবে কে? সুবীর নন্দী আছেন না!
“শোনেন শোনেন নতুন বধু শোনেন দিয়া মন
আপনার জন্য কিছু কথা করিব বর্ণন
সংসার ছোট রাখতে হবে সুখ যদি চান
আপনার জন্য সত্য কথায় এই বাধিলাম গান।”
তার কন্ঠে ‘সবুজ সাথী’র কি যে মিষ্টি আরেকটা গান!
“এই গেরামের একটা মেয়ে বকুলবালা নাম
বকুলবালার গুনের কথা কি বলিবাম!
রইদে রইদে ঘুরে বকুল মুখে থাকে হাসি
বকুলবালার মুখের হাসি আমরা ভালেবাসি।”
‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ ধারাবাহিকের জন্য তার কণ্ঠে হুমায়ূনের গান-
“হুড়মুড় হুড়মুড় করে মেঘা ঘুরমুর ঘুরমুর করে
আমার ঘরের চালায় বিষ্টি ঝুমঝুমাইয়া পড়ে
ঝুমঝুমাইয়া পড়ে বিষ্টি ঝুমঝুমাইয়া পড়ে
সাঁইঝাকালে আমার মনটা কেমন কেমন করে!”
তার আগে হুমায়ূন লিখলেন ‘হাবলঙ্গের বাজারে’। মকসুদ জামিল মিন্টু’র সুরে এ গানও সুবীর নন্দীর। তিনজনের কি অসাধারণ জুটি! গান রেকর্ডিং এর সেই সুন্দর সময়গুলো! মাঝে মাঝে মনে হয় তখন যদি স্মার্টফোন নামক যন্ত্রটা থাকতো কি সুন্দর মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখা যেত! পরক্ষণেই মনে পড়ে- ইদানিং আর গীতিকার সুরকার আর শিল্পী একসঙ্গে বসে গানের কাজ করেন না। গীতিকার গান লিখে মেইল কিংবা ভাইবার/হোয়াটসআপে পাঠিয়ে দেন সুরকারের কাছে! সুর হবার পর ডেমো মিউজিক ফাইল ইমেইলে চলে যায় শিল্পীর কাছে! মুহূর্তই তৈরী হয়না আর! হুমায়ূনের লেখা গানে মকসুদ জামিল মিন্টু হারমোনিয়ামে সুর দিচ্ছেন, পাশে বসে সুবীর নন্দী গুণগুণ করে গাইছেন আর সামনে বসে স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ চোখ বন্ধ করে শুনছেন! চোখের সামনে ভাসছে সেই দৃশ্য!
মৃত্যুতে ইদানীং আর চোখ বেয়ে পানি পড়ে না!
চোখের কোন একটু ভিজে ওঠে শুধু! গুণী মানুষগুলোর একে একে চলে যাওয়ায় আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি হয়তো!
কিন্তু চোখে জল আজ মানছেই না। মানতে হবে কেন সবসময়! আজ রমজানের প্রথম দিনে অচিন দেশে পাড়ি জমালেন প্রিয় সুবীর নন্দী! ৭ বছর আগে রমজানের প্রথম দিনেই চন্দ্রকারিগরের সেই দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন হুমায়ূন। আমার তো আজ কাঁদবারই দিন।
মেহের আফরোজ শাওন : কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী ও নির্মাতা।
মেহের আফরোজ শাওন সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দী স্মরণ হুমায়ূন আহমেদ