শকুন্তলা নাট্যপ্রযোজনা: একটি নান্দনিক শিল্পপ্রয়াস
৩০ জুলাই ২০১৯ ১২:১৯
জার্মান কবি ও নাট্যকার গ্যোটে ১৭৯২ সালে শকুন্তলা জন্য তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন-
Wouldst thou the young year’s blossoms and the fruits of its decline
And all by which the soul is charmed, enraptured, feasted, fed,
Wouldst thou the earth and heaven itself in one sole name combine?
I name thee, O Sakuntala! and all at once is said.
অর্থাৎ কেউ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, কেউ যদি মর্ত্য ও স্বর্গকে একসঙ্গে দেখতে চাও, তবে শকুন্তলায় তা পাবে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের প্রযোজনায় ২৩ ও ২৪ জুলাই ২০১৯ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হলো মহাকবি কালিদাস’র নাটক ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’। নাটকটি নির্দেশক আতিকুল ইসলাম শকুন্তলা মঞ্চায়নের জন্য জ্যোতিভূষণ চাকীর অনুবাদটিকে বেছে নিয়েছেন।
প্রযোজনা প্রসঙ্গে আলোচনার প্রাক্কালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবকে সাধুবাদ জানাই। Explore Yourself এই মন্ত্রকে ধারণ করে ১৯৯৬ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের থিয়েটার ও চলচ্চিত্র চর্চায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ক্লাবটি সংক্ষেপে CDC নামে অধিক পরিচিত। CDC প্রায় দুই যুগ সময়ের পথচলায় বেশ কিছু বিখ্যাত নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে বেশ কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। তন্মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো, মলিয়রের নাটকের বাংলা রূপান্তর বিদগ্ধ রমণীকূল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্ত করবী ও তাসের দেশ, সৈয়দ শামসুল হকের দ্য ডেড পিকক , সেলিনা হোসনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ হাঙ্গর, নদী, গ্রেনেড, উইলিয়াম শেক্সপীয়রের মিড সামার নাইটস ড্রিম, পিটার হ্যান্ডকির প্লে গ্রাউন্ড, মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে মলুয়া পালা উল্লেখযোগ্য।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের দুই যুগের নাট্যঅভিযাত্রার শক্ত ভীতের উপর দাঁড়িয়ে নির্দেশক আতিকুল ইসলামের কাছে এবছরের বাৎসরিক নাট্যপ্রযোজনার পাণ্ডুলিপি নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস, ল্যাবওয়ার্ক, শ্রেণি অভীক্ষা, অ্যসাইনমেন্ট, চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রভৃতির চাপ সামলিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মহড়া করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়াই একটা কঠিন ব্যাপার। শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ব্যস্ততা ও নাগরিক বাস্তবতা জেনেও নির্দেশক বেছে নিলেন মহাকবি কালিদাসের শুকুন্তলা নাট্যপাণ্ডুলিপির একটি ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। টানা সাতচল্লিশ দিনের মহড়ায় নাট্যকর্মীরা পাঠ নিলেন সংস্কৃত নাটকের ইতিহাস ও রীতিনীতি, তালিম নিলেন উচ্চারণ, অভিনয় ও ভরতনট্যমের প্রাথমিক নৃত্যকৌশল। বিভিন্ন ডিসিপ্লিন থেকে আগত