Monday 07 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবীন্দ্র-ভারতীর স্বর্ণপদক ও আমাদের সুদেষ্ণা


২১ মে ২০১৯ ১৯:১৫ | আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ২১:৩৫
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুদুর আমেরিকা। প্রবাসী বাঙালিদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠান। মাত্র চার বছর বয়সের ছোট্ট একটি মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচেই চলেছে – ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’।

মা বাংলাদেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী। বাবা বিখ্যাত বাচিকশিল্পী। এমনই এক পরিবারে জন্ম নেয়া সেই ছোট্ট মেয়েটি ঠিক কখন থেকে নাচ শুরু করে, সেটা সে নিজেই জানেনা। মায়ের কাছেই প্রথম হাতেখড়ি মনিপুরী নৃত্যে। তাই মা-ই তার কাছে প্রধান নৃত্যগুরু। এরপর একটু একটু করে মেয়েটি তৈরি হতে থাকে পরম পরিচর্যায়। এখনো যেটুকু পথচলা, যেটুকু সাফল্য, যেটুকু প্রাপ্তি, তার সবটাই মায়েরই আশীর্বাদ মনে করে মেয়েটি।

বিজ্ঞাপন

ছোটবেলায় মা ছাড়াও সে ছায়ানটে বেলায়েত হোসেন খান ও তামান্না রহমানের কাছেও নাচ শিখেছে। তার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি হচ্ছে মাত্র ছ’বছর বয়সে উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টারে উপমহাদেশের বিখ্যাত নৃত্যগুরু অমলাশংকরের কাছে নাচ শিখতে পারা। একই সময়ে মনিপুরী নৃত্যের কিংবদন্তি শ্রীমতি কলাবতী দেবীর কাছেও মনিপুরী নৃত্যের তালিম নেয় সে। এছাড়াও ভারতের আরেক নৃত্যগুরু প্রফেসর সি ভি চন্দ্রশেখরের কাছে শিখেছে ভরতনাট্যম। শিখেছে ওড়িশি নৃত্যও, বাংলাদেশের বেনজির সালাম সুমিতের কাছে।

এতকিছু শিখলেও মেয়েটির ভালবাসা মায়ের মতোই মনিপুরী নৃত্যে। তাই মনিপুরী নৃত্যের কিংবদন্তি শ্রীমতি কলাবতী দেবী যখন ভারতীয় দুতাবাসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এলেন প্রশিক্ষণ দিতে, মেয়েটিও যুক্ত হলো সেখানে। আবার তার কাছে দীর্ঘদিন তালিম নেয়া হল।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথমবারের মতো ‘তারানা’ নামে নাচের প্রতিযোগিতা মূলক একটি অনুষ্ঠান শুরু করে। মেয়েটি অংশ নেয়। প্রায় একবছর ধরে চলা এই প্রতিযোগিতায় একের পর এক গণ্ডি পেরিয়ে সবশেষে মেয়েটিই হয় প্রথম তারানা চ্যাম্পিয়ন। পুরস্কারের ঝুলিতে এটাই তার প্রথম পাওয়া।

এরপর সে ঝুলি খুব একটা বড় হয়নি তার। কারণ- মায়ের ইচ্ছে। মা বলতেন, ‘প্রতিযোগিতার ঘোড় দৌড়ে নয়, আগে নিজেকে তৈরি করো শুদ্ধ চর্চায়। সমর্পিত হও সাধনায়।’ তাই তেমন করে আর কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া হয়নি মেয়েটির।

নাচের শুদ্ধচর্চায় ও পুর্ণ সাধনায় সমর্পিত হয়ে এগিয়ে চললো মেয়েটি। পাশাপাশি চললো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃ-বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেও মনের ভেতর কোথায় যেন এক অতৃপ্তি। জীবনের সিংহভাগ জুড়ে যে নাচ, সেই নাচের প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা তো নেয়া হলো না তার।

মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় শিল্পচর্চার পীঠস্থান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে নাচের উপর মাস্টার্স করবে। ইচ্ছে পূরণ হল মেয়েটার। আইসিসিআর স্কলারশীপ পেয়ে ২০১৬ সালে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিপুরী নৃত্য বিভাগে মেয়েটি ভর্তি হয় মাস্টার্সের জন্য। সেখানে তার শিক্ষক গুরু বিপীন সিং ও গুরু শ্রীমতি কলাবতী দেবীর কন্যা শ্রীমতি বিম্বাবতি দেবী। তারই তত্ত্বাবধানে চলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ। আর এখন সে তারই ছাত্রী হিসাবে যুক্ত রয়েছে মনিপুরী নর্তনালয়ে। ইতিমধ্যে শ্রীমতি বিম্বাবতি দেবীর তত্ত্বাবধানে ভারতের সবচেয়ে বড় নৃত্যোৎসব ‘খাজুরাহ’তে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছে তার।

