“মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা
মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা
মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান
মানুষ আসতে আছে মহররমের ধুলার সমান…”
আজ থেকে ঠিক ৪৩ বছর আগে ১৯৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর, ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চ। সূচিত হলো এক অনন্য ইতিহাস। সেদিন প্রথম অভিনীত হলো কালজয়ী কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। যা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে মঞ্চায়িত নাটক। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে আর কোনো নাটক নেই যা ৪৩ বছর ধরে মঞ্চায়িত হচ্ছে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত এবং আবদুল্লাহ আল-মামুন নির্দেশিত কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। যাকে বলা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং সেই সময়কার গল্প গুণেই সমৃদ্ধ ‘থিয়েটার’র এই প্রযোজনাটি। প্রথম মঞ্চায়ন থেকেই রচনাশৈলী, বিষয়বস্তু ও প্রকাশনা সৌকর্যের জন্য দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এই নাটকটি। যা অদ্যবধি বিদ্যমান। শুধু বিষয় বা উপস্থাপনাই শুধু নয়, কাব্যনাট্যের নিরীক্ষা ও শিল্পশৈলী বিচারে ভাষার গীতময়তা, আঞ্চলিক শব্দের কৌশলী প্রয়োগ এবং যুদ্ধকালীন জীবন বাস্তবতার কাব্যিক উচ্চারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে একটি পালাবদলকারী নাটক। মঞ্চায়নের প্রথম বছরেই নিয়মিত অভিনয়ে বাংলাদেশে মঞ্চায়নের প্রথম সুবর্ণজয়ন্তী পালনের গৌরব অর্জন করে থিয়েটার’র এই নাটকটি।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের নাটক। যুদ্ধ চলাকালীন একটি খণ্ড ঘটনা। এই ঘটনায় স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি তবে জাতীয় পতাকা দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখানেই এই নাটকের সার্থকতা। মুক্তিযুদ্ধে জীবনদান করা বা জীবন বাঁচানোর কৌশল এই নাটকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা কত নির্মম ছিল ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে, তার সাক্ষাত এখানে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে পীর সাহেব, মাতব্বর এবং মাতব্বরের মেয়ের চরিত্রের মাধ্যমে আমরা একটি ঘটনাকে পরিস্ফুটিত হতে দেখি। গ্রামবাসী যখন বলতে থাকে মুক্তিবাহিনী আসছে, তারা বাজার বন্দর দখল নিচ্ছে এবং নতুন নিশানা উড়াচ্ছে। কিন্তু এটা তারা দেখেনি, শোনা কথা। তখন মাতব্বর বলে…
“নিজ চক্ষে দ্যাখো নাই সেটা বোঝা যায়,
চক্ষুর চেয়েও দূরে দুই কান যায়,
শোনো নাই মানুষের মরণ-চিৎকার?
আওয়াজ কি পাও নাই আগুন লাগার?
দ্যাখো নাই সেই তাপে লাল আসমান
ভোরের আগেই এক ভয়ানক ভোরের লাহান?”
মূলকথা মাতবর যখন পাকিস্তানিদের পক্ষে তখন তার কানে মুক্তিবাহিনীর কথা কিছুতেই ঢুকবে না। সেজন্যই মাতব্বর উঁচু গলায় বলতে পারে… “সৈন্যের সাথে কি পারে মাটির কিষাণ?”
মাতব্বর পীরকেও নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টা করে। পীরকে বুঝিয়ে বলতে বলে গ্রামবাসীকে যে আমাদের জয় হবে। গ্রামবাসী ও মাতব্বরের মধ্যে যখন এমন বাদানুবাদ চলতে থাকে তখন মাতব্বরের মেয়ে এসে গ্রামবাসীকে শান্ত হতে বলে। সবাই আর্শ্চয হয় এবং মাতব্বর আতঙ্কিত হয়। মেয়ে তার বাবার মুখোশ খুলতে চেষ্টা করে বলে…
“কেউ যাইতে চায় না বাজান, ক্যান জানতে চান?
নিজের মুখের দিকে একবার নিজেই তাকান
কি দেখতে পান?”
মাতব্বর মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে পরে। হাতে পায়ে ধরে মিনতি করে মেয়েকে ঘরে যেতে বলে। কিন্তু মেয়ে গতরাতের ঘটনা খুলে বলে। কিভাবে তাকে মিলিটারির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। মাতব্বর নিজেই কলমা পড়িয়ে মেয়েকে মিলিটারির সাথে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গভীর রাতেই সে চলে গেছে। এই বিশ্বাসঘাতকের কথা মেয়ের কণ্ঠে এভাবে এসছে…
“জিজ্ঞাসা করেন তারে, এক রাত্রি পরে
সাধের জামাই তার নাই ক্যান ঘরে?
রাত্রি দুইফরে
সে ক্যান ফালায়া গেল আমার জীবন
হঠাৎ খাটাশে খাওয়া হাঁসের মতন?”
এই উক্তি দিয়ে তার সর্বনাশের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝানো হয়েছে। শেষে মেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করে এবং নিজের পাইকের ফলায় খুন হয় মাতব্বর। বুঝিয়ে দেয়া হয় অনেক আত্মহত্যা, অগ্নিকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। সবশেষে পতাকার ওপর আলো থাকে। বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এই আলোই জাতির ভবিষ্যত।
নাটকটিতে কোন দৃশ্য বিভাজন নেই। একটানা কাহিনীর শ্রোত বয়ে চলেছে। গ্রামবাসীর সংলাপ দিয়ে শুরু। জানা যায় ১৯৮১ সালের ২০ মার্চ দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আইটি আই আয়োজিত বিশ্ব নাট্য উৎসবে এই নাটকের দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। যা ছিল ভারতের বাইরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কোনো নাট্যদলের প্রথম অভিনয় প্রদর্শন। ১৯৮৭ সালের ২৫ মার্চ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাদদেশে এই নাটকটির অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯০ সালের ২৩ মার্চ নাটকটির শততম প্রদর্শনী হয় এবং স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ নাটক হিসেবে থিয়েটার’র এই নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচার হয়।
২০০২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কলাকুশলী সংকটের কারণে নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ ছিল। ১০ বছর বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় এই নাটকের প্রদর্শনী। নতুন প্রযোজনায় নির্দেশনার দায়িত্ব দেয়া হয় সুদীপ চক্রবর্তীকে। নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে দলকে গঠন করে আবার মঞ্চে নিয়ে আসা হয় কালজয়ী নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
এই ৪৩ বছরে প্রায় ৭০ জন অভিনেতা বিভিন্ন পর্যায়ে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে অভিনয় করেছেন। তাদের মধ্যে ফেরদৌসি মজুদার অন্যতম, যিনি সবগুলো প্রদর্শনীতেই অভিনয় করেছেন। এছাড়াও আবদুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আব্দুল কাদের, তারিক আনাম খান, মিতা চৌধুরী, তারানা হালিম, খায়রুল আলম সবুজ, আরিফুল হক প্রমুখের মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা বিভিন্ন সময়ে এ নাটকে অভিনয় করেছেন।
সম্প্রতি আইডিএলসি আয়োজিত নাট্য উৎসবের শেষ পরিবেশনা ছিল থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। শনিবার(২৩ নভেম্বর) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় এটি প্রদর্শিত হয়।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। তার প্রথম এই কাব্যনাট্য মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবেই অধিক পরিচিত। এই নাটকের ভূমিকায় সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘শিল্পক্ষেত্রে আমার আর এক সংসার নাটক’।
সত্যিই এই নাটকের মধ্য দিয়ে শিল্পী তার র্দশক-পাঠকদের বৈচিত্রের স্বাদ উপহার দেন। এ গল্পে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিংবা গ্রামবাসীদের সঙ্গে মাতব্বরের দ্বন্দ্বের ভেতরে উত্তেজনাকর মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসেনি, কিন্তু বাস্তবত মুক্তিযুদ্ধই পুরো কাহিনীর অস্থিমজ্জা, যার শেষ মুহুর্তে মাতব্বর শুনছেন…
“পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার
শত শত হাজার হাজার
দৌড়ায় আসতে আছে এখানে এবার …”
এই পায়ের আওয়াজ আসলে মুক্তিপাগল মানুষের আওয়াজ। যে পদধ্বনি রাজাকার মাতব্বরদের মতো শোষকদের ভীত করে তোলে।