শারীরিক দূরত্বের কি এমন ক্ষমতা যে রুখে দেবে আমাদের মানসিক নৈকট্য
১৪ এপ্রিল ২০২০ ১১:১২
আজ নববর্ষ।
অথচ চারুকলা, রমনার বটমূল, টিএসসি চত্বর, শাহবাগের মোড় কিংবা শিল্পকলা- কোথাও মিলিত হবো না আমরা। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ঝড়ে কাপের পর কাপ চা শেষ হবে না আজ। ভারি করবো না চারপাশের পরিবেশ। ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটা কেমন চিন চিন করে উঠছে।
বর্ণিল শোভাযাত্রার রঙে রঙে যখন সবার হৃদয় রাঙ্গিয়ে যাবার কথা, তখন করোনা আতংকে বিবর্ণ আমাদের হৃদয়। আকাশ জুড়ে আলোর মিছিল, তবুও আমাদের দৃষ্টিজুড়ে হতাশার কালো আস্তরণ। পড়ন্ত বিকেলের ছায়াঘেরা মায়াবী পথ যখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার পথিককে, অসহায় পথিকের তখন ঘরের সীমানা পেরোনো বারণ। বুকের রানওয়েতে স্বজনের স্বশরীরি উপস্থিতির আকাঙ্ক্ষায় যখন ব্যকুল সবার হৃদয়, তখন বাঁচার প্রয়োজনে স্বজনের কাছ থেকেই সব চাইতে বেশি দূরে থাকতে হচ্ছে আমাদের। সামজিক দূরত্ব আর শারীরিক দূরত্বই যেন বেঁচে থাকবার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।
এ এক অদ্ভুত সময়। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ধনী কিংবা গরিব সবাই ভুগছে অজানা এই আতঙ্কে। বার বার মনে হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আমাদেরই আশপাশে ঘুরে ফিরছে করোনা নামের যমদূত। যেন সুযোগ পেলেই বসিয়ে দেবে ছোবল। বেঁচে থাকাটাই সব চাইতে বড় সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
দেশে ফিরে নিজ দায়িত্বে ১৪ দিন হোম কোয়ারেইনটাইন করলাম। ১৪ দিন কখন ২৪ দিন ছাড়িয়ে গেল টের পেলাম না। ঘরের বাইরে যাওয়াতো দূরের কথা, জানালা দিয়ে উঁকি পর্যন্ত দেইনি কখনো। হোয়াটসআপ, ভাইবার কিংবা ম্যাসেঞ্জারে নিয়ম করে রোজই বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু প্রাণের মানুষগুলোরও কোথায় যেন প্রাণের অভাব। কেউ ভালো নেই আমরা। বেঁচে থেকেও যেন বেঁচে নেই।
সবার মত আমারও ভীষণ একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে। বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বারবার ছূটে যেতে ইচ্ছে করছে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। মেতে উঠতে ইচ্ছে করছে আড্ডায়। আমার অস্থিরতা দেখে বন্ধু আব্দুল্লাহ দাউদ আমাকে লিখে পাঠালো “You & I are among lucky ones. We are not fighting this war, just sitting in patience for the result of this war” সত্যিই তো…। আমিতো এখনও সুস্থ আছি। অসুস্থ হয়ে আইসিইউ’তে জীবন মরণের সাথে যুদ্ধ করছি না। স্বজনের অনুপস্থিতি আর জানাযা ছাড়া আমার দাফন হচ্ছে না। মা-বাবা, ভাই-বোন বা বাচ্চাকে ছেড়ে মানবতার কল্যাণে শত ঝুঁকির সম্ভাবনা জেনেও একজন ডাক্তারের মত আমাকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবায় দিন-রাত পার করতে হচ্ছে না। কোনরকম প্রটেকশান ছাড়া মৃত্যুর ভয়কে জয় করে একজন পুলিশ সদস্যের মত আমাকে মানুষের প্রয়োজনে বাইরে পরে থাকতে হচ্ছে না। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আর্মি, নেভী, র্যাব, ওষুধ বিক্রেতা, সাহায্য এবং সেবা =দানকারী মানুষগুলো যে ঝুঁকি নিয়ে রাত দিন কাজ করে যাচ্ছেন, আমি তো তার কিছুই করছি না। আমি বা আমরা অনেকেই ভাগ্যবান যে আমাদেরকে এসব কিছু না করে শুধুমাত্র ঘরে থাকবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাতেই আমরা কেমন অস্থির!
অনেকেরই করোনার পাশাপাশি যুদ্ধ করতে হচ্ছে ক্ষুধার সাথেও। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মানুষগুলো আছেন চরম সংকটে। তারা না পারছে সইতে, না পারছে কইতে। আর আমার পেশার মানুষগুলো! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাদের জন্য। জানি আত্মমর্যাদা বোধের কারণে এই মানুষগুলো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। কারণ তারা শিল্পী হতে চেয়েছেন চিরদিন, শিল্পপতি হতে চাননি কোনদিনও। কিন্তু শিল্প আর ক্ষুধার যুদ্ধে আজ তারা হেরে যাচ্ছেন। তারপরেও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে পেটে কাপড় বেঁধে মুখ বুঝে ঘরের কোনে পরে আছেন নিশ্চুপ। জানি না রাষ্ট্রের কাছে আমাদের শিল্পটা আদৌ কোনো শিল্পের পর্যায়ে পরে কিনা ? শিল্প সংস্কৃতির শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের আদৌ কোন প্রণোদনা আছে কিনা? নাকি ৭১’র ১৪ই ডিসেম্বরের মতো করে ক্ষুধার কাছে হেরে যেতে হবে এই সৃজনশীল মানুষগুলোকে?
জীবনবাজি রেখে যারা সন্মুখ সমরের দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আর সম্মান। আর যারা সেবার ব্রতে অটুট থেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ইতিহাসে আপনাদের নাম আদৌ লেখা হবে কিনা ঠিক জানি না, তবে মানুষের হৃদয়ের গহীনে আপনারা চিরদিনই থাকবেন শ্রদ্ধাভরে এতটুকু অন্তত হলফ করে বলতে পারি।
এ অন্ধকার একদিন ঠিকই কেটে যাবে। আবারও মিলিত হবে প্রাণ, প্রাণের সাথে। হাতে হাত ধরে, গায়ে গা মিলিয়ে আবারও আমরা ঘুরে বেড়াবো পথে-ঘাটে মাঠে কিংবা বাড়ির আঙ্গিনায়। আপাতত বেঁচে থাকার জন্য, ভালোবাসার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য ঘরেই থাকি। দূরেই থাকি।
আমাদের কথা হোক অদৃশ্যে কিংবা ভার্চুয়াল জগতে। শারীরিক দূরত্বের কি এমন ক্ষমতা যে রুখে দেবে আমাদের মানসিক নৈকট্য। আগামী বৈশাখে মিলনের আশায় ঘরে থাকুন এ বৈশাখে। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। বেঁচে থাকলে আবারো দেখা হবে এই বাংলায়।
সাইফুল ইসলাম মাননু – জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা