‘করোনার এই আঁধার কেটে সুদিন আসবেই, পৃথিবী ও প্রকৃতি হাসবেই’
১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৯:০২
সেই শৈশব থেকেই অপার বিস্ময়ে প্রকৃতিকে দেখতাম আর ভাবতাম কত বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির গল্প, ছবিগুলো। কতই না বিচিত্র রঙিন প্রকৃতি। তাই হয়তো আমারও লেখালেখিতে, কবিতায় প্রকৃতির প্রভাবটা স্পষ্ট, প্রকট। ইদানিং প্রকৃতি নতুন রূপে হাজির হয়েছে পৃথিবীর সামনে। এতদিনকার বিশ্বায়নের অকল্যাণে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশ্বাস নিতে থাকা বায়ুমণ্ডল আজ আবারও দূষণ মুক্ত হতে শুরু করেছে। হিমালয়ের চূড়া নাকি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলরাশি আবার গাঢ় নীল রঙ ধারণ করতে শুরু করছে, আকাশে মেঘেদের দলও আরও শ্বেতশুভ্র হয়ে উঠছে, অভয়ারণ্যে বন্য পশু-পাখি-প্রাণীরও অবাধ বিচরণ শুরু হয়েছে, প্রকৃতি আবার যেন প্রাণ চাঞ্চল্য খুঁজে পেয়েছে নতুন করে। এর কারণ শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস। গল্পটা কিন্তু বেশ মজার- ছোট্টবেলায় পড়া ঈশপের গল্পের মতো।
একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রজন্ম আমরা। মহামারির গল্প শুধু ছবি, গল্প, কাব্য ও রূপকথায় শুনেছি। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি। দেখিনি মুক্তিযুদ্ধও। শুধু পূর্ববর্তী প্রজন্মের বাবা, দাদুর কাছে যুদ্ধের শাণিত চেতনার গল্প শুনেছি আর বারবার শিহরিত হয়েছি এক গৌরবমাখা অনুভবে। যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাভাবে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার যুদ্ধের গল্পের আঁচও কিছুটা পেয়েছি বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্যের চিত্রে। কিন্তু এবারই প্রথম আমাদের প্রজন্ম মহামারিকে দেখল, অনুভব করল অদ্ভুত এক রহস্যময় যুদ্ধকে।
এ যুদ্ধ এক অদ্ভুত অদেখা রহস্যময় শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞানীরা এই শত্রুর নাম দিয়েছেন কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে এর উৎপত্তি। ভাবতে অবাক লাগে ভেন্না ফলের মত দেখতে কাঁটা যুক্ত এই ক্ষুদ্র অদেখা জীবাণুটির কি চরম শক্তি যে, এক নিমিষে কাবু করে ফেলল মানব জাতিকে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন শুধু বিশ্বব্যপী আক্রান্ত আর মৃত্যু হার জরিপে ব্যস্ত। কি অসীম ক্ষমতায় করোনা এক তুড়িতে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ভয় দেখিয়ে ঘরবন্দি করল সমগ্র পৃথিবীকে! পৃথিবীর মানুষ নতুন কিছু শব্দকে দৈনন্দিন জীবনের অভিধানে যুক্ত করল- কোয়ারেনটাইন, লকডাউন, সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং। জীবনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার কত কায়দা কানুনও রপ্ত করলাম। পরিচ্ছন্নতা, নিয়মমাফিক জীবনযাপন, পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব- অনেক কিছুই শেখালো ‘করোনা’।
তবে আমি যদি করোনা নামের এই ক্ষুদ্র জীবাণুকে প্রকৃতি প্রেরিত এক রহস্যজনক মারণাস্ত্র হিসেবে দেখি, সেখানে করোনা অনেকাংশে সার্থক- প্রকৃতির পক্ষে মানুষের ক্রমবর্ধমান অহমিকাকে ধূলিসাৎ করতে। করোনার আক্রমণে, আতঙ্কে পুরো বিশ্ব হয়তো কাঁপছে। অনেক মানুষের জীবননাশের কারণও হয়েছে এই জীবাণু। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই ভাইরাস মনুষ্যজাতিকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। মৃত্যু আতঙ্কের কাছে দেশ, জাত, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, বিত্ত সব যে ঠুনকো- করোনা দেখিয়ে দিল।
মানুষ এখন আপন জীবন প্রার্থণায় ঘরবন্দি। নিজেদের কৃত পাপগুলোকে বিচার করতে শিখছে। সৃষ্টিকর্তা আর প্রকৃতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। বোধের কাছে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে অনেক মানুষের। অনেকের মানবতার পরশে পাশে থাকা অসহায় হতদরিদ্র দুঃস্থ মানুষগুলো একটু হলেও সাহস পাচ্ছে। সামাজিক দুরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এতসব সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে এবং তা মেনে প্রতিটা মানুষ এখন গৃহবন্দি হয়ে অবরুদ্ধ সময় পার করছে শুধুমাত্র ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিহতের চেষ্টায়। এবং ইতিবাচকভাবে যদি দেