‘কনটেম্পোরারি’র নামে যা চলছে, তা বিকৃত: শামীম আরা নীপা
১৭ জানুয়ারি ২০২০ ১০:০০
শামীম আরা নীপা। বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পে সুপরিচিত এক নাম। শুধু দেশ নয়, বিদেশেও এই শিল্পী সমানভাবে জনপ্রিয়। নৃত্যের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তার সাবলীল ও সফল পদচারণা। শাস্ত্রীয় নৃত্যে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে ‘একুশে পদক’ও পেয়েছেন। আশির দশক থেকেই নাচের সঙ্গে যুক্ত এই নৃত্যশিল্পীর কাছে নাচই ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা।
বাংলাদেশের আরেকজন সফল ও খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০০০ সালে গড়ে তোলেন নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যাঞ্চল’। ২০০২ সাল থেকে এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা নাচ শেখানোর পাশাপাশি পরিবেশনে আলোর ব্যবহার, পোশাক নির্বাচনসহ নাচের খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
কেমন শিখেছে নৃত্যাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা? নৃত্যচর্চাকে মনে-প্রাণে কতটাই ধারণ করতে পারল তারা? এসব জানতে এবং জানাতেই ‘নৃত্যাঞ্চল’র শতাধিক শিক্ষার্থী ও নৃত্যশিল্পীকে নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে আইসিসিআর স্কলারস ইভিনিং ‘কত্থকের রঙ’ শিরোনামে কত্থক সন্ধ্যার। যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ‘নৃত্যাঞ্চল’র শিক্ষার্থীদের নিয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় নাচ করবেন শামীম আরা নীপা ও শিবলী মহম্মদ।
সারাবাংলা’র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্ত’র সঙ্গে আড্ডায় এই আয়োজনের বিস্তারিত জানালেন নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যশিক্ষক শামীম আরা নীপা।
• কেন এই আয়োজন?
মূলধারার নাচ, বিশেষ করে যারা শুদ্ধ নৃত্যচর্চা করে, আমরা সবসময় তাদের সুযোগ করে দিতে চাই। কারণ বাংলাদেশে শুদ্ধ নৃত্য চর্চাকারীদের জন্য প্ল্যাটফর্ম খুব একটা নেই। অন্যদিকে কনটেম্পোরারির নামে যে ট্রেন্ডটা চলছে, সেটাকে জেনে না জেনে সহজ পদ্ধতি মনে করে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছে। কারণ তাতে কোনো জবাবদিহিতা নেই। কারও কিছু বলারও নেই। ইচ্ছামতো নাচ করছে।
এই যে একটা বিকৃত অবস্থা তৈরি হয়েছে, যত দিন যাচ্ছে এটা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থাতেই আমরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি শুদ্ধ নৃত্য চর্চাটাকে টিকিয়ে রাখার। যারা সবধরনের প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই চর্চাটা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, অগ্রজ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, এসব শিল্পীকে এগিয়ে যাওয়ার পথটা করে দেওয়া। এ কারণেই এ দেশের শুদ্ধ নৃত্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘নৃত্যাঞ্চল’র পক্ষ থেকে নতুনদের উদ্বুদ্ধ করতে এই আয়োজন। আমাদের সৌভাগ্য যে এ ধরনের একটি বিশাল আয়োজনে আমরা আমাদের পাশে পেয়েছি ভারতীয় দূতাবাসের ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’কে। মূলত তাদের আমন্ত্রণেই যৌথভাবে এই আয়োজন।
• নৃত্যানুষ্ঠানটির ধরন
একেবারেই ধ্রুপদী আঙ্গিকে অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। এই যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাচ শিখছে, ওদের একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। ওদের জন্য তো কোনো অনুষ্ঠান তৈরি হয় না। তাহলে ওরা কোথায় যাবে? দুয়েকটা অনুষ্ঠান হলেও এর পরিমাণ একেবারেই অপ্রতুল। প্রয়োজন আরও অনেক বেশি আয়োজন। এ দেশে ধ্রুপদী নাচের চর্চাটা প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে, কিন্তু উপস্থাপনের পর্যাপ্ত প্ল্যাটফর্ম নেই। তাই ধ্রুপদী নাচের সঙ্গে যারা আগে থেকেই সম্পৃক্ত রয়েছে এবং যারা নতুন কিন্তু ভালো করছে, তাদের একটা প্ল্যাটফর্ম দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
• প্রতিবন্ধকতা
ভালো অনুষ্ঠানের আয়োজন, বিশেষ করে মৌলিক শিল্পীদের সুযোগ করে দেওয়ার ইচ্ছেটা সবারই আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এসব ক্ষেত্রে আমরা পৃষ্ঠপোষক পাই না। কিন্তু এ ব্যাপারে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। এটা যদি না থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে। নতুনরা এখন যে ভুল ও অশুদ্ধ ধারার দিকে এগোচ্ছে, তাকে ঠেকানোর জন্য একদিকে যেমন আমাদের আমাদের মূলধারার চর্চাটা ধরে রাখতে হবে, অন্যদিকে এর উপস্থাপনের সুযোগও আরও বেশি পরিমাণে হওয়া প্রয়োজন। শুদ্ধ নৃত্যশিল্পীদের পাশে থাকা, তাদের সহযোগিতা করাটা সবারই দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। আমরা যারা বর্তমানে একটা অবস্থানে রয়েছি, তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব নতুনদের সঠিক পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসা। একইসঙ্গে তাদের একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে শুদ্ধ ও মৌলিক নাচের ধারাটা অব্যাহত রাখতে হবে।
• সহযোগিতা
বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’কে। তাদের দেওয়া এই ধরনের সুযোগে এককভাবে শুধু আমরা নই, নৃত্য চর্চার সব সংগঠনগুলোই উপকৃত হচ্ছে। নতুনদের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, আগামী প্রজন্ম যদি উঠে না আসে, তারা যদি তাদের কাজ দেখানোর সঠিক প্ল্যাটফর্ম না পায়, তাহলে আমরা আগামীতে একটা শূন্যতার মধ্যে পড়ব। তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই বলতে চাই, এ ধরনের সহযোগিতা আগামীতে যেন আমরা আরও বেশি করে পাই।
• পরিবেশনায়
নৃত্যাঞ্চলের একেবারে প্রারম্ভিক শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে যারা ভালো করছে, তাদের সবাইকে নিয়েই আমরা পারফর্ম করব। আমাদের একটা আইটেম আছে ‘পাঠশালা’। সেখানে একেবারেই জুনিয়র যে ব্যাচটা আছে, তাদের সঙ্গে একেবারে ডিপ্লোমা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরাও থাকবে। এমনকি যারা নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি আমাদের এখানে শিক্ষকতাও করছেন, তারাও থাকবেন। দর্শকরা বুঝতে পারবে, ‘নৃত্যাঞ্চলে’ ধ্রুপদী নৃত্যচর্চাটা কিভাবে শুরু হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। বলা যায়, আমাদের এই যাত্রা শুরু থেকে বর্তমান সময়ের একটি প্রতিফলন।
• সমসাময়িক নৃত্যচর্চা
আমি যেটা বুঝি, সমসাময়িক নৃত্যকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মানসিকতায় আধুনিক চিন্তা-ভাবনা অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু সেই আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে যদি মৌলিকতাটা না থাকে, নান্দনিকতা না থাকে, তাহলে সেই আধুনিকতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সাময়িক বাহবা-হাততালি এসব পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের মনে স্থায়ী গ্রহণযোগ্যতা কখনোই পাওয়া যায় না। কারন শাশ্বত বলে যে বিষয়টি, সেটা চিরকালই শাশ্বত। তাই শাশ্বত বিষয়টিকে মনে-প্রাণে ধারণ করে যদি উপস্থাপনের ভঙ্গিটা পাল্টাই, তবেই সেটা গ্রহণযোগ্য। তাই আমি মনে করি, বর্তমান সময়ে কনটেম্পোরারির নামে যে ধারা চলছে, সেটির কোনো সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য ভবিষ্যৎ নেই। সেই কাজগুলোই স্থায়ী হবে, যেগুলো মৌলিক ও মূলধারার।
• কত্থক নৃত্যের বর্তমান প্রেক্ষাপট
আমাদের এই অনুষ্ঠানটি দেখলে বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশে কত্থক নৃত্য কতটা সমৃদ্ধ অবস্থানে আছে। এই অনুষ্ঠানে আমি আর শিবলী কেবল যতটুকু না হলে নয়, ঠিক ততটুকুই পারফরম করছি। পুরো অনুষ্ঠানটিকে সাজিয়েছি নতুন ও উঠতি নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনা দিয়ে। ওদের এই পরিবেশনা দেখে সবাই বুঝতে পারবেন, তারা কতটা তৈরি হয়েছে। নাচকে অনেক সুন্দরভাবেই তারা আয়ত্ত করেছে। আমরা যদি তাদের আরও সুযোগ দিতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশের দর্শক দেখতে পেত— এই ছেলেমেয়েগুলো কতটা এগিয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য, আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা মঞ্চ— কোথাও তেমন কোনো সুযোগ নেই। প্রচার মাধ্যমেও অবহেলিত। এত সাধনা আর চর্চা করে নিজেকে তৈরি করেও পাদ-প্রদীপের আলোয় তারা আসতেই পারছে না। তারপরও আশার কথা, এতটা অপ্রাপ্তি-অবহেলা সত্ত্বেও শুদ্ধ নৃত্যচর্চার প্রতি কিছু কিছু ছেলে মেয়েদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
• প্রত্যাশা
যারা এই আয়োজনটি উপভোগ করবেন, তারা বুঝতে পারবেন, নতুন এই ছেলেমেয়েগুলো কতটা প্রতিভাবান। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা চালিয়ে আজকের পর্যায়ে সে কতটা ভালো করছে, সেই রেজাল্টটাও দেখা যাবে। আমরা তাদেরকে কতটুকু তৈরি করতে পারলাম, সেটিই দেখবেন দর্শকরা।
ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার নৃত্যাঞ্চল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ভারতীয় হাইকমিশন শামীম আরা নীপা শিবলী মহম্মদ