দুই বছরের শিক্ষা গ্রহণ শেষে ২০১৮ তে মেয়েটি অংশ নেয় সমাপনী পরীক্ষায়। রেজাল্ট বের হবার পর সবার তাক লেগে যায়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ডান্স ফ্যাকাল্টিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেয়েটি প্রথম স্থান অধিকার করে। মনোনীত হয় গোল্ড মেডেল পুরস্কারের জন্য। মেয়েটির জন্য এ এক অন্যরকম অনুভূতি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে যে কজন বাংলাদেশি এই গৌরব অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে সর্বশেষ বাংলাদেশি হিসাবে যুক্ত হল মেয়েটির নাম – ‘সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা’।

সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা– আমাদের আজকের এই আলোচিত সফল মেয়েটি। যার আরেকটি আদুরে নাম– তাথৈ। এ নামেই পরিচিত মহলে সমাদৃত সে। মা শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী। নৃত্যগুরু হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় হলেও যিনি নিজেকে একজন নৃত্য শিক্ষক হিসাবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন। বাবা ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। বাংলাদেশের বিখ্যাত আবৃত্তিকার। যিনি তার দরাজ গলায় হৃদয় ছুঁয়ে যান সববয়সি শ্রোতাদের।

প্রিয় পাঠক, মনে কি পড়ে? গৌতম ঘোষের সেই বিখ্যাত সিনেমা ‘মনের মানুষ’র চরিত্র গুলো। বালক সাঁইজীর বালিকা বধু চরিত্রে অভিনয় করা সেদিনের সেই তাথৈ আজকের সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা। একজন পরিপুর্ণ নৃত্যশিল্পী হিসাবেই যার পদচারণা নৃত্য জগতে জানান দিচ্ছে নবীনের জয়গান। এখনই নৃত্য শিক্ষক হিসাবে সে যুক্ত হয়েছে ছায়ানট ও নৃত্যনন্দনে।

গত ৮ মে রবীন্দ্রভারতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম কনভোকেশনে সুদেষ্ণাকে দেয়া হয় গোল্ড মেডেলসহ সম্মাননা। সর্বোচ্চ নম্বরের জন্য তাকে দেয়া হয় আরো তিনটি বিশেষ সম্মাননা– অসিত চট্টোপাধ্যায় মেমোরিয়াল পদক, সুনিত বসু মেমোরিয়াল পদক ও নীরোদবরন মেমোরিয়াল পদক।

সুদেষ্ণা মনে করে এই পথচলা, এ সাফল্যের পুরো কৃতিত্বটাই তার মায়ের। আবেগপুর্ণ অনুভূতি তার– ‘ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছ থেকে শিখেছি যে প্রতিযোগিতা নয়, শুদ্ধচর্চায় মনোযোগী হতে হবে, মা বলতেন। আরও বলতেন, আগে শিখে যাও, যখন সময় হবে তুমি নিজেই বেরিয়ে আসবে।’

‘সেই ২০০৭ সালে একমাত্র বিটিভির ‘‘তারানা’’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পুরস্কার ছাড়া, নাচের উপর অন্য কোন পুরস্কার পাওয়ার তেমন একটা অভিজ্ঞতা আমার নেই। তাই এতোদিন পরে এমন একটা প্রাপ্তি। আমি আসলে এক অন্যরকম অনুভূতির মধ্যে আছি। আমি বুঝতে পারছি আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেলো। যে পরিশ্রম করে আমি এটা অর্জন করেছি, সেই পরিশ্রমের ধারাবাহিকতাটাকেই ধরে রাখতে হবে আমার। আরও অনেক বেশি যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারি, তারই অনুপ্রেরণা এই পুরস্কার।’

শুভ হোক সুদেষ্ণার পথচলা, এগিয়ে যাক অনেক দূর … শুভকামনা … সবার পক্ষ থেকে …।

সারাবাংলা/এএসজি/এমএম/পিএ

ওড়িশি তাথৈ নৃত্যশিল্পী ভরতনাট্যম ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় মনিপুরী নৃত্য রবীন্দ্রভারতি বিশ্ববিদ্যালয় শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর