Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘কাঁটা’ একটি সিনেমা, একটি জার্নি


২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩:৪৯

আমি শহীদুল জহিরের লেখার ভক্ত। তার যে-কোনো ধরনের লেখা আমার অনেকবার করে পড়া। ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, ‘মুখের দিকে দেখি’, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’, ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ এসব উপন্যাস ও ছোটগল্প আমার একাধিকবার পড়া।

আমি ‘ব্ল্যাকআউট’ বানানোর পর থেকেই সিনেমার নেশায় ছিলাম, আছি। ‘কাঁটা’ স্টোরি এককথায়, সমগ্র বিশ্বেই সংখ্যালঘুরা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। যে যেখানে সংখ্যালঘু সে সেখানেই উৎপীড়নের শিকার। এই সত্য শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্পে বিদ্যমান।

বিজ্ঞাপন

যেমন, মিয়ানমারের মুসলিমরা কয়েকশো বছরের জীবনযাপনের বসতি ছেড়ে চলে আসছে। মিয়ানমারের কোনো বৌদ্ধকে কোথাও যেতে হয়নি। রামুতে বৌদ্ধরা আক্রান্ত হলো-এসব তো ঘটছেই। সাওতালরা আজ এদেশ থেকে প্রায় উধাও। সনাতন গোত্রের কতজন ভিটে ছাড়া, তার প্রকৃত হিসেব হয়তো নেই। এসব বিষয়ে প্রত্যেকের মতো আমারও সামাজিক সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমাদের ছবির ‘কাঁটা’র গল্পটা এমনই।

গল্পটিতে ১৯৬৪, ১৯৭১, ১৯৮৯-৯০ সালের প্রেক্ষাপট রয়েছে। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি বৌদ্ধ-যে যেখানেই সংখ্যালঘু, সেখানেই এই গল্পটি নিয়ে আমি দাঁড়াতে চাই।

এখন চলচ্চিত্র নির্মাণের শেষ  পর্যায়ে রয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাওয়ার পর  প্রথম সাড়ে তিন বছর ধরে চিত্রনাট্য ডেভেলপ করতে করতে একটি লেয়ারে নিয়ে গেছি। যা সিনেমাটির ব্যাকগ্রাউন্ড টিম, আর্টিস্ট টিমের সঙ্গে শেয়ার করেছি। বিশ্বে যত সিনেমা নির্মিত হচ্ছে- তার মধ্যে আমিও একটি সিনেমা বানাচ্ছি। আর সে ভাবনা নিয়েই কাজ করছি। সিনেমা বানানো শেষ না হওয়ার আগে তো বলা যাবে না, বানানোর পরে বলতে পারব আমরা কতটা পেরেছি বা বাস্তবতার নিরিখে ও বাজেটের আলোকে টিম কতটা পেরেছে বা আমি কতটা পেরেছি।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে পিরিওডিক্যাল সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। চিত্রনাট্য লেখার সময় আমি একাই লিখেছি কিন্তু নির্মাণের সময় ২৫০জন লোক কাজ করেছে। কাজটি কেমন হলো তা আসলে সব কিছুর শেষে বোঝা যাবে। আমি আত্মবিশ্বাসী, সম্পূর্ণটা দিয়েই কাজ করেছি।

সিনেমা নির্মাণ ব্যাপারটাই ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো দেশে বসে সিনেমা নির্মাণের ইচ্ছেটাই ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের বেঁচে থাকাটাইএখানে ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া বর্তমান সময়ের বাজার চলতি অভিনেতাদের উপর আমার তেমন ভরসা নাই। তারকাদের নিয়ে সিনেমা বানানোটা আমি খুব অপছন্দ করি। তারা কোনো না কোনোভাবে পুঁজির সিনেমা, বাণিজ্যিক সিনেমা, ফর্মুলার সিনেমার ক্ষেত্রে যায়। ‘কাঁটা’ তেমন সিনেমা নয়।

হতে পারে, আমার ইচ্ছে একটি শালিক পাখি দিয়ে অভিনয় করানোর। সেখানে আমি শালিক পাখিই নিয়েছি। কেউ আমাকে কোকিল সাধলে আমি নেব না। আমার টিয়া দরকার টিয়া নিয়েছি, ৫০ টা কবুতর দরকার  ছিল কবুতর নিয়েছি, বিড়াল দরকার বিড়াল নিয়েছি। ময়না নিয়েছি। ঘুঘু নিয়েছি। এজন্য আমি তারকা না নিয়ে আমার প্রয়োজন অনুযায়ী ২৫০ জন নতুন মুখ নির্বাচন করেছি। যাদেরকে এই সিনেমায় একসঙ্গে গাঁথার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া এতে এমন কজন অভিনয়শিল্পী রয়েছেন যারা আগে কখনো অভিনয় করেননি। এটা একটা ভালো লাগা। মনে রাখতে হবে, আমি বাজারি সিনেমা বানাচ্ছি না।