শিক্ষার্থীদের সমন্বিত এই ক্লাবের নাট্যকর্মীরা শুকুন্তলার মহড়ার সময় যে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও পরম মমতায় পা-ুলিপি আত্মস্থ করছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। বলতে গেলে তারা রীতিমতো আরাধনা করেছেন। এই একাগ্রতার বিষয়টি অদৃশ্য ছায়াসঙ্গী হয়ে প্রযোজনায় প্রতিফলিত হয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে নির্দেশনের গৃহিত চ্যালেঞ্জটি সফলতা লাভ করেছে।
২৩ জুলাই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মঙ্গলবারের বিকালের ক্যাম্পাস ভিন্নরূপে সজ্জিত। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। শুভ্র ধুপধোঁয়ার সুগন্ধ, মঙ্গলালোক ও শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের যন্ত্রানুষঙ্গের ত্রয়ীবন্ধনে এনএসইউ মিলনায়তনে সৃজিত হয়েছিল এক ধ্রুপদী নাট্যসময়। মিলনায়তনের দর্শক আসনগুলো স্বল্পসময়েই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অনলাইনের মাধ্যমে নিবন্ধিত হয়ে দর্শকরা এসেছেন নাটক উপভোগ করতে। আমন্ত্রিত অতিথির পাশাপাশি মূল দর্শক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বর্তমান শিক্ষার্থীবৃন্দ, প্রাক্তনেরাও এসেছেন। অনলাইনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেছেন প্রায় চৌদ্দশ; কানায় কানায় মিলনায়তনের আসনগুলো পূর্ণ; কেউবা পেছনে দাঁড়িয়ে, কেউবা সিঁড়িতে বসে সন্ধ্যার গাম্ভীর্যতায় মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলার মঞ্চবিচরণ দেখার প্রতীক্ষায় সকলে মৌনব্রত। গুরুগম্ভীর সন্ধ্যাসঙ্গীতের আবাহনে নীলাভ আলোয় উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় একদল নটনটী ভরতনাট্যমের মুদ্রাপ্রয়োগে শকুন্তলা নাটকের প্রারম্ভিক আবহ সূচনা করছে। নির্দেশক শকুন্তলা নাট্যউপস্থাপনে আধুনিক মিশ্ররীতির আশ্রয় নিয়েছেন। সংস্কৃত নাটকের রীতিনীতির কঠিন বলয় ভেঙ্গে নবতর শিল্পকৗশলগুলো সূক্ষ্ম ও সূচারুভাবে সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন। নাট্যকাহিনীর সাথে দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেখার জন্য নির্দেশক বর্ণনাত্বক রীতি, চরিত্রাভিনয়, নৃত্য ও সঙ্গীতের অপূর্ব মেলবন্ধন রচনা করেছেন প্রতিটি দৃশ্যে। সংস্কৃত নাটকের রীতি অনুসরণে প্রারম্ভিক মঙ্গলাচরণের পর একজন সূত্রধর কবি ও আখ্যান পরিবেশনের জন্য সমাবেত দর্শক সমাবেশের নিকট প্রস্তাবনা করেন। মৃদু আলোর গভীরতায় ঋষি বিশ্বামিত্রের মহাধ্যানের দৃশ্যকবিতা দিয়ে দর্শক শকুন্তলা পাঠদর্শন শুরু করে।
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটির পাঠসুবিধার্থে নিদের্শক আতিকুল ইসলাম শকুন্তলা পাণ্ডুলিপিকে যেভাবে মঞ্চে এনেছেন, সে ক্রমধারায় নাট্যকাহিনীতে দেখা যায়- তপস্যারত ঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র মেনকাকে মর্ত্যলোকে প্রেরণ করেন। মেনকা তাঁর রূপ ও লাবণ্যের মোহজালে তপস্যারত ঋষি বিশ্বামিত্রকে বিচলিত করেন এবং সফলতা লাভ করেন। ঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভে জন্ম হয় শকুন্তলার। দীর্ঘসাধনার প্রাপ্তি হারানোর ফলে ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র কন্যাসন্তানটিকে ত্যাগ করেন। অপ্সরা মেনকাও কন্যাসন্তানটিকে পরিত্যাগ করে এক অরণ্যে ফেলে স্বর্গে ফিরে যায়। কন্যাশিশুটিকে অরণ্য মাঝে পাখিকুল দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় খুঁজে পান ঋষি কণ্বমুনি, কুড়িয়ে নিয়ে যান নিজের আশ্রমে। কন্যাশিশুটির নামকরণ করা হয় ‘শকুন্তলা’। ‘শকুন্ত’ শব্দের অর্থ ‘পক্ষী’ আর ‘শকুন্তলা’ হলো ‘পাখি দ্বারা সুরক্ষিত’।
