Sunday 06 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নববর্ষের খেরোখাতা: নাজনীন হাসান চুমকী


১৪ এপ্রিল ২০২০ ১৮:০২ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ২১:৩৫
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমি মফস্বল শহর চুয়াডাঙ্গাতে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। যেই শহরের মানুষগুলো নিজের বাড়ির, নিজ শহরের বাইরে তখনও বের হওয়া শেখেনি। উচ্চশিক্ষার কারণে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা বা কুষ্টিয়া গেলেও, ঘন ঘন বাড়ি ফিরে আসাটা একটা অদ্ভুত নেশা ছিল চুয়াডাঙ্গাবাসীর।

শৈশবকালে, আমার কাছে পহেলা বৈশাখ মানে, গাঢ় হওয়াই মিঠা রঙের পঞ্জিকা, পুরো বাড়ির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, ধূপকাঠি, খেরোখাতা, হালখাতা, নিমকি, বুন্দিয়া, পাওনাদারের চকচক করা চোখ, দেনাদারের মাথা নিচু হয়ে আসা, খসখসে মিনমিনে কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও উপস্থিত সকলের কারণে বলতে না পারার যন্ত্রণা, স্কুল ছুটি, অন্যান্য দিনের থেকে আরেকটু বেশী খেলতে পারার আনন্দ, মায়ের অফিস বন্ধ, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, নানারকম পদের রান্না, ভর্তা-উছতা-সজনে ডাঁটা-ডালের বড়ি-কুড়মুড়ে সজনে পাতা ভাজা-ঘি-পটলচেরা ভাজি-মিষ্টি কুমড়ো ভাজি-বেগুন ভাজি, কাঁচা আমের শরবত। শৈশবের প্রতিবারের পহেলা বৈশাখে মাছ মাংস ছাড়া একটা শাস্তির দিন মনে হতো তবুও মায়ের চোখ গরম দেখে গরম ভাতে পাতে ঘি দিয়ে এসকল এখন অমৃত মনে হয়, চোখ বন্ধ করলে স্বাদ পায় এখনও। এ শৈশবে আমি এভাবে ‘শুভ নববর্ষ’র শুভেচ্ছা জানাতে দেখিনি, আমরাও সেখানে ফর্মালিটি করিনি, আর ইলিশ মাছ পান্তা..!! নতুন পোশাক বা লাল-সাদা পোশাক সে তো দেখিইনি। মেলাও হতো না কোন। তবুও সেই শৈশবেই আমরা বাড়িতে অসাম্প্রদায়িকতা বিষয়টা খুব স্পষ্টভাবে দেখে বেড়ে উঠেছি আমরা। যেমন আমরা মাদ্রাসায় যাচ্ছি, আরবী শিক্ষা নিচ্ছি, তেমনি সনাতন ধর্মের অনেক আচারও খুব শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলতেন আমার দাদী এবং মা-চাচীরা। সেখান থেকেই চৈত্র্য সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ একটু অন্যভাবে পালন করা হতো বাড়ীতে। সবচেয়ে বড় কথা, পহেলা বৈশাখ মানে তখন ছিল ‘বাড়ির সংস্কার, পরিস্কার’।