অনলাইন অডিশনে সিভি আসা নয়’শ আগ্রহীর মধ্যে ২৫০ জনকে নির্বাচন করে সাত মাস ধরে রিহার্সেল করিয়েছি। কোন চরিত্রে কাকে অভিনয় করানো যায় সে  ব্যাপারে  পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। রিহার্সেল করতে করতে চরিত্রের বদল হয়েছে। কে কতটা মনোযোগী, কে কতটা সিনেমা করতে উৎসাহী, কে কতটা তারকা হতে উৎসাহী আর কে কতটা সিনেমাকে ভালোবাসে এবং ‘কাঁটা’ সিনেমার নির্মাণব্রতকে রক্ষা করে কারা কতটা মনোযোগী- এই সবের ভেতর দিয়ে ২৫০জন অভিনয়শিল্পীকে গড়েছি। তারা সেটে থেকেছে মাসের পর মাস সময় ধরে। সেটে বসে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। চরিত্রের ভাব বিনিময় করেছি।

আমার জানা মতে, ঢাকায় এভাবে কাউকে সিনেমা নির্মাণ করতে দেখিনি। এদেশে আমার বন্ধুরা অনেক বড় বড় সিনেমা নির্মাতা। তাদের সিনেমা বানানো দেখেছি। তারা এখনো সিনেমা বানাচ্ছে। তারাও ভালো করছে। একটি টিম নিয়ে, শহীদুল জহিরকে নিয়ে, পুরান ঢাকার ভূতের গলি নিয়ে এবং একটি বিভ্রান্ত মহল্লাবাসীকে নিয়ে একটি জার্নিতে থেকেছি। যা নিয়ে একটি জায়গায় পৌঁছাতে চেষ্টা করেছি। এই জার্নির নাম ‘কাঁটা’।

এক্ষেত্রে ইচ্ছেকে ষোল আনা পূরণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের গল্পের বাস্তবতাই হচ্ছে ১৯৮৯-৯০, ১৯৬৪, ১৯৭১ সাল। ২০১৮-১৯ সালে এসে আমরা ওই সময়কে নির্মাণের চেষ্টা করেছি। ১৯৬৪ সালের লুকটি নির্মাণের চেষ্টা করেছি।  ১৯৭১, ১৯৮৯-৯০ সাল নির্মাণের চেষ্টা করেছি। শিল্পী ধ্রুব এষ, মাহমুদুর রহমান দীপন, তন্ময়, শক্তিসহ চারুকলার একদল শিল্পী ‘কাঁটা’ গল্পের প্রয়োজন মেটাতে আর্টিস্ট হিসেবে রাত দিন কাজ করেছেন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি নিজেও চারুকলার শিক্ষার্থী ছিলাম।

সিনেমাটি আমি মানুষকে দেখাতে চাই।  সিনেপ্লেক্স ছাড়াও পাবলিক অডিটোরিয়াম ভাড়া করে দেখানোর পথ তো চালু রয়েছেই। এছাড়া অনলাইন হাট রয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুদান সূত্রে আমিই সিনেমাটির প্রযোজক। সিনেমাটির সত্ব আমি কোথাও বিক্রি করিনি। যেকোনো জায়গায় এ সিনেমাটি আমি প্রজেক্টর কিংবা হল ভাড়া করে দেখাতে পারব।  প্রচলিত সিনেমা হলে মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে এক ধরনের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সে ধরনের শর্ত পূরণ না করে সিনেমা বানালে হল মালিকরা সেসব সিনেমা নেয় না। সামগ্রিক যে বাস্তবতা তার প্রেক্ষাপটে প্রেক্ষাগৃহ বা থিয়েটারে সিনেমাটি নিয়ে যাওয়ার চেয়ে অন্যভাবে মানুষের কাছে প্রদর্শনের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

সুবোধকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’ ২০১৬-১৭ সাল থেকেই ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিতি চিত্র দেখেছেন অনেকেই। সুবোধকে নিয়ে টকশো, পত্রিকার আর্টিকেল, ভিডিও চিত্র কত কিছু হয়ে যাচ্ছে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সুবোধ আসলে কে? সুবোধ বাংলাদেশের কোথায় থাকে? আপাতত কোনো মীমাংসা দেখা যাচ্ছে না। সুবোধকে নিয়ে গ্রাফিতি চিত্র হয়েছে নগর কলকাতার দেয়ালেও। এর অর্থ, সুবোধকে নিয়ে প্রশ্নের ডালপালা ছড়াচ্ছে। দেশের সীমানা ডিঙিয়ে বাইরেও। সুবোধের রহস্য থেকেই যাচ্ছে। শহীদুল জহিরের গল্প ‘মনোজগতের কাঁটা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। আমাদের জানা মতে, ‘কাঁটা’র প্রধান চরিত্র সুবোধচন্দ্র দাস, সুবোধের বউয়ের নাম স্বপ্নারাণি দাস। আমরা মানে ভূতের গলির মহল্লাবাসীরা জানি, ‘ছুবোধচন্দ্রের  বউয়ের নাম যেমন ছপ্নারানি দাস হয়, ছুবোদের বাইয়ের নাম ছবছম পরাণই হয়’।

সুবোধ যে হিন্দু তা যেমন সত্য, আরও সত্য সুবোধচন্দ্র দাস ঋষিপাড়ার ছেলে। অর্থাৎ সুবোধ বংশে মুচি বাড়ির ছেলে। বর্ণপ্রথায় একেবারে অচ্ছুত। তারপরও সুবোধচন্দ্র দাস সংসার করে পুরোনো ঢাকার ৩৬নাম্বার ভূতের গলিতে আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে, বউ স্বপ্নারাণি দাসকে নিয়ে; ভাড়া থাকে। এবং সুবোধ ঢাকায় সিনেমা হলে চাকরি করে। গ্রামে তার ভাই পরাণচন্দ্র দাস ও মা থাকে। বাবা এক দুর্গোপুজোর তিনদিন আগে গঞ্জের হাটে গিয়ে নিখোঁজ। এইটুকু তথ্য গল্পের নেপথ্য সত্য।

‘কাঁটা’ গল্পটি এককথায় সুবোধ-স্বপ্নার গল্প। সুবোধ ও তার বউ স্বপ্না গ্রাম থেকে এসে পুরোনো ঢাকায় ৩৬ নাম্বার ভূতের গলির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে ওঠে। বাড়ির উঠোনে একটি কুয়া আছে। সুবোধের বউ স্বপ্না উঠোনের কোণায় একটি তুলসীগাছ লাগায়। তুলসীগাছ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই  বাড়িওয়ালা অকৃতদার আব্দুল আজিজ ব্যাপারির, কিন্তু সমস্যা আছে ভূতের গলির মহল্লাবাসীদের, মহল্লাবাসী সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম।  সুবোধ-স্বপ্নারা একদিন কুয়ার মধ্যে পড়ে মারা যায়। পরে গ্রাম থেকে দাদা-বৌদির খোঁজে আসে এক যুবক, যুবকের নাম পরাণচন্দ্র দাস।

‘কাঁটা’ ছবিতে সুবোধের সংখ্যা চারজন, স্বপ্নাও চারজন। আর দু’জন পরাণকে দেখা যায়। ১৯৮৯ সালে ভূতের গলিতে প্রথম সুবোধ-স্বপ্নাকে দেখা যায়, যারা মারা পড়ে পরের বছর ১৯৯০ সালের অক্টোবরের ৩০ তারিখ কিংবা নভেম্বরের ১ তারিখে।  ১৯৭১ সালের সুবোধ-স্বপ্না হিসেবে এসে যারা মরে গেছে। ১৯৬৪ সালে এসে যারা মারে গেছে।

সম্ভবত ১৯৪৬ সালে আজিজ ব্যাপারির বাবা হোসেন ব্যাপারি বেঁচে থাকতে ৩৬ নাম্বার ভূতের গলির এই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে এসে যারা মরে গিয়েছিল, ৪৬ এর সেই সুবোধ-স্বপ্নার ছবি আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। এছাড়াও আরেক জোড়া সুবোধ-স্বপ্নাকে আমরা পেয়েছি যারা মহল্লাবাসীর অনুরোধে ভাড়াটিয়া হয়ে না উঠে ভূতের গলি ছেড়ে চলে যায়। চারুকলার লোক হিসেবে সবসময় উপস্থিত ছিলেন ‘কাঁটা’ ছবির আর্ট ডিরেক্টর শিল্পী মাহমুদুর রহমান দীপন । ছবির ডিওপি তাইজুল ইসলাম রোমান। স্টিল করেছেন হোসেন আতাহার। স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার  তাহুয়া লাভিব তুরা। এবং সহকারি হিসেবে কাজ করেছে একদল তরুণ।

‘কাঁটা’ ছবির শুটিং শেষ, এখন সম্পাদনা-সাউন্ড-মিউজিক-গান, অ্যানিমেশন-সিজি-গ্রাফিক্স-টাইটেল নির্মাণের পালা, ছবি যাবে সেন্সর বোর্ডে, তারপরেই তো দর্শক দেখতে পাবেন ‘কাঁটা’। ‘কাঁটা’ কিংবা সুবোধ-স্বপ্না-পরাণ ও আজিজ ব্যাপারির গল্প। আপাতত অপেক্ষা করুন। অপেক্ষা বড় মধুর।

লেখক: ‘কাঁটা’ সিনেমার পরিচালক, কবি

কাঁটা টোকন ঠাকুর শহীদুল জহির সিনেমা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর