মনে করবা তুমিই রাজা, বাকি সব তোমার প্রজা
৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৯:০০
৬ডিসেম্বর ‘চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা’ তারেক মাসুদের ৬৪তম জন্মদিন। এ দিনে তার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি ‘রানওয়ে’র ‘রুহুল’ চরিত্র অভিনয় করা ফজলুল হক তাকে নিয়ে করেছেন স্মতিচারণ।
টেলিভিশনে অভিনয় করার শখ আমার শৈশব থেকেই। মনে আছে একদিন বাবা বলেছিলেন, তুই অন্য কাউকে বাবা-মা ডাকতে পারবি? বলেছিলাম, হ্যাঁ পারবো। এটা তো অভিনয়। সত্যি তো না।
থিয়েটার চর্চার সাথে যুক্ত ১৯৯৯ সাল থেকে। স্থানীয় থিয়েটারসহ টেলিভিশনে টুকটাক কাজের চেষ্টা করি। কিন্তু চলচ্চিত্রে বড় সুযোগ পাবো কখনো, এমন ভাবনা কল্পনাতেও আসে নাই।
সুযোগটা পেলাম ২০০৮ তে এসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এর আগে আমি তারেক মাসুদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না।থিয়েটারের এক সূত্রের মাধ্যমে তারেক ভাইয়ের বাবর রোডের অফিসে ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুহুলের অডিশনের জন্য যাই। সেদিন মা চরিত্রেরও অডিশন হয়েছিল। অধিকাংশকেই দেখলাম অনেক দক্ষ অভিনেতা। আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম।
তারেক ভাইয়ের একজন সহকারি এসে সংলাপ লেখা একটি পাতা ধরিয়ে দিলেন। ক্যামেরার সামনে বলতে হবে। পরীক্ষার পড়ার মতো গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত মুখস্থ করার চেষ্টা করতে থাকলাম।
তারেক ভাই, ক্যাথরিন আরো অনেকে ছিলেন সেদিন। ভাইয়াকে দেখলাম অন্যদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখছেন। হঠাৎ চোখাচোখিতে মৃদু হাসি দিলাম। কিন্তু তার কোন ভাবান্তর পেলাম না। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। যেন আমার ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করছেন। স্ক্রিপ্ট পড়ার বাইরে আমি অন্যদের সাথে কিভাবে কথা বলি, হাসি, দুষ্টামি করি সব গভীরভাবে পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দেখছিলেন।
আমি যে ফেল, সংলাপ বলার সময়ই টের পাচ্ছিলাম। সংলাপ বলার চেয়ে সুন্দর করে ঢোক গিলছিলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ! অন্যরা আমার চেয়ে ভালো অনেক ভালো করেছিলো। আমাকে জানানো হলো প্রয়োজন হলে কল করে জানানো হবে।
আরেকদিন ডাক পড়লো। এবার তুলনামূলক ভালো করলাম। বুঝতে পারলাম কিছুটা সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি পাভেল নামে একটা ছেলে অনেক ভালো করলো। বয়সে আমার কাছাকাছি। আমাদের দুজনের মাঝেমধ্যেই একসাথে ডাক পড়তো। আমাদের ভালো আলাপচারিতা জমে উঠলো। দুজনেই বুঝতে পারছি যেকোনো একজন বাদ পড়বো। কে সে তখনো জানি না!
এক বিকেলে তারেক ভাইয়ের সহকারী আবু শাহেদ ইমন বললেন, ফজলু ধরো তুমি রানওয়ের প্রধান চরিত্র রুহুল করতে পারলে না৷ তোমাকে দেয়া হলো রুহুলের বন্ধু আরিফ চরিত্রটি৷ তুমি কি করবেনা? বললাম, করবোনা কেন! অভিনয় অভিনয়ই৷ ছোট হোক আর বড় হোক। তাছাড়া এই ফিল্মে অভিনয় করাটাই বড় আনন্দের ও গর্বের হবে। ইমন ভাই বললেন, হুম। দেখো এমন অনেক মুভি আছে, যেখানে ছোট রোল করেও অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম পিছিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্নের চরিত্রটি করার সুযোগ বোধহয় আর পাচ্ছি না।
সন্ধ্যার খানিক পরে আরেকদিন কল এলো।
মোহাম্মদপুর থেকে দ্রুতই ভাইয়ার অফিসে গেলাম। সেখান থেকে আমাকে ভাইয়ার বাসায় যাওয়ার জন্য বলা হলো। তারেক মাসুদের সুপার জিএল গাড়িটি আমাকে তার মনিপুরী পাড়ার বাসায় নিয়ে এলো। আমি ভাবছি হঠাৎ এখানে কেন ডাক পড়লো? কোন দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে না তো! নাকি সুসংবাদই অপেক্ষা করছে!
ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তারেক ভাই তার রুমে ডেকে নিলেন। আয়নায় নিজের সাথে নিজে কথা বলার দৃশ্যটি করে দেখাতে বললেন। আয়নার ও বাস্তবের আমির জন্য দুই রকম কণ্ঠে অভিনয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তিনি বিভিন্নভাবে বলালেন আমাকে দিয়ে।
একদিন বিকেলে তারেক ভাইয়ের অফিসে ডাক পড়লো আর জানানো হলো কাঙ্ক্ষিত সুসংবাদ। আমি ফাইনালি সিলেক্টেড হয়েছি!
এরপর খলিফা ডেকে আমার ড্রেসের মাপ নেয়া হলো। আগের নির্দেশনানুযায়ী দাঁড়ি গোঁফ কাটিনি অনেকদিন। নাপিত অফিসে এসে, দাড়ি গোঁফ প্রয়োজন মতো কাটছাট করলেন। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলাম।
আউটডোরে প্রথমদিনে শুটিংয়ের ঘটনা। চারপাশে লাইট, ক্যামেরা মিলিয়ে অনেক লোক। গরুর বাছুরকে টেনে ধরে সংলাপ বলতে হবে। অ্যাকশন বলার সাথে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পাজি বাছুরটাও ইতরামি শুরু করলো। কি যে মুশকিল!
আবারও টেক নেওয়া হলো, সাবলীলভাবে করতে পারছি না। তারেক ভাই এসে অভিনয়টা করে দেখালেন। উনি যেভাবে দেখালেন সেভাবে করার চেষ্টা করলাম। আরও কয়েকবার দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু কেমন জানি অস্বস্তি লাগছিলো।
উত্তরা এয়ারপোর্টের পাশে আমরা শুটিং করছিলাম। দুপুরের খাওয়া শেষে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে বললেন, তুমি যখন অভিনয় করবা, তখন মনে করবা তুমিই রাজা, বাকি সব তোমার প্রজা। ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান কেউ কিছুই না তখন। তুমিই সব। তুমি ছাড়া কিচ্ছু চলবে না। চারপাশে যত লোকজন আছে, সব তোমার জন্য। তুমি তোমার মতো করে স্বাধীনভাবে অভিনয় করবা। কোনো ভয় নাই তোমার। ভালো হোক, মন্দ হোক, কিচ্ছু ভাববা না তুমি। কোনো টেনশন নিয়ে অভিনয় করবা না। এইখানে তুমি রাজা। আর রাজার জন্যই সব৷
তারেক ভাইয়ের বাচনভঙ্গিতে, উচ্চারণে, সান্নিধ্যে, দৃষ্টিতে, কথার মধ্যে কী যাদু ছিলো তখন জানিনা! আমি অনেক সাহস পেলাম। আত্নপ্রত্যয় জেগে উঠলো ভিতরে। কাঁদামাটির মতো বদলাতে শুরু করলাম।
শুটিংয়ের মাঝে একটা গ্যাপ ছিলো। অপেক্ষা করতো হলো। কিন্তু কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর আমার মনে হলো দাঁড়ি-গোফ বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই আয়নার সামেন দাঁড়িয়ে ছোট করা শুরু করলাম। কিন্তু একপাশ বড় তো আরেক পাশ ছোট। একটা সময় আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হল, শুটিংয়ের সময় গোঁফ যেমন ছিলো, তারচেয়ে কম লাগছে এখন। সর্বনাশ!