বিজ্ঞাপন

কৈশোরকালে, হাতে বানানো ‘শুভ নববর্ষ’ লেখা কার্ড বানানো। সেই কার্ড দেয়া নিয়ে অভিমান, কেননা ভুল করে যদি কোন বন্ধু বা বান্ধবী সেই কার্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে যেত সে অভিমান করে ভেবে বসতো সে ভালো বন্ধু না। বোঝাতে গেলে সে নিয়ে ঝগড়া, কিছুদিনের কথা না বলে থাকা। বাড়িতে তখন খাবারের চল একটু পরিবর্তন এসেছে। নিরামিষের পাশাপাশি আমাদের মতো শিশুদের কথা ভেবে একটু পোলাও রান্না করা হতো, কিন্তু খেতে হবে সেই নিরামিষ দিয়েই। গোসল সেরে আলমারীতে তুলে রাখা নেপথলির গন্ধওয়ালা পরিস্কার পোশাক পরে বাড়ির সিমেন্টের ঠান্ডা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে লাইন ধরে ভাইবোনদের একসাথে খাওয়া সেই পোলাওয়ের মধ্যে জাফরান পড়া লাল ভাতটুকু এখনও অমৃত। বেরেস্তা খাওয়া শিখিয়েছিলাম সেই কৈশোরেই। এখনও বেরেস্তা আমার পছন্দের। আর পোলাওয়ের ভেতর কিশমিশ অদ্ভুত দামী মজার খাবার। শুধুমাত্র নিরামিষ না খাওয়ার জন্যে আমার মোটামুটি সব ভাইবোনেরাই পোলাওকে সবচেয়ে অসাধারণ খাবার করে ফেলেছিলাম তা এখনও বর্তমান আছে। তবুও আমি বলবো, আমার বাড়ির নিরামিষ বা আমিষ যে কোন পদ রান্না পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা রান্না। বিশেষ করে দাদী-ফুপুদের হাতের রান্না। আর প্রায় প্রতি বৈশাখে কালবৈশাখী ঝড়। কৈশোরে এসে ঝড়ের সময় মায়ের শাসন উপেক্ষা করে আমবাগনে দৌঁড় দিয়ে আমকুড়ানোর থেকে বন্ধুদের সাথে দৌঁড়ে বেড়ানোটাই ছিল আসল। সেই আম শুকনো মরিচ পুঁড়িয়ে ভর্তা, আহা.. আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে সেই আমও এখন নেই সেই শুকনো মরিচও যে পৃথিবী থেকে নাই হয়ে গেছে। আসলে নির্ভেজাল আনন্দটাই অনেকাংশে নাই হয়ে গেছে।

যৌবনকালে, স্কুল ছুটিতে একটু মন খারাপ পছন্দের মানুষের মুখ না দেখতে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রিকশা করে বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। যাওয়া আসার পথে হুট তোলা রিকশা থেকে প্রিয় মানুষের মুখটা এক ঝলক দেখার আনন্দ। তখনও নতুন পোশাক বা সাদা-লাল পোষাকের ব্যাপারটি সেভাবে আমাদের মফস্বলে চল শুরু হয়নি, তবে কেউ কেউ সূতি হলুদ শাড়ী লাল পাড় পরতো, যে শাড়ী কিনা গায়ে হলুদে দেয়া হতো। তারপর সেজেগুঁজে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যেত। ততদিনে পহেলা বৈশাখে, প্রায় প্রতি বাড়িতে পোলাও বা বিরিয়ানীর রান্নার চল শুরু হয়ে গেছে। চল শুরু হয়েছে নানারকম মিষ্টির, কোমল পানীয়ের। ততদিনে আমি একটা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে বিকেল বেলা পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রাম শুরু করি। রঙ লাগা শুরু হলো।

পহেলা বৈশাখে ঢাকা অবস্থানকালে দেখি, আমার মফস্বলের সেই অনাড়ম্বর পহেলা বৈশাখের থেকে অনেক বেশী আড়ম্বরপূর্ণ। তবু ঐ যে স্বভাব পহেলা বৈশাখের ছুটি পেলেই বাড়ি চলে যাওয়া। ওখানে তখন ছেলেরা পহেলা বৈশাখে পাঞ্জাবী পরা ধরেছে, মেয়েরা মায়ের যে কোন রঙের শাড়ী। এরপর বিয়ে হলো, পহেলা বৈশাখে বাড়ি যাওয়া বন্ধ হলো, বিয়ের পর প্রথম গেলাম আমি টিএসটি-তে। কি ভীষণ মানুষের চাপ..! লাল-সাদার কি চমৎকার সংমিশ্রণ..!! শিশুদের কি দারুণ সাজ..!! গালে কত সুন্দর আলপনা..!! কি গরম..! হাঁটা আর হাঁটা..! মাটির সানকিতে পান্তা আর ইলিশ ভাজা..!! খুব অবাক হয়েছিলাম। ইলিশ ভাজা দিয়ে কিভাবে পান্তা খায় মানুষ..! কোনদিন আমার ইলিশ ভাজা দিয়ে পান্তা খাওয়া হয়নি। আমার শ্বাশুড়ী ছিলেন অদ্ভুত এক মায়াময়ী মানুষ। তিনি পরিবারের সকলকে নিয়ে পান্তা-নানা পদের ভর্তা-হলুদ লবণ মরিচ দিয়ে মাখো মাখো ইলিশ দিয়ে সকাল শুরু করতেন। শেষে থাকতো পায়েশ। এখনও এই চল ধরে রেখেছি আমরা বউয়েরা। তবে, এখন আমরা সবাই নতুন পোশাক পরি। বাড়ির সহকর্মীদের নতুন পোশাক কিনে দিই। বাড়ির সহকর্মীরা সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে দুপুরের পর মেলায় বেড়াতে যায়। কত হৈ চৈ কত প্রাণের কত রঙের সমাবেশ পহেলা বৈশাখে। উত্তরাতেও এই দিনে রিকশা পাওয়া যায় না। রিকশাওয়ালাও তার পরিবারকে সাজিয়ে গুছিয়ে কোলের সন্তানকে কাঁধে তুলে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। আনন্দ আর আনন্দ। এই আনন্দ বেঁচে থাকার এক অবাক করা অনুভূতি দেয়। ঈদ নয় তবে ঈদের থেকেও বড় উৎসব মনে হয় পহেলা বৈশাখ এখন আমার কাছে। ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরীব নির্বিশেষে অনাবিল আনন্দ। আমাদের সহকর্মীদের অনিন্দ্যসুন্দর এক আসর বসতো এই পহেলা বৈশাখকে ঘিরে। কত কত দিন দেখা না হওয়া মানুষগুলো আমরা এক সাথে হয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-আড্ডায় মেতে উঠি এই পহেলা বৈশাখে। আহা..

করোনাকালে, রাস্তা নিশ্চুপ। মেলার আয়োজন নেই। নেই, অগণিত প্রাণের শব্দ। নেই, শোভাযাত্রা। নেই, রঙ বেরঙের মানুষ মুখ দেখতে না পাওয়া বিশাল বিশাল মুখোশ। নেই, মানুষের ঢল। নেই, সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের অনাবিল মিশেল। নেই, ঢাক-ঢোল-বাঁশি-চরকির শব্দে আনন্দে মেতে ওঠার আহ্বান। নেই, আকাশে উড়তে চাওয়া হরেক রঙের গ্যাস বেলুন। নেই, পা ফাটা, খয়ে যাওয়া স্যান্ডেল, লুঙ্গি পরা, রোদে রঙ জ্বলে যাওয়া গেঞ্জি পরিহিত বাবার হলুদ শাড়ী লাল পাড়, কটকটে লাল লিপস্টিক দেয়া, সাদা পুঁতির মালা গলায় পরা কন্যার হাত ধরে ঘুরতে বের হওয়া সেই অনাবিল খুশীর হাসিমুখ। আজ ঘরে ঘরে মানুষ পান্তা ভাতটা পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে খেতে পারছে কিনা সে শঙ্কা নিয়েও মন কাঁদছে। মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাখিদের কিচির মিচির আজ মানুষের থেকে বেশী কানে আসছে। ভোরের বৈশাখ বরণে আসা মানুষগুলো হয়তো রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, হয়তো কাঁদছে মানুষ, ঘরে ঘরে মায়েরা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বন্ধুদের সাথে মাইলের পর মাইল হেঁটে ছেলে বা মেয়েটা হয়তো বিছানায় শুয়েই দিন কাটাচ্ছে। আজ হয়তো মানুষ স্নান সেরে নতুন কাপড়টাও পরেনি, বাসি কাপড়ে হয়তো কারো কারো এখনও দিনও শুরু হয়নি। কত পসরা বসতো এই বৈশাখী মেলা কেন্দ্র করে। কত মানুষ বছরের কয়েক মাসের অন্নের ব্যবস্থা করতেন শুধু এই মেলা হতে। কে জানতো এমন উৎসবমুখর বাংলাদেশ, পৃথিবী এমন স্থবির হয়ে পড়বে। আজ কেবলি নেই.. নেই.. আর নেই। আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের পৃথিবী আনন্দ নেই। তাই আমরাও আনন্দে নেই। দিন আসছে , দিন যাচ্ছে, এমনভাবেই যেন আমাদের ‘পহেলা বৈশাখ’ এলো আবার সূর্য ডোবার সাথে সাথে শেষও হয়ে যাবে। তবু আমরা প্রার্থনা করবো- “সবাই ঘরে থাক, নিজে সুস্থ থাক, পরিবারকে সুস্থ রাখার প্রয়োজনে”

আবার বৈশাখ আসবে। আবার রমনার বটমূল ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে প্রাণ পাবে। আবার সবাই একসাথে গেয়ে উঠবে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’।

নাজনীন হাসান চুমকী: অভিনেত্রী, নির্দেশক ও নাট্যকার

নববর্ষ নাজনীন হাসান চুমকী পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ ১৪২৭

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর