Wednesday 30 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তির নাটক, নাটকের মুক্তি


১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:১৮ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:০৪
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাধীনতা বা মুক্তি একটা আকাঙ্খার নাম, একটা অভিলাষের নাম। এই আকাঙ্খা ও অভিলাষ আমরা ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত আর দুই লক্ষ নারী সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছি। এ এক মহান অর্জন। এ এক মহানন্দ, মহামুক্তি। একটা জাতি যখন তার মুক্তির জন্যে লড়াই করে, অস্ত্র হাতে নেয়, বিজয় অর্জন করে তখন মুক্তিযুদ্ধটা চিরকালীন হয়ে যায়। যুদ্ধটা চলতে থাকে স্বাধীনতাকে অর্থবহ অবিস্মরনীয় করে তোলার জন্যে। যুদ্ধটা করে যেতে হয়। সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ চলতে থাকে। থাকতে হয়। স্বাধীনতা আমাদের নতুন এক পরিচয় দিয়েছে তাই আমাদের সকল ক্ষেত্রকে নতুন পরিচয় দেওয়া বা নতুন করে গড়ে তোলা আমাদের প্রাত্যহিকতার অংশ হওয়া উচিত। শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক সৌহার্দ, মূল্যবোধের বিকাশ সবই যাতে তার সৌকর্যে পৌঁছায় তার দায় আমাদের।

বিজ্ঞাপন

একটা বিষয় বিস্ময়ের সাথে অনুধাবন করি যে সংস্কৃতির রয়েছে এক অবারিত প্রবেশাধিকার যা সমাজের সবকিছুকেই তুলে ধরতে পারে মানুষের চোখের সামনে। একটা দেশে সমাজ, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিষ্টাচার, নীতি ও আদর্শ সবকিছুকেই সংস্কৃতি ধারণ করতে পারে অনায়াসে।
ধরা যাক মঞ্চ নাটকের কথা। আমাদের দেশের মঞ্চ নাটকে নিয়ত উঠে এসেছে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার প্রত্যয়। মঞ্চ নাটকের সাথে যুক্ত অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তারা কলকাতা অবস্থানকালে দেখেছেন সেখানকার মঞ্চের পরিবেশনাগুলো। ঋদ্ধ হয়েছেন নতুন ধারণায় এবং নতুন ধরণের পরিবেশনায়। যুদ্ধ জয় করে দেশে ফিরে তারা মন দিয়েছেন মঞ্চ নাটকের সংস্কার সাধনে। এসেছে নাটকের মুক্তি, তৈরী হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তির নাটক। মুক্তিযুদ্ধের নাটক। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অর্ধশতাধিক নাটক মঞ্চে এসেছে। এসব নাটকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, পাকদের হাতে নারী ধর্ষণের কাহিনী, বাঙালির অকুতোভয় পথচলা আর বীরত্বগাথা আর রাজাকার, আলবদর, আল শামস তথা পাক নরপশুদের অমানবিক নিষ্ঠুরতার লোমহর্ষক নানা চিত্র।

নাট্য-সমালোচক মফিদুল হক দুই বাংলার থিয়েটার পত্রিকায় এক প্রবন্ধে ঢাকার মঞ্চনাটকের উত্থান ও বিকাশের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, স্বাধীনতার পর শিল্পের যে-শাখায় সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তা হচ্ছে মঞ্চ-নাটক। চলচ্চিত্র নয়, সে অর্থে সাহিত্যও নয়, নাটক। মঞ্চনাটক। মফিদুল হক যথার্থই বলেছেন। সেলিম আল দীন বলতেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার ফসল। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার ভিতর দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ভ্রুণের সঞ্চার হয়। সেই নাট্য-প্রতিযোগিতার একটি বড় শর্ত ছিলো, নাটকের পান্ডুলিপি হতে হবে দলের নিজস্ব নাট্যকারের লেখা। এই বিশেষ একটি শর্তই সেদিন বদলে দিয়েছিলো প্রতিযোগিতার চেহারা। আমরা পেয়েছিলাম বেশ কয়েকজন নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। ম হামিদ, সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পিযূষ বন্দোপাধ্যায় এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই নাট্য-চর্চা মুদ্রার এক পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠে ছিলেন নাটকে নিবেদিত প্রাণ আরও অনেকে। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই যারা নাটকের সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলার মঞ্চ নাটকের জন্যে একটা সুগম পথ যারা রচনা করে চলেছিলেন। আব্দুলাহ আল মামুন, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আতাউর রহমান, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, শিমুল উইসুফ, নাজমা আনোয়ার, সারা যাকের এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এঁদের হাতেই গড়ে উঠলো গ্রুপ থিয়েটারের চর্চা।

বাংলা নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের হলেও বাংলাদেশের নাট্যচর্চা যাকে আমরা গ্রুপ থিয়েটার বলি তার শুরু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। ১৯৭২ সালে। যে শুরু কেবল নাটক নয় জন্ম দেয় বিনা পারিশ্রমিকে পেশাদারী থিয়েটারের ধারা। সে সময় ঢাকাতে অনেকগুলো নাট্যদল জন্ম নিলো। থিয়েটার, আরণ্যক, নাগরিক, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার। একাত্তরে যুদ্ধ জয় যেনো বিশেষ এক ভূমিকা রাখলো বাংলাদেশের থিয়েটারে। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের জোয়ার বয়ে গেলো ঢাকার মঞ্চে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এ সময়ে গ্রুপ থিয়েটারে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় অনুসঙ্গ হলো বেশীরভাগ নাট্যযোদ্ধাই আসলে মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার সাময়িক স্বপ্ন পূরণের পর থিয়েটার তাদের কাছে নতুন স্বপ্ন হয়ে ধরা দিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনাদের এক দোসরকে কেন্দ্র করে সৈয়দ শামসুল হক রচনা করলেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এটিকে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম কাব্য নাটক হিসাবেও বলা যায়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মঞ্চে এনেছিলো ‘থিয়েটার’ নির্দেশনা দিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এছাড়াও ‘এখানে এখন’ নাটকেও সৈয়দ হক উপজীব্য করলেন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাকে। সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি নাটক ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’। এই নাটকটির চরিত্র ভিন্ন। যদিও বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু পরিবেশ এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এতে । ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ শহরের পটভূমিতে রচিত। এ নাটকে শহীদের স্ত্রী বিয়ে করেন এক রাজাকারকে। ঘৃণার উদ্রেক যেনো স্বাধীনতার চেতনাকে জাগিয়ে তোলে । নিজের দল থিয়েটারের জন্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন রচনা করলেন ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ, তোমরাই, ‘দেশের মানুষ’সহ আরও কয়েকটি নাটক। বেশীরভাগ নাটকের নির্দেশকও তিনি।
মামুনুর রশীদের নাটক ‘জয়জয়ন্তি’র মুল কেন্দ্রিকতা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গ্রামের মানুষ বিশেষ করে শিল্পীদের জীবন ও সংগ্রাম। মামুনুর রশীদ-এর ‘সমতট’ নাটকেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এক সংকট উঠে এসেছে। তিনি নাটকে শ্রেণী বৈষম্যের কথা বলেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটকে ‘৭১ পরবর্তী জনজীবনে বিবিধ ঘটনা যার ভিতরে কিছু বামপন্থী ভাবধারা স্থান পেয়েছে। ঢাকার সেরা একটা থিয়েটার দল আরন্যক নাট্যদল প্রযোজনা করেছে তার নাটকগুলো। নির্দেশনা দিলেন মামুনুর রশীদ নিজেই।

ডঃ এনামুল হক রচনা করলেন ‘সেইসব দিনগুলো’। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জন্যে তিনি এই নাটকটি রচনা করেন। এসএম সোলায়মান এর নাটকেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তির বিষয়টা উঠে আসলো ‘এই দেশে এই বেশে’ নাটকে। ঢাকা পদাতিক-এর বলিষ্ঠ প্রযোজনা ছিলো এটি। নির্দেশনা নিয়েছিলেন সোলায়মান নিজেই। এসএম সোলায়মান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনুবাদ করলেন এবং নির্দেশনা দিলেন কোর্ট মার্শাল নাটকটি, যার বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে বীরাঙ্গনার সন্তানদের সামাজিক অবস্থান।

নাট্যনির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফকেও রচনায় আসতে দেখা গেলো ‘একাত্তরের পালা’ আর ‘টিটোর স্বাধীনতা’ নিয়ে। তাঁর আরেকটি নাটক ‘ঘুম নেই’। এতে তিনি শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন, শহিদদের বাঁচিয়ে তোলার বিষয়টি এনেছেন। প্রযোজনা করেছে ‘মহাকাল’।
মমতাজউদ্দিন আহমেদ’র অনেকগুলো নাটকে স্বাধীনতার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিটা বিশেষভাবে উঠে এলো। এর মধ্যে সাতঘাটের কানাকড়ি’, ‘কি চাহো শঙ্খচিল’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ আর ‘বর্ণচোরা’ উল্লেখযোগ্য। এই নাটকগুলির বেশীরভাগই থিয়েটার তোপখানার প্রযোজনা ছিলো।

মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বহুল প্রদর্শিত পথনাটক। রেপার্টরি থিয়েটার ‘শূন্যন’ প্রযোজনা করেছে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে নির্মিত, মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনীত ‘লাল জমিন’ নাটক । এটির রচয়িতাও মান্নান হীরা আর নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘লাল জমিন’ নাটকের কাহিনী। মোমেনা চৌধুরী অসাধারণ অভিনয়শৈলী নাটকটিকে ঋদ্ধ করেছে।
নব্বই দশকের উল্লেখযোগ্য নাট্য নির্দেশকদের একজন শামসুল আলম বকুল রচনা করলেন ‘ঘর লোপাট’। যেখানে তিনি হানাদার বাহিনীর দোসরের উত্থানকে তুলে আনলেন। ঢাকার দেশ নাটক মঞ্চে এনেছিলো নাটকটি। এই নাটকে ইশরাত নিশাত, কামাল আহমেদ, বন্যা মির্জা আর আওয়াল রেজা অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন।
গোলাম সরোয়ারের ‘ক্ষেতমজুর খইমুদ্দিন’ নাটকেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি । খইমুদ্দিন সহজ সরল মানুষ, স্বাধীনতার অর্থ বোঝে না, তবে সে বোঝে স্বাধীনতা মানে সকলের মুক্তি। ফলে সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে থাকে, পরণতিতে সে শান্তি কমিটির হাতে নিহত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং পরবর্তীতে পদাতিক নাট্যসংসদ মঞ্চে এনেছিলো নাটকটি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান তার ছোটগল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’ তুলে ধরেছেন একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের নানা ইতিহাস। যুদ্ধকালীন সেই উত্তাল সময়ের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় অবলম্বনে মোহাম্মদ বারী’র নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘সময়ের প্রয়োজনে’ নাটকটি মঞ্চায়ন করেছে নাটকের দল থিয়েটার আর্ট ইউনিট।

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির উত্থানের প্রতিবাদ জানিয়েও রচিত হলো বেশ ক’টি নাটক। আমার ‘রাজাকারের প্রত্যাবর্তন’ তেমনই একটি পথনাটক। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী বরিশাল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের অন্যান্য জায়গাতেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক মঞ্চে আসতে শুরু করে। আমার মনে পড়ে কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার আশির দশকে মঞ্চে এনেছিলো সিরাজ হায়দারের লেখা ‘আলো একটু আলো’।

এখানে যে নাট্যকারগণ উল্লেখিত হলেন তাঁদের বেশীর ভাগই দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। নাটকেই তাঁদের জীবন সঁপেছেন তাঁরা। তাঁদের বাইরেও অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে নাটক রচনা করেছেন। আমি স্বীকার করে নিচ্ছি যে, এই লেখার জন্যে যে পরিমাণ গবেষণা প্রয়োজন তা আমার করা হয়নি তবে এটা একটা সূচনা হতে পারে। আমার এই লেখার সাথে যদি আরো অনেকে তাঁদের খোঁজে থাকা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের খবর আমাকে জানান তবে আমি তা এই লেখার সাথে যুক্ত করবো এবং পরবর্তী বিজয় দিবসের লেখায় তা যুক্ত করবো। তখন এই লেখার কলেবর বাড়বে। এই ধারায় হয়তো একদিন আমরা মুত্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক নাটকের পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করতে পারবো।

মাসুম রেজা : খ্যাতিমান নাট্যকার।

১৯৭১ আব্দুল্লাহ আল মামুন থাকা থিয়েটার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বিজয়ের মঞ্চ নাটক মঞ্চ নাটক মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ মামুনুর রশীদ মাসুম রেজা মুক্তিযুদ্ধ সেলিম আল দীন স্বাধীনতা

বিজ্ঞাপন

সিএমপির ৩ থানার ওসি রদবদল
৩০ জুলাই ২০২৫ ১৯:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর