Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কণ্ঠ: শুধু সিনেমা নয়, একটি হেরে না যাওয়ার গল্প


১২ নভেম্বর ২০১৯ ১৩:৪৪

সিনেমার যে বিস্তৃত জগতটা চারপাশে মানুষের মনে অবস্থান করে, সেই জগতটা কখনো সখনো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিছু সিনেমা মানুষকে হিংস্র করে তোলে। কিছু সিনেমা মানুষকে প্রেমে পড়তে শেখায়। আবার কিছু সিনেমা নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। হারতে হারতে কিভাবে জিতে যেতে হয় সেটাও শিখিয়ে দেয়।

প্রেক্ষাপট: ‘কণ্ঠ’

সিনেমা নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে একবার কাহিনীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা যাক। ‘কণ্ঠ’ মূলত ত্রিমাত্রিক লড়াইয়ের গল্প। একজন কণ্ঠ হারানো মানুষের ‘কণ্ঠ’ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টার চলমান চিত্র। সেই চলমান চিত্রের তিন চরিত্র—অর্জুন, পৃথা ও রোমিলা।

অর্জুন জনপ্রিয় রেডিও জকি। তার আকর্ষণীয় কণ্ঠের জাদু মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত শ্রোতাদের। এভাবেই চলছিল সব ঠিকঠাক। বিপত্তিটা বাঁধলো শ্রেষ্ঠ বাচিক শিল্পীর পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠে। মাইক্রোফোনে কথা বলতে গিয়েও হঠাৎ করে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না।

চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি। চিকিৎসক জানালেন তার কণ্ঠনালীতে বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ। এখনই কণ্ঠনালী কেটে না ফেললে বেঁচে থাকা যাবে না। একরকম বাধ্য হয়ে কেটে ফেলতে হলো কণ্ঠনালী। কিন্তু কথা ছাড়া তো একজন রেডিও জকির জীবনটাই বৃথা। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি সোজা চলে গেলেন স্পিচ থেরাপিস্ট রোমিলার কাছে। রোমিলা প্রথমে রাজি না হলেও পরে ঠিকই রাজি হন। শুরু হয় কণ্ঠ ফিরে পাওয়ার লড়াই।

সামগ্রিক পর্যালোচনা

মাঝে মাঝে এমন হয় যে, পরিচালক সিনেমা নির্মাণের আগে কল্পনায় যেভাবে দৃশ্যায়নের স্কেচ এঁকে ফেলেন, বাস্তবে তার এদিক সেদিক হয়ে যায়। কিন্তু ‘কণ্ঠ’ ছবির পরিচালকদ্বয় নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ যেভাবে কল্পনায় ছবির দৃশ্য স্কেচ করেছেন, বাস্তবে তার শতভাগ মিলে গেছে বলে মনে হলো। বরাবরের মতোই দৃশ্যের সৃজনশীলতা থেকে আরম্ভ করে গান প্রতিস্থাপনে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক জুটি।

অর্জুন চরিত্রের অভিনেতার নাম শিবপ্রসাদ, যিনি এই ছবির পরিচালকদ্বয়ের একজন। ছবিতে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত সব মানুষের প্রতিনিধিরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। অর্জুন কথা বলতে চান। তার স্ত্রী পৃথা চান, তার স্বামী আবার কথা বলুক। পৃথা চরিত্রের অভিনেত্রী পাওলি দাম।

বাংলাদেশে ‘কণ্ঠ’ মুক্তি পাওয়ার একদিন আগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাথে আছেন জয়া আহসান ও নন্দিতা রায়। ছবি: আশীষ সেনগুপ্ত

বাংলাদেশে ‘কণ্ঠ’ মুক্তি পাওয়ার একদিন আগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাথে আছেন জয়া আহসান ও নন্দিতা রায়। ছবি: আশীষ সেনগুপ্ত

কণ্ঠনালী তো নেই। কিন্তু কথা কিভাবে বলবে তার স্বামী। কণ্ঠহীন ভালোবাসার মানুষের মলিন চেহারা। অস্থিরতা। হতাশা তো চোখে দেখা যায় না। পাওলি নিজেও হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তখন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন রোমিলা তথা জয়া আহসান।

স্ত্রী হিসেবে ছবিতে পাওলি দাম পর্দায় বেশি উপস্থিত থাকলেও তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভালো অভিনয় করেছেন। তবে মনে হয়েছে ছবিতে অঘোষিত প্রতিযোগিতা হয়েছে শিবপ্রসাদ ও জয়া আহসানের মধ্যে।

স্পিচ থেরাপিস্ট রোমিলা যেভাবে ইসোফেগাল বা খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলেছেন, সেভাবে কথা বলা চাট্টিখানি কথা নয়। নিশ্চিত করে বলা যায়, এই সিনেমা দেখার সময় অধিকাংশ দর্শক নিজের খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন হয়তো। কিন্তু সফল হননি।

রোমিলা যেভাবে অর্জুনকে তালিম দিচ্ছিলেন তাতে মনে হতে পারে তিনি আসলেই স্পিচ থেরাপিস্ট। অর্জুনও যেভাবে রোমিলার মতো করে ইসোফেগাল কণ্ঠে কথা বলেছেন তা অনবদ্য। মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিল একজন অন্যজনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

ছবিতে রোমিলা বাংলাদেশের ফরিদপুরের মেয়ে। ছবির পরিচালক জুটি শুরু থেকে জয়াকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে এক্ষেত্রে তারা বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ‘বাঙাল’ ভাষা বলতে খাইতাছি, যাইতাছি, খাইছোস কিংবা গেছোস জাতীয় ভাষাই বোঝে। আসলে এটা যে সঠিক বাংলাদেশি অ্যাকসেন্ট নয় সেটা জয়া আহসান স্বভাবসুলভভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশে ২২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘কণ্ঠ’। মুক্তির একদিন আগে ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘কণ্ঠ’। মুক্তির একদিন আগে ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। ছবি: সংগৃহীত

ছবিতে বিশেষ একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। রোমিলা যখন তার প্রচেষ্টায় সফল। খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলতে শিখে গিয়েছেন অর্জুন। দীর্ঘ সময় একসাথে কাটানোর পর মনের কোনে একটু ভালোলাগা জন্ম নেওয়াটা স্বাভাবিক। নারী-পুরুষের মধ্যে এরকম সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক। না চাইতেও হয়ত অর্জুন আর ডিভোর্সী রোমিলার মনের এক কোনে ভালোলাগার জন্ম নিয়েছিল। সেই ভালোলাগা যে ‘ভালোবাসা’ বলা যায় তাও না। হয়ত সেটা ভালোবাসায় রূপ নিতে পারত যদি না রোমিলা সচেতনভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারতেন। পৃথা যখন তাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহের দ্বারপ্রান্তে, তখন সেই সন্দেহ ভাঙিয়ে দেন রোমিলা।

ক্যানসারের কাছে হেরে যাওয়া মানুষের যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে শিবপ্রসাদ, সেই যন্ত্রণা কমিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার বার্তা নিয়ে আসা জয়া আহসান আর জীবনের খারাপ সময়ে স্বামীর পাশে থাকা পাওলি দাম— এই তিনজনই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন জীবন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র হলেও সহজে হেরে যাওয়া যাবে না।

এই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে না বললেই নয়। বেশকিছু সুন্দর শট এই সিনেমায় দেখা গিয়েছে। কণ্ঠ হারানোর পর অর্জুনের ঘরে যে আলো-আঁধারির শট নেওয়া হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কণ্ঠ হারিয়ে অর্জুন দুর্বিষহ জীবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন সেটার দ্যোতনা এই শটগুলোতে উঠে এসেছে।

কণ্ঠ’ সিনেমা ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ‘কণ্ঠ’ মুক্তি পেয়েছে। যার কারণে বাংলাদেশের মানুষ ছবিটি দেখতে পারছে। অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশে এধরনের ছবি নির্মিত হবে কিনা সন্দেহ! বাংলাদেশে যে ফর্মূলা সিনেমা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের রুচি বদলেছে বলেই এধরনের সমান্তরাল সিনেমা রমরমিয়ে চলছে।

আমাদেরও রুচি বদলাচ্ছে। তবে সিনেমার গল্প বদলাচ্ছে না। ফমূর্লা ছবির পাশাপাশি যদি বিষয়ভিত্তিক ছবির নির্মাণ হয় বাংলাদেশে, তাহলে সিনেমার ভগ্নদশা থাকবে না বলা যায়।  সেজন্য সবার সদিচ্ছা প্রয়োজন।

কণ্ঠ টপ নিউজ রিভিউ সিনেমা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর