জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া এক ক্ষ্যাপা শিল্পস্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক
৪ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:০৩
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন একরোখা মানুষ। কারও কারও মতে তিনি স্পর্ধা ছাড়িয়ে যাওয়া বেপরোয়া মানুষ। আবার কেউ কেউ তাকে বেয়াদব বলে সম্বোধন করেন কথা প্রসঙ্গে। কিন্তু তিনি যে প্রচন্ড রকমের মেধাবী একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন, সে বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না।
বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের সিনেমার কথা উঠতেই সর্বাগ্রে যে কয়েকজন মানুষের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের অবস্থার শীর্ষে। আদর্শের লড়াই, মাথা না নোয়ানো মজবুত শিরদাঁড়ার যে কতিপয় মানুষকে চলচ্চিত্র জগত পেয়েছে ঋত্বিক যথার্থই তার অন্যতম স্তম্ভ।
আজ সেই স্তম্ভের ৯৪তম জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রচুর লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঋত্বিক ঘটকের পরিবার কলকাতায় চলে যায়। শরণার্থীদের অস্তিত্বের সংকট তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। যা পরবর্তী জীবনে তার চলচ্চিত্রে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাভাগ, গণনাট্য আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনৈতিক অশান্তি, শরণার্থী যন্ত্রণা তীব্রতরভাবেই তার প্রায় সকল সিনেমাতেই উঠে এসেছে। বিনোদনের মূল ধারার পাশে ঋত্বিক ও তার সৃষ্টি যেন সমান্তরালে চলা অন্য এক মহাবিশ্ব, সেখানে স্পষ্টবাদিতা, আদর্শ, আর সবহারা মানুষের বেঁধে থাকা, আর মাথা উঁচু করে বাঁচার গল্পই শেষ কথা। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘কোমলগান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র মতো তার চলচ্চিত্রগুলো কিংবদন্তি হয়েই থেকে যাবে।
ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায় সমসাময়িক ছিলেন। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, ঋত্বিক নাকি কখনো সখনো মাতাল হয়ে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে অপমানসূচক কথা বলতেন। যার কারণে একবার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জী তার কলার চেপে ঘরে ঘুষি মেরেছিলেন।
ঋত্বিক বলেছিলেন, আমি সত্যজিৎ রায় নই এবং ‘ভদ্রলোক’ও নই। তিনি তখন এতটাই মাতাল ছিলেন যে স্টেজে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। তাকে তখন স্টেজ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
মাতাল হওয়ার কারনে ঋত্বিক ঘটককে সৌমিত্র চ্যাটার্জী অপছন্দ তো করতেনই, সেই সাথে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করার কারণে তাকে একরকম সহ্য করতে পারতেন না। কারণ, সত্যজিতের ছবি দিয়েই তো সেলুলয়েডে অভিষেক হয় তার। এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন, ঋত্বিকের বহু খারাপ স্বভাব ছিল। উনি মানুষকে নিজের মতো করে চালাতে চাইতেন। সত্যজিৎ রায়কে অকারণে অপমান করতেন।
তবে সৌমিত্র চ্যাটার্জী খুব করে চেয়েছিলেন ঋত্বিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্যে তিনি তার সঙ্গে ছবিও করতে চেয়েছিলেন। তিনি তখন একজন সফল অভিনেতা। তারকাখ্যাতি পেয়ে গিয়েছেন। একারণে তিনি থাকলে সহজেই প্রযোজক পাবেন ঋত্বিক। ঋত্বিক চেয়েছিলেন ‘সংসার সীমান্তে’ করতে। প্রযোজকের সঙ্গে একটা মিটিং ঠিক হল। কিন্তু সবাই বসেই আছেন, ঋত্বিক আর আসেন না। অনেক পরে প্রবল মাতাল হয়ে ঋত্বিক আসেন। দাঁড়াতেও পারছিলেন না।
পরবর্তীতে শুটিং প্যাকআপ হলে তবেই ঋত্বিক মদ খেতে পারবেন—এমন শর্তে ছবি করতে রাজি হয়েছিলেন। আর যদি মদ খেয়ে শুটিংয়ে আসেন, তাহলে লাথি মেরে বের করে দেবেন। এরপর ঋত্বিকের সঙ্গে আর ছবি করা হয়নি। এর আগে ১৯৬১ সালে ‘কোমল গন্ধার’ ছবিতে সৌমিত্রকে প্রস্তাব দিলেও অভিনয় করেননি।
নির্মাতা হিসেবে সৌমিত্র বরাবরই ঋত্বিককে প্রশংসা করতেন। যদিও সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাকে তুলনা করলে রেগে যেতেন। সত্যজিৎ রায়ের সাথে ঋত্বিক ঘটকের তুলনা সৌমিত্র মেনে না নিলেও চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতো তিনি সত্যজিতের সমতুল্য। তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা আর চলচ্চিত্র নির্মাণের অগ্রদূত বলা হয়।
তবে সত্যজিৎ রায় সবসময় ঋত্বিক ঘটকের প্রশংসা করতেন। এমনকি তিনি ঋত্বিককে নিজের থেকে বেশি বাঙালি বলে আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল—আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেটাই তার সবচেয়ে মূল্যবান ও লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
ঋত্বিক মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। উল্কার মতো জ্বলে ওঠা ধুপ করে নিভে যাওয়া এক ক্ষ্যাপা শিল্পস্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক।