‘নববর্ষ ১৪২৭’- নতুন অভিজ্ঞতা নতুনের জয়গান: অলোক বসু
১৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১৪
আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শৈশবে পহেলা বৈশাখের উদযাপন তেমন একটা চোখে পড়েনি আমার, যতটা পড়েছে চৈত্র সংক্রান্তির উদযাপন। চৈত্র সংক্রান্তি মানেই বেশ কদিন আগে থেকেই নীলযাত্রা বা নীলপূজার আয়োজন। সেই সাথে প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, ধোয়ামোছা আরও কত কী। যেন বৎসরের আবর্জনা, জরা, জঞ্জাল ঘুচিয়ে নতুনের আবাহনে মেতে ওঠা। আর আমাদের মতো শিশু কিশোরদের জন্য অনিবার্য আনন্দের বিষয় যেটা ছিলো, তা হলো চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। এই মেলা উপলক্ষে বাড়ির বড়দের কাছ থেকে আমরা কিছু পয়সা পেতাম যাকে বলা হতো ‘থৌল’ খরচ। থৌলের অর্থ কী সেটা জানা না থাকলেও অনুমান করতে পারি থলে থেকেই শব্দটি এসেছে। আগেকার দিনেতো টাকাপয়সা রাখার জন্য থলে ব্যবহার করা হতো, সেখান থেকেই হয়তোবা ‘থৌল’ শব্দটি এসে থাকবে। মেলায় গিয়ে ঐ থৌলের পয়সায় রঙিন শরবত, লজেন্স, লেমেনেড, জিলিপি খেয়ে কী যে আনন্দ পেতাম তা কি আজ আর কাউকে বলে বোঝাতে পারবো? আর মাটির খেলনা, পুতুল, বাঁশের বাঁশি, চড়কি, ঘুড়ি, কাঁচা আম কাটার চাকু এসব কেনার আনন্দে রঙিন হয়ে উঠতো আমাদের শৈশব। পহেলা বৈশাখে হতো দোকানে দোকানে হালখাতা আর গনেশ পূজা। গনেশ পূজা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ ছিলো না, তবে বাবা কাকাদের হাত ধরে বিকেল-সন্ধ্যায় বাজারের দোকানে দোকানে গিয়ে হাল খাতার অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আনন্দটা ছিলো অতুলনীয়। যে দোকানেই যেতাম খুব খাতির করে ভিতরে নিয়ে পর্দাঘেরা একটা আড়ালে টেবিল চেয়ারে বসতে দেওয়া হতো। এরপরেই আসতো মিষ্টির প্লেট। গপাগপ খেয়ে ফেলতাম। পহেলা বৈশাখ থেকে পরবর্তী বেশ কয়েকদিন চলতো হাল খাতার আয়োজন। এই কদিন সকাল থেকে সময় যেন আর কাটতেই চাইতো না। কখন আসবে বিকেল। ভালো জামাকাপড় পরে বড়দের পাশে ঘুরঘুর করতে থাকতাম।
১৯৮৪ সাল থেকে ঢাকা শহরের পহেলা বৈশাখের সাথে চেনাশোনা আমার। শুরুটা হতো সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দিয়ে। তারপর শিশু পার্কের সামনে ঋষিজের অনুষ্ঠান, বাংলা একাডেমির হস্ত ও কুটির শিল্পের মেলা। তখনও পহেলা বৈশাখে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে নতুন কাপড় পরার চল শুরু হয়নি। তবে পুরুষেরা পাঞ্জাবী ফতুয়া, আর নারীরা শাড়ি পরে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে অংশ নিতো। ঘরে তুলে রাখা ভালো কাপড়টি পরেই বেরুতো সবাই। নারীরা ফুলের ব্যবহার করতেন খোঁপায়।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্ভবত ১৯৮৮/৮৯ সাল থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ চালু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে চারুকলা থেকে শুরু হতো এই শোভাযাত্রা। বর্ষবরণের আয়োজনে এই শোভাযাত্রা অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে, যা পরবর্তীতে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়।
এভাবে কখন যে পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদযাপন হয়ে উঠলো আমরা টেরও পাইনি। ধনী-গরিব ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সাধ্যমতো দিনটি উদযাপন করে। নতুন পোশাক পরা, ভালোমন্দ খাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
কিন্তু এবছর করোনাভাইরাসের মহামারীতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পর্যুদস্ত। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত। সবাই গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। তাই বলে পহেলা বৈশাখ আসবে না? আর আমরা তাকে স্বাগত জানাবো না তা কি হয়?
এবার পহেলা বৈশাখ পালিত হলো ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে। সামাজিকভাবে মেলামেশার অবকাশ আমাদের ছিলো না করোনার কারণে। এ রকম একটা পরিস্থিতি হতে পারে পহেলা বৈশাখে, যা আমাদের ধারণাও ছিলো না। নতুন পরিস্থিতি আমাদেরকে নতুন পথ দেখিয়েছে। আমরা সামাজিকভাবে দূরে থেকেও অন্তর্জালিকভাবে কাছাকাছি হতে পেরেছি প্রযুক্তির কল্যাণে। পরিচিত বন্ধু সাংস্কৃতিক মহলে হয়েছে নানা আয়োজন, যা আমরা যার যার বাসায় বসেই উপভোগ করতে পেরেছি। পরিস্থিতিই আমাদেরকে নতুন পথ দেখিয়েছে।
মানুষ হারতে জানে না। নতুন আবিষ্কার, নতুনত্বকে অভিযোজন করেই মানুষ এগিয়েছে যুগ যুগ ধরে। এই হলো মানুষের ইতিহাস।
অলোক বসু – নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক, প্রধান কারিগর ‘থিয়েটার ফ্যাক্টরি’