সময়ের নিজস্ব নিয়মে ঋষি কণ্বের আশ্রমে শকুন্তলা রূপে-সৌন্দর্যে পরিণত হয়ে উঠতে লাগলো। একদিন রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় এলেন সেই অঞ্চলে। তিনি শিকারের জন্য একটি হরিণের পিছনে ধাওয়া করলেন। হরিণটি প্রাণ রক্ষার্থে ঋষি কণ্বের আশ্রম এলাকার আশ্রয় নিলো। প্রথা রয়েছে- ঋষি কণ্বের জঙ্গলে শিকার নিষিদ্ধ। তাই রাজা দুষ্মন্ত অস্ত্র সংবরণ করলেন এবং সেই সাথে ঋষি আশ্রম অভ্যন্তর দেখবার জন্য মনস্থির করলেন। আশ্রমে প্রবেশ করার কিছু সময় পর শকুন্তলাকে দেখে রূপ-সৌন্দর্যে রাজা দুষ্মন্ত বিমোহিত হন। শকুন্তলা-দুষ্মন্ত পরস্পর প্রণয়বাণে বিদ্ধ হন। এভাবে বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হলে রাজা দুষ্মন্ত আশ্রমকন্যা শকুন্তলাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। গান্ধর্ব প্রথা অনুসরণ করে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
রাজধানী থেকে জরুরি বার্তা পেয়ে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী শকুন্তলাকে আশ্রমে রেখে দুষ্মন্ত রাজ্যে ফিরে যান। প্রত্যাবর্তনকালে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে রাজকীয় অভিজ্ঞান স্বরূপ একটি অংগুরীয় প্রদান করেন। দুষ্মন্তের চলে যাওয়ার পর শকুন্তলা পতিবিরহে কাতর হয়ে পড়েন। একদিন ঋষি দুর্বাসা কন্বের আশ্রমে আসেন, পতিচিন্তায় কাতর শকুন্তলা ঋষি দুর্বাসা মনির ডাক শুনতে পাননি। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্বাসা মুনি শকুন্তলাকে অভিসম্পাত করেন- যাঁর কথা চিন্তা করতে শকুন্তলা ঋষিসেবায় অবহেলা করেছে, সে ব্যক্তি অচিরেই শকুন্তলাকে বিস্মৃত হবেন। নির্দোষ শকুন্তলার প্রতি ঋষি দুর্বাসার এরূপ অযাচিত অভিসম্পাতে বিস্মিত হন শকুন্তলার প্রিয় সখিদ্বয় অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা ঋষি দুর্বাসার কাছে যথার্থ কারণ বর্ণনা করে শকুন্তলাকে ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করেন। শকুন্তলার শোকাচ্ছন্নতার নেপথ্য ঘটনা শ্রবণ করে দুর্বাসা মুনি কিছুটা প্রশমিত হন, কিন্তু প্রথা অনুযায়ী অভিসম্পাত ফেরানোর উপায় নেই! তবে তিনি নতুন শর্ত জুড়ে অভিসম্পাত ক্ষাণিকটা শিথিল করেন- শকুন্তলা যদি কোনো অভিজ্ঞান দেখাতে পারে, তবেই সেই ব্যক্তির সব স্মৃতি স্মরণে আসবে এবং চিনতে পারবে শকুন্তলাকে। এই অভিসম্পাতের ঘটনাটি শকুন্তলার অনুপস্থিতিতে ঘটে, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাও বিষয়টি কাউকে জানায়নি। রাজধানীতে ফিরে রাজা দুষ্মন্ত রাজকার্যে গভীর মনোনিবেশ করেন।
