কান: সিনেমার সমুদ্রে
৫ জুন ২০১৯ ১৬:৫৫
সালাম সিনেমা!
বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস-এর জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ জিজ্ঞেস করছে, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ যিনি জিজ্ঞেস করলেন (পরে জানতে পারলাম) তিনি একজন নাবিক, নাইজেরিয়ার লাগোস-এ কাজ করেন। ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আবার ফিরছেন আফ্রিকায়, সমুদ্রে। বললাম, আমিও সমুদ্রে যাচ্ছি, কান নামের এক শহরে, ভূমধ্যসাগরের তীরে।
বহু ইতিহাস আর স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে এই সমুদ্র। এর সমস্ত শরীর জুড়ে বহু নীল আর বহু লাল। এই রঙের টানে শিল্পীরা ছুটে আসতেন ঘোরগ্রস্থ হয়ে। শাগাল, সেজানে, মুঙ্খ, মনে- আরও বহুজন তুলিতে ধরতে চেয়েছেন এর রঙ, এর গরিমা।
এর তটরেখাতেই গোছানো শহর কান। সিনেমার শহর। সিনেমার সমুদ্র। এটাকেই হয়তো কার্নিভাল বলে। দুনিয়ার নানাপ্রান্তের হাজারও মানুষ একত্রিত হয় এই কার্নিভালে। শুধু সিনেমার জন্য।
হোটেলের পথে যখন যাচ্ছি, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম রাস্তার দু’ধারে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। প্ল্যাকার্ডে লেখা- ‘একটা টিকেট হবে, সিনেমা দেখব’। সিনেমা নিয়ে এক ঘোরগ্রস্থ উন্মাদনা। নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম- সালাম সিনেমা!
ধার করা চোখ দিয়ে দেখা
আমরা অংশ নিয়েছি কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ আয়োজন ‘লা ফেব্রিক সিনেমা’য়। আমি আর আমার প্রযোজক রুবাইয়াত হোসেন। টানা নয়দিন আমরা শুধু কথা বলেছি আমাদের সিনেমা প্রকল্প ‘স্যান্ড সিটি’ নিয়ে। পিচ করেছি, প্রযোজকদের সঙ্গে মিটিং করেছি, কথাবলেছি সেলস এজেন্ট আর ডিসট্রিবিউটরদের সঙ্গে। আর ভারতীয় প্রখ্যাত নির্মাতা মীরা নায়ারের সঙ্গে ছিল তিন দিনের কর্মশালা।
আমাদের সঙ্গে ছিল আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, মিসর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, রুয়ান্ডা ও তিউনিসিয়ার আরও নয়টি চলচ্চিত্র প্রকল্প। পৃথিবীর নানা প্রান্তের এই প্রকল্পগুলোর পরিচালক-প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলা মানে নিজের অভিজ্ঞতাকে বিস্তৃত করা। তাদের চোখ দিয়ে দুনিয়ার ভিন্ন রঙকে দেখা। তাদের প্রতিদিনের আনন্দ, সংগ্রাম, ভালবাসা, যন্ত্রণাকে নিজের করে নেয়া। ইন্দোনেশিয়ার কোন এক বালকের স্মৃতি কিংবা মিসরের কোন এক নারীর যন্ত্রণা তখন নিজের বলে মনে হয়। কিয়ারোস্তামি যাকে বলেছেন: ধার করা চোখ দিয়ে দেখা।
প্রথম দিন থেকেই আমাদের পিচ, মিটিং, আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আমাদের প্যাভিলিয়ন একদম সমুদ্র ঘেঁষে। দূরে ছোট-বড় জাহাজ। কিছুটা তফাতে বাতিঘর। আর মাথার উপরের অসীম আকাশে ক্ষণে ক্ষণে উড়ে যায় সিগাল।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় মিটিং করি, ফাঁকা সময় পেলে সমুদ্র দেখি, তারপর আবার মিটিং। একেকটা মিটিং ৩০ মিনিট। একটার পর একটা চলতে থাকে। এই মিটিংগুলো খুব মজার। নানান দেশের প্রযোজক-পরিবেশকরা ঢাকা শহর নিয়ে নানান বিষয় জানতে চায়। তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে করতে আমরা ঢাকাকে নতুন নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করি। ঢাকার মিথ, মানুষ, প্রতিদিনের জীবনকে দেখতে পাই বিভিন্ন লেন্সিং-এ।
সমুদ্রতটে বাজার
একদিকে চলছে সিনেমা, অন্যদিকে সিনেমার বিকিকিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিনেমার বাজার তো এখানেই। আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া সব মহাদেশের প্রফেশনালরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই বাজারে।
কান-এর রাস্তায় মিনিট খানেক হাঁটেলই চোখে পড়বে এমকে টু, ম্যাগনোলিয়া কিংবা মিরাম্যাক্স-এর মতো বিশাল পরিসরের ফিল্ম কোম্পানিগুলোর অফিস। সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে এর বিপণন আর পরিবেশনার যে সম্পর্ক তা এই উৎসবে আরও বেশি সুস্পষ্ট।
উৎসব চলাকালীন সময়েই যেমন ফক্স সার্চলাইট কিনে নিলো টেরেন্স মালিক’র সিনেমা ‘আ হিডেন লাইফ’। নেটফ্লিক্স, এ২৪, প্যারামউন্ট, ফোকাস-এর মতো বড় বড় প্লাটফর্মগুলো কিনে নিতে চেয়েছিল সিনেমাটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪ মিলিয়ন ডলারে লুফে নেয় ফক্স।
প্যাভিলিয়ন: ছোট ছোট দেশ
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়ন। প্রতিদিনের প্রোগ্রাম শেষে এই প্যাভিলিয়নগুলোতে ঢুঁ মারি। কানাডা, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, গ্রীস, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশ প্রতি বছর তাদের সিনেমা নিয়ে হাজির হয় এই সময়ে। তাদের সঙ্গে আলাপ করি নতুন দিনের সিনেমা নিয়ে। কখনো কখনো তারা আশাবাদী, কখনো সংশয়ী। তারা জানতে চায় বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে। তাদের দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমা পাঠাতে বলে। হেসে বলি- আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বলব সিনেমা পাঠাতে তোমাদের দেশে। মনে মনে ভাবি- উৎসব তো আসলে এই জন্যই; সিনেমা দিয়ে জাতিগত সীমানাগুলো টপকে যাওয়া। একটা কমন প্লাটফর্মে এসে নিজেদের ভাবনা আদান প্রদান করা, সঙ্কীর্ণ ঘেরটোপ থেকে বেরিয়ে দেখা যে বাস্তবতা আরও হাজার রকমের হয়।
সূর্য আর মেঘের ছায়াতলে
এখানে এখন বসন্ত। যদিও দু’দিন পর থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি, সঙ্গে ঠাণ্ডা। কখনো সূর্য উঁকি মারে, তখন চোখ ঝলসে যাওয়া আলো। আবার জমে ওঠে মেঘ, ঢাকা পড়ে যায় গাঢ় নীল আকাশ। তাতে অবশ্য কোন ছেঁদ পড়ে না উৎসবে। সূর্য আর মেঘের ছায়াতলে যেন আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে ৭২ বছর বয়সী এই তরুণ কার্নিভাল।
লেখক: ৭২তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘লা ফ্যাব্রিক দ্য সিনেমা দ্যু মুন্দ’ বিভাগে স্থান করে নেওয়া ‘স্যান্ড সিটি’ ছবির পরিচালক।
সারাবাংলা/পিএ/পিএম