কেমন হলো ‘শনিবার বিকেল’: হলিউড রিপোর্টারের মুভি রিভিউ
১২ মে ২০১৯ ১৭:১১
বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিকমনা পরিচালক, লেখক ও প্রযোজক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মনোযোগ দিয়েছেন সন্ত্রাসবাদের দিকে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরায় হওয়া সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে ঘিরে নির্মাণ করেছেন তার নতুন ছবি ‘শনিবার বিকেল’। পাঁচ বন্দুকধারীর হামলায় সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন বিদেশি নাগরিকসহ অন্তত ২২ বেসামরিক। পরে সেনাবাহিনীর এক দুর্ধর্ষ অভিযানে থামে তাদের হত্যাযজ্ঞ।
কোনো সাধারণ জিম্মি সংকট–ভিত্তিক চলচ্চিত্রের জন্য এই ঘটনায় যথেষ্ট ড্রামা ও ট্র্যাজেডি রয়েছে। কিন্তু ফারুকি তার চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন একটু ভিন্নভাবেই।
সাধারণ নাটকীয়তা বা শোকের ঘটনা এড়িয়ে পরিচালক খুঁজেছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোন। রেস্তোরায় সন্ত্রাসীদের হামলার শুরুটা বাদ রেখেছেন ফারুকী। তার সিনেমা শুরু হয় হামলার কিছুক্ষণ পর থেকে। রেস্তোরার ভেতরের পরিবেশ তখন ক্ষণিকের জন্য শান্ত হতে শুরু করেছে। আর শেষ হয় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়া দিয়ে।
নিশ্চিতভাবেই এটুকুর মধ্যে প্রচুর হত্যাযজ্ঞ রয়েছে। কিন্তু ছবির মূল লক্ষ্য তা না। সেসব বাদ দিয়ে তিনি বরং বন্দুকধারী ও রেস্তোরায় আটকা পড়া নিরীহ শিকারদের মধ্যকার কথোপকথনে বেশি মনোনিবেশ করেছেন। যেসব কথার মধ্য দিয়ে হামলাকারীরা তাদের হামলাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণের চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে আটকা পড়া মুসলিমরা তর্ক করছেন ধর্ম ও মানবতার যুক্তিতে।
সিনেমাটি ইতোমধ্যে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রাশিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। এছাড়া, মিউনিখ, সিডনী ও বুসানেও জেতার অপেক্ষায় রয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে ছবিটি এখনো পায়নি সেন্সর ছাড়পত্র। কর্তৃপক্ষ বলছে, ছবিটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে পারে, তাই আটকে রয়েছে সেন্সর সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রক্রিয়া। আদতে, বাংলাদেশ-জার্মানির যৌথ প্রযোজনার এই ছবিটি বাংলাদেশের সুনাম ছড়াচ্ছে। আর এতে ফুটে ওঠা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তা কোনোদিক দিয়ে কম মর্মস্পর্শী নয়।
চলচ্চিত্রের মাঝভাগের গল্প একটি একক, ঝাঁজালো শটে নেওয়া হলেও এর শুরু হয় বেশ কয়েকটি শট দিয়ে। এতে ঢাকার শনিবারের একটি অলস সকালের ছলনাময়ী স্থিরতা ফুটে ওঠে। ঢাকা তখনো জানে না কী ঘটতে চলেছে সেদিন বিকেলে।
সন্ত্রাসীদের ভূমিকায় রয়েছেন একজন বয়স্ক (সম্ভবত আরব) ও ঠাণ্ডা-মাথার বাংলাদেশি পলাশ (ভারতীয় অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)। তারা জিম্মিদের স্থানীয় ও বিদেশি দুই ভাগে ভাগ করে নেন। জাপানি, ফরাসি ও ইতালিয়দের ওপর চালানো নির্মমতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণভাবে।
এক প্রসূতি নারী তার অনাগত শিশুর জীবন ভিক্ষে চাইলে জবাবে তাকে বলা হয়—পশ্চিমারা ইরাক ও সিরিয়ায় শিশুদের হত্যা করছে। এরপরই তার পেট বরাবর চালিয়ে দেওয়া হয় গুলি। এক পুরুষকে তার বৃদ্ধা মা’কে ফোন দিতে বলা হয়। যাতে করে তিনি তার ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনতে পারেন।
এই হত্যাকারীদের কারো মনে নেই ছিটেফোটা সহানুভূতি। বেঁচে আছেন কেবল মুসলিম জিম্মিরা। এখান থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে গড়ায়। নারীদের অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে দ্রুতই হত্যা করা হয়। বেঁচে থাকেন কেবল রাইসা (নুসরাত ইমরোজ তিশা), কারণ তিনি হিজাব পরা ছিলেন। অশ্রুবিজরিত চোখ নিয়েও তার নৈতিকতায় ঘাটতি পড়েনি একটুও। সন্ত্রাসীদের ধর্মীয় আদর্শকে বিকৃতকরণের প্রধান সমালোচকদের একজন হয়ে ওঠেন তিনি।
অপর একজন উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছেন ব্যবসায়ী শহিদুল (জাহিদ হাসান)। তিনি তার তরুণ সন্তান ও বাংলাদেশিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভারতীয় সহকর্মীকে (ফিলিস্তিনি অভিনেতা ইয়াদ হৌরানি) বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তার ওই সহকর্মী শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম। খ্রিস্টান ও নাস্তিকদের চেয়ে শিয়া গোত্রকেই বেশি ঘৃণা করে সন্ত্রাসীরা।
প্রতি মুহূর্তে প্রাণনাশের হুমকি ও হত্যাযজ্ঞের ফলে পুরো ছবিজুড়েই উত্তেজনা থাকে টানটান। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থাকা জিম্মিদের বিভিন্ন ঘটনা এবং বাইরে তাদের প্রিয়জনদের ঘটনা সে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। কোনোরকম হিরোগিরি বা নাটকীয়তা ছাড়াই বিভিন্ন ঝুঁকি নেয় তারা। বিবেচনাযোগ্য গতিতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তর্ক হয় জিম্মিদের।
ঘটনার উপস্থাপন যতটা না শ্বাসরুদ্ধকর, ফারুকীর পরিচালনাও ততটাই সুনিপুণ। পুরো ছবি ওয়ান-শট সিংগেল টেক’এ নেওয়া হলেও দর্শকরা সহজেই গল্পের উত্তেজনায় তা ভুলে যান। এর মধ্যেই ভালেরি পেত্রোভের স্টেডিক্যাম যখন সবার ওপর দিয়ে উড়ে যায় আর তাতে রেস্তোরার জানালা দিয়ে ভেসে ওঠে পুলিশের আনাগোনা। কিন্তু তাতেও মনোযোগ হারান না অভিনেতা-অভিনেত্রী বা সিনেমাটোগ্রাফার।
তথ্যসূত্র: হলিউড রিপোর্টার, ১০ মে, ২০১৯
সারাবাংলা/আরএ/পিএ
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী রিভিউ শনিবার বিকেল সিনেমা হলিউড রিপোর্টার