কিছুকাল পর শকুন্তলা নিজে গর্ভে নতুন প্রাণের উপস্থিতি টের পান। এ অবস্থায় অনেকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও দুষ্মন্তের ফিরে না আসায় উদগ্রীব হয়ে যায় শকুন্তলা। পালকপিতা ঋষি কণ্বকে নিয়ে শকুন্তলা রওনা হন রাজা দুষ্মন্তের রাজধানী অভিমুখে। মাঝপথে নৌকায় পার হতে হয় একটা নদী। সেই নদীজল ভীষণ মুগ্ধ করলো প্রকৃতিকন্যা শকুন্তলাকে। আশ্রমকন্যা নদীজল হাতে তুলে নিয়ে খেলতে লাগলেন মহানন্দে। বহুদিন পরে স্বামীর সাথে দেখা হতে যাচ্ছে -এই আনন্দ ও বিচলিত ভাবনার মাঝে কোন একসময় রাজার দেয়া আংটিটা শকুন্তলার অজান্তেই নদীর জলে হারিয়ে যায়। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে রাজধানীতে এসে হাজির হন শকুন্তলা। গিয়ে দাঁড়ান রাজা দুষ্মন্তের রাজদরবারে। কিন্তু দুর্বাসা মুনির অভিসম্পাতের কারণে রাজা দুষ্মন্ত তাঁকে চিনতে পারলেন না, তিনি যথার্থই বিস্মৃত হয়েছেন। শকুন্তলা একের পর এক আশ্রমে তাঁদের সব মধুর স্মৃতিঘটনা বর্ণনা করে নিজেকে প্রতীয়মান করার প্রাণপন চেষ্টা করেন, কিন্তু দুষ্মন্ত কোনভাবেই অতীত মনে করতে পারছেন না, ফলশ্রুতিতে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে অস্বীকার করলেন। ইতোমধ্যে রাজার দেয়া আংটিও হারিয়ে ফেলেছেন শকুন্তলা, সবশেষ অবলম্বটুকুও তার হাতে নেই। দুষ্মন্তের স্মৃতি ফেরানোর আর কোনো উপায়ই রইলো না। প্রত্যাখ্যাত হলেন শকুন্তলা।
কিছু কাল পরে শকুন্তলার গর্ভে জন্ম হয় এক পুত্রসন্তানের। তার নাম দেয়া হয় ‘ভরত’। মায়ের প্রশ্রয়ে-আশ্রয়, স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকে ভরত। শৈশবে ভরতের প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা ছিলো বনের সিংহের মুখ হাঁ করিয়ে দাঁত গণনা করা! শিশুপুত্র ভরতকে নিয়ে শকুন্তলা বনের দূরপ্রান্তে একাকী জীবনযাপন করতে থাকলেন। কিছুকাল পর এক জেলে রাজকীয় চিহ্ন খোদাই করা একটি আংটি নিয়ে রাজদরবারে হাজির হন। দুষ্মন্ত আংটিটা দেখামাত্রই চিনে ফেলে। ঋষি দুর্বাসার শাপ থেকে মুক্তি ঘটে, মনে পড়ে যায়- শকুন্তলার কথা, তাঁদের প্রণয় ও বিয়ের সব স্বর্ণস্মৃতি। দুষ্মন্ত সিংহাসন ছেড়ে তড়িৎ শকুন্তলার সন্ধানে বেরিয়ে যান। খুঁজতে খুঁজতে দুষ্মন্ত দেখেন, একটা ছোট্ট বালক হিংস্র এক সিংহের মুখ হাঁ করিয়ে দাঁতগুলো গুনছে। বালকের অসীম সাহসিকতা ও ক্রীড়ানৈপুণ্যে অভিভূত হন রাজা। বালকের প্রতি ভীষণ কৌতূহলী হয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে শিশুটার পরিচয়। শিশুটা জবাব দেয়, ‘তার নাম ভরত, তিনি মাতা শকুন্তলার পুত্র।’ এসময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শকুন্তলা। রাজা দুষ্মন্ত নিজ ভ্রান্তির জন্য শকুন্তলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক অনুশোচনা ব্যক্ত করেন। বহুকাল পরে রাজা দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুনর্মিলন ঘটে।
শকুন্তলা নাট্যকাহিনীতে অনেকগুলো স্থান ও দৃশ্যের অবতারণা রয়েছে। এজন্য এই নাটকের অভিনয় সহায়ক ও বিশ্বাসযোগ্য মঞ্চসজ্জা ও আলোক প্রয়োগ প্রকৃত নাট্যআবহ রচনায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনায় সঞ্জীব কুমার দে সেই কার্যটি যথার্থরূপে সম্পাদন করেছেন। মঞ্চপরিকল্পনায় জটিল কিছু করেননি, সেটের বারংবার কোনো পরিবর্তন নেই, সেট অপরিবর্তিত রেখেও যে অভিনয় সহায়ক সেট নির্মাণ করা সম্ভব তিনি এটা এ নাটকে প্রমাণ দিয়েছেন। সেন্টার আপস্টেজকে প্রাধান্য দিয়ে একটি তিন ফুট উঁচু একটি প্ল্যাটফর্ম, মঞ্চের দু’পাশে দু’টি স্টিয়ার প্ল্যাটফর্ম সিমেট্রিক্যাল ব্যালেন্স রক্ষা করে স্থাপন করেছেন। এই তিনটি প্ল্যাটফর্মের ত্রি-সম্পর্কের সেন্টার পয়েন্টটি মূল অভিনয়ভূমি হিসেবে নির্দেশক ব্যবহার করেছেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় এই সাজেস্টিভ রীতি নাট্যকাহিনীর প্রতিটি দৃশ্যকে সফলভাবে সাহায্য করেছে।