একশো সাত ডিগ্রি টেনশন নিয়ে তারেক ভাইয়ের অফিসে কল করলাম। উনার সহকারী যারা ব্যাপারটা শুনে রীতিমত আঁতকে উঠলেন! করেছো কি? কাল শুটিং। তোমাকেই কল করতাম এখনই। এটা কি করেছো! উফফ! দাঁড়াও তারেক ভাইয়ের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।
দুমিনিটের মধ্যে কলব্যাক করে অফিসে যাওয়ার জন্য বলা হলো।
আগে থেকে তারেক ভাইয়ের গাড়ি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। যেতে যেতে ভাবছিলাম ভাইয়া কী রাগটাই না করবেন। কত বড় বোকামিটা করে ফেললাম। আমার জন্য না জানি শুটিংটা বাতিল করে দেন। ধুরু ধুরু বুকে গিয়ে তার বাসার কলিং বেল টিপলাম।
দরজা খুললেন তারেক ভাই নিজে। আমাকে দেখে আঁতকে উঠলেন না। কড়া কথাও বললেন না। শুধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। যথেষ্ট শান্তভাবে বললেন, আসো ভিতরে আসো।
আমি মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একটু রাগও করলেন না! এমনটা কেউ করলে আমি হলেও রাগ করতাম। তারেক ভাই! সেদিন, সে মুহুর্ত, এখনও ঠিক সিনেমার পর্দার মতো মনের পর্দায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।
‘রানওয়ে’ শুটিংয়ের সময় দেখেছি তারেক ভাই কতোটা গোছানো মানুষ। প্রতি শুটিংয়ের আগের রাতেই কয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে, কখন কোথায় শুটিং, কার কখন শট ও সর্বোচ্চ কতটার মধ্যে শুটিং শেষ হবে তার একটা নোট দিতেন। দারুন আরামের ব্যাপার ছিলো, যেদিন খুব ভোর থেকে শুটিং শুরু সেদিন খুব রাতে শুটিং রাখতেন না। যেদিন রাত একটু বেশি হয়ে যেতো, তারপর দিন পুরো সকাল আমরা ফ্রি। শুটিং শুরু হচ্ছে আবার বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায়।
পরিচালক তারেক মাসুদ শুধু নয়, ব্যক্তি তারেক মাসুদও অসাধারণ। একদম অপরিচিত নতুন কোন নির্মাতা, চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্ট যে কেউ অথবা সাধারণ মানুষ, তার সাথে দেখা করতে চাইলে, কথা বলতে চাইলে তিনি সময় দিতেন।
আমার পিদিম থিয়েটার নামে ছোটদের একটা সংগঠন আছে। তারেক ভাই কি কাজে তখন নিউইয়র্কে। স্কাইপিতে তিনি খবর নিয়েছেন আমার পরিবার ও সংগঠনের। কেমন করে একজন মানুষ এতো ব্যস্ত থেকেও সকলের বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেন আমি মুগ্ধ হয়ে তার ব্যক্তিত্বের মহানুভবতা বোঝার চেষ্টা করি কি অসাধারণ!
তারেক ভাইয়ের বাসায় যে কয়েকদিন গিয়েছি দেখেছি বাসার কাজের লোক সব যেন তার আপন পরিজন। তিনি খুব রসিকতাও করতেন। ছোটখাটো অনেক বিষয় নিয়ে মজা করে কথা বলতেন।
‘রানওয়ে’র প্রিমিয়ার শো শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে। উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রথমবার আমাকে দেখা যাবে সিনেমার পর্দায়। অন্যরকম একটা উত্তেজনা। কত কত বড় বড় পরিচালক ও অভিনেতারা আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন। প্রযোজকদের কেউ কেউ তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দেখা করার আমন্ত্রণ জানালেন। সাংবাদিক অনেকে টুকটাক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন৷ এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা!
বেশ কিছুদিন পর।
তারেক ভাই আমায় হঠাৎ করেই কল দিলেন। বললেন তখনই গাজীপুরের ডুয়েটে যেতে। সেখানে ‘রানওয়ে’র প্রদর্শনী হচ্ছিলো। তারেক ভাইয়ের কল আমি যাবো না, তবে হতেই পারে না। বাইরে থেকে বাসায় এসে দ্রুতই রওনা দিলাম।
ডুয়েটে রীতিমত এলাহি কাণ্ড। টিকেটের বিশাল লাইন। আমি যখন পৌঁছালাম তারেক ভাই জানালেন একটা শো শেষের দিকে। ভিতরে বসার জায়গা নেই, পেছনে দাঁড়াতে হবে একটু। তারেক ভাইয়ের সাথে হল রুমে ঢুকলাম। হলভর্তি দর্শক দেখে যে কী ভীষণ ভালো লাগলো!
সিনেমার শেষে দর্শক উঠে যাওয়ার আগেই তারেক ভাই মঞ্চে উঠে বললেন, এতক্ষণ যে ছবি দেখলেন এবার তার হিরোকে দেখবেন। রুহুলকে দেখতে চান আপনারা? হল ভর্তি চিৎকার, হ্যাঁ।
মঞ্চে দাঁড়িয়েই আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। হল ভর্তি লোকজন পেছনে আমার দিকে তাকালেন। কী অপূর্ব এক শিহরণ বয়ে গেলো আমার শরীরে। সবার দৃষ্টি আমার দিকে! কেউ শিষ দিচ্ছে, কেউ হাতের ইশারায় আরেকজনকে আমায় দেখাচ্ছে। কেউ রুহুল ভাই, রুহুল ভাই বলে চিৎকার করছে। মোবাইলের ফ্লাশ লাইট, ক্যামেরা আমাকে ফলো করছে। আমি এগিয়ে চলেছি সামনে। আমি যেন স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করেছি। সত্যিই নিজেকে রাজা মনে হলো। যেন এক মহারাজা!
আসলে অনুভূতি হচ্ছিলো তা লিখে কোনভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। শুধু মনে হচ্ছিলো জীবনে এর চেয়ে বড় আর কোনো প্রাপ্তি হতে পারে না! এ জীবন স্বার্থক আমার। এই ভালোবাসার সমুদ্রে, ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে আজীবন।