ঋত্বিক ভিটায় চলচ্চিত্র কেন্দ্রের দাবি
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:৫৩
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটার একটি অংশ ভেঙে সেখানে সাইকেল গ্যারেজ করছিল রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আশির দশকে সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে কলেজকে দিয়েছিল জমিটি। তারা বলেছিলেন, ভবিষ্যতে বাকি ঘরগুলোও ভাঙা হবে, কলেজের প্রয়োজনে। কিন্তু রাজশাহী ও ঢাকার চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠকদের প্রতিবাদ ও তৎপরতার মুখে ভাঙচুর ও নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ১২ চলচ্চিত্র নির্মাতা ইতিমধ্যে এবিষয়ে তাদের প্রতিবাদ ও দাবি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে জানিয়েছেন।
এবার বাংলাদেশ-ভারতের আরও ২৪জন চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক-শিক্ষক-গবেষক-পরিচালক-সংগঠক তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৬ জন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক-শিক্ষক-গবেষক এবং ভারতের ৮ জন চলচ্চিত্র পরিচালক-শিক্ষক-সংগঠক। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেছেন, হুমকির মুখে থাকা ঋত্বিক ঘটকের পৈত্রিক ভিটায় ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র ও যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।
বিবৃতিতে তারা বলেন- ঋত্ত্বিক ঘটক শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেই এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু দেশভাগকে তিনি কখনোই মেনে নেননি, উন্মূল হয়ে যাবার যন্ত্রণায় তিনি ভুগেছেন সারাজীবন। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তিনি নির্মাণ করেছেন অনন্য সব চলচ্চিত্র – ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা ও ‘কোমল গান্ধার’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সেই অর্থে তিনি বাংলাদেশেরও চলচ্চিত্রকার।
ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ এবং মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাঁকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়।
বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বাড়িটিকে সংরক্ষণের দাবি নতুন নয়। রাজশাহীতে ক্রিয়াশীল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ, রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই বাড়িটিকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে তিন বছর আগেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের দাবি,হোমিওপ্যাথি কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে অনতিবিলম্বে বাড়িটিতে ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হোক। ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে ক্রমশ একটি যাদুঘর সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হোক। দেশ–বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্ন মাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠুক। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িগুলো রক্ষা পেয়েছে, সরকারের উদ্যোগের কারণে। কত মানুষ আজ সেখানে যায়, রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালভাবে অনুভব করার জন্য। কত দেশি-বিদেশি গবেষক লালন আখড়ায় পড়ে থাকেন। ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের মতো যারা একসময় এদেশে জন্মেছেন বা যাদের বসতভিটা এখানে ছিল, তারা দেশভাগ বা অন্য কারণে চলে গেছেন, কিন্তু সেগুলোকে রক্ষা করা, সেগুলোকে যাদুঘরের মতো গড়ে তোলা তো আমাদের সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য কৃতী সন্তানদের বসতভিটাও রক্ষা ও পরিচর্যার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে।
অসাধারণ প্রতিভাধর এই চলচ্চিত্রকার, থিয়েটারকর্মী ও গল্পকার-লেখক দেশবিভাগের শিকার হয়ে সারাজীবন খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমরা তাকে আর অসম্মান করতে পারি না। বরং বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্য তার বসত ভিটা উদ্ধার করে একটি স্থায়ী কেন্দ্র গঠন করার মধ্য দিয়ে তাকে সম্মানিত করা।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- (বাংলাদেশ থেকে) লেখক-গবেষক অনুপম হায়াৎ, মাহমুদুল হোসেন, মঈনুদ্দীন খালেদ, জাকির হোসেন রাজু, সংগ্রাহক-গবেষক মীর শামছুল আলম বাবু, বিধান রিবেরু, ফাতিমা আমিন, আ-আল মামুন, শৈবাল চৌধুরী, কাজী মামুন হায়দার, হাবিবা রহমান, গোপা বিশ্বাস সিজার, বেলায়াত হোসেন মামুন, তাজিন আহমেদ, এ কে এম আতিকুজ্জামান ও ফাহমিদুল হক।
(পশ্চিমবঙ্গ থেকে) প্রেমেন্দ্র মজুমদার, সর্বভারতীয় সংগঠক, শিক্ষক-পরিচালক শ্যামল কর্মকার, পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, শব্দ প্রকৌশলী শান্তনু মুখার্জি, পরিচালক মনীষ কে দাস, পরিচালক অভিষেক ভট্টাচার্য্য, এম আর রাজন এবং চিত্রগ্রাহক সত্য রায় নাগপাল।
অনুপম হায়াৎ আ-আল মামুন ঋত্বিক ঘটক এ কে এম আতিকুজ্জামান কাজী মামুন হায়দার গোপা বিশ্বাস সিজার চলচ্চিত্র কেন্দ্র জাকির হোসেন রাজু তাজিন আহমেদ পৈত্রিক ভিটা ফাতিমা আমিন ফাহমিদুল হক বিধান রিবেরু বেলায়াত হোসেন মামুন মঈনুদ্দীন খালেদ মাহমুদুল হোসেন শৈবাল চৌধুরী সংগ্রাহক-গবেষক মীর শামছুল আলম বাবু হাবিবা রহমান