অভিনয়, কোরিওগ্রাফ ও নৃত্য এই তিনটিকে নাটক থেকে আলাদা করা যায় না। কোরিওগ্রাফ ও নৃত্য প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগের কাজটি অর্থী আহমেদ ও অলকা দাশ প্রান্তি সার্থকভাবে করেছেন। প্রারম্ভিক প্রস্তাবনায় সংস্কৃতনাট্যের প্রথানুযায়ী ভরতনাট্যমের ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীতে চরিত্রের মেজাজ, ধরণ ও স্ট্যাটাস অনুযায়ী তাদের মুভমেন্ট ও জেশ্চারে ভরতনাট্যম ও ওড়িশি মুদ্রার সংমিশ্রণ করা হয়েছে।
কস্টিউম ও প্রপস পরিকল্পনা ও প্রয়োগ খুবই সৃষ্টিশীল ও প্রাসঙ্গিক। নাট্যকাহিনীর স্থান, কাল, চরিত্র ও বয়স নির্ধারণে কস্টিউম ও প্রপস্ অন্যতম ভূমিকা পালন করে। মহাভারতের চরিত্র ও সময়কালকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপনে পোশাক ও প্রপসে যে রঙ, বুনন ও ধরণ ব্যবহার করা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। হালকা ধূসর রঙকে প্রাধান্য দিয়ে প্রত্যেকটি চরিত্রের কস্টিউম পরিকল্পনা করা হয়েছে, চরিত্রের মনন, মেজাজ ও শ্রেণির অন্তর্নিহিত ভাবকে প্রকাশের জন্য গাঢ় নীল, বেগুনী, লাল, সবুজ ও গেরুয়া রঙকে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যন্ত পরিমিতভাবে। ও প্রত্যেকটি প্রপস্ নাট্যঘটনাকে আলঙ্কারিক দৃশ্যকাব্য নির্মাণে সহযোগিতা করেছে। কস্টিউম ও প্রপস পরিকল্পক সৈয়দা ইফাত আরার ডিজাইনের কল্যাণে দর্শক খুব সহজে শকুন্তলা-দুষ্মন্ত নাট্যকাহিনীতে অবগাহন করেছে।
পুরো নাটকের আবহসঙ্গীত সরাসরি গীত ও বাদনের কল্যাণে অভিনয়ের ত্রিমাত্রিকতার সাথে আরও দু’টি মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। আবহসঙ্গীত পুরো নাটকের প্রাণ হিসেবে কাজ করেছে। নাটকের আবহসঙ্গীতেও যে রঙ দেখা যায় বা গন্ধ পাওয়া পাওয়া যায়- সেটা প্রমাণ করেছেন আবহসঙ্গীত পরিকল্পক মেহফুজ আল ফাহাদ। অর্কেস্ট্রা দলে মেহফুজ আল ফাহাদকে এস্্রাজে সহযোগিতা করেছেন তুষার মাহমুদ, বেহালায় সৈয়দা ফাহমিদা, পারকাশনে মোস্তাফিজুর রহমান।
মহাভারতের এই মহাকব্যিক গল্প অবলম্বনে মহাকবি কালিদাসের এই নাটক চিরকালীন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে নবতর বিন্যাসে নির্দেশক ক্ল্যাসিক গল্পকে মঞ্চফ্রেমে চিত্রায়ণ করেছেন। অভিনেতাদের দক্ষ মঞ্চবিচরণে নাট্যচরিত্রগুলো পরিপূর্ণতা পেয়েছে। শুকুন্তলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রওজাতুর রুম্মান কাশফি, রাজা দুষ্মন্ত রূপে মঞ্চে আসেন দেবাংশু পল্লব, অনসূয়া চরিত্রে ঐশী রহমান, মেনকা ও প্রিয়ংবদা দু’টি চরিত্রকে মঞ্চে উপস্থাপন করেন সৈয়দা প্রিয়তী সুুলতানা, কাশ্যপ ও ঋষি চরিত্রের মূলে কামরান আনান্দ, মুয়ান্না জ্বীলান নাটকের সূত্রধর, সেনাপতি ও মারীচ এই তিনটি চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন, বিশ্বামিত্র, কঞ্চুকি ও সারথি চরিত্রে মঞ্চে আসেন দেবদ্যুতি আইচ, বিদুষক চরিত্রকে রূপায়িত করেন আমির হামযা শোয়াইব, শকুন-হরিণ-সিংহশাবক তিনটি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন সারতাজ ইৎমাম চৌধুরী, গৌতমী ও অপ্সরীর নেপথ্যে ছিলেন মায়মুনা আলী নিরা, নটী ও বালক চরিত্রকে মঞ্চচলনে জীবন্ত করেছেন সাদিয়া জাহান হৃদি, দুর্বাসা মুনির চরিত্র রূপায়ন করেছেন তাবাসসুম মেহযাবীন, ঋষি ও শ্যালক চরিত্রে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন এ বি এইচ স্বপ্ন, শারদ্ব চরিত্রে আবদুল্লাহ আর তাসীম, জেলে চরিত্রে আহসানুল মারুফ, রাজপুরোহিত চরিত্রে ফাহিম ফয়সাল, রৈবতক, শার্ঙ্গরব, মাতলি এই তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোবাশ্বের হাসান। মঞ্চের আলোয় বিচরণ ও নেপথ্যের প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি হয় থিয়েটারের প্রতিটি ক্ষণ। টীমওয়ার্ক থিয়েটারের প্রাণ- এ নাটকে দর্শক অভিনয়ের রস আস্বাদনের পাশাপাশি থিয়েটারের প্রাণটা দেখতে পেয়েছেন। টীমওয়ার্কের এই প্রাণোচ্ছ্বল যুথবদ্ধতাই শকুন্তলা নাট্যপ্রযোজনাকে মানের দিক থেকে নান্দনিকতার এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
শকুন্তলা ভারতীয় উপমহাদেশের শাশ্বত নারী চরিত্রের একটি চিরায়ত রূপ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শকুন্তলা স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিয়ত সংগ্রামরত। উপেক্ষিত হয়ে নিদারুণ দুঃখ কষ্টে কাটে তার সময়। প্রমাণহীনভাবে মিথ্যাবাদী, কপট ও দুশ্চরিত্রার কালিমা লেপনা করা হয়। কালিদাসের শকুন্তলা চরিত্রের মতোই ভারতীয় নারীদেরও যুগে যুগে কালে কালে ক্ষমতা ও দাপটের কাছে প্রবঞ্চিত হতে হয়। শকুন্তলার ট্র্যাজিক ক্রন্দনধ্বনি মহাকাল ছাপিয়ে বর্তমান সময়েও তীব্রভাবে শোনা যায়। গভীর নিস্তব্ধতায় কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় দূর থেকে ভেসে আসা আমাদের শকুন্তলাদের গোপনক্রন্দন। সমকালের বিচাওে শকুন্তলা চরিত্রটি মহাভারত বা কালিদাসের সৃষ্টি থেকে উঠে আসা শুধুমাত্র একটি নাট্যিক চরিত্র নয়। শকুন্তলা সর্বযুগের, শকুন্তলা সর্বকালের। এজন্যই শকুন্তলা নারীচরিত্রটি হালআমলেও জীবন্তভাবে প্রাসঙ্গিক।
অভিনয়, কোরিওগ্রাফ, নৃত্য, উচ্চারণ, বিন্যাস, তাল, লয় ছন্দ, চলন, মঞ্চ, আলোক, কস্টিউম ও প্রপস, আবহসঙ্গীত প্রকাশনা, ব্যবস্থাপনা, সমন্বয়, যোগাযোগ প্রভৃতি নানা সৃষ্টিশীল প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর বিষয়গুলো এক সুরে বাঁধেন নিদের্শক। সকল ভালো ও মন্দের নির্বাহী হলেন নির্দেশক। পরপর দু’দিন হলভর্তি দর্শক শকুন্তলা প্রযোজনাটির ভালোর আলোই দেখতে পেয়েছেন। শকুন্তলা প্রসঙ্গে কবি ও নাট্যকার গ্যোটে’র স্বর্গ-মর্ত্য একত্রে দর্শনের যে অভিমত তা দর্শক এই প্রযোজনার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছে। আতিকুল ইসলাম নির্দেশিত শকুন্তলা নাট্যপ্রযোজনা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাট্যচর্চার মাইলফলক হয়ে থাকবে। সাধারণ দর্শকের প্রত্যাশা শকুন্তলা প্রযোজনাটির নিয়মিত প্রদর্শনী হোক। জয় হোক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের। জয় হোক থিয়েটারের।
ড. ইসলাম শফিক : গবেষক ও শিক্ষক।
[email protected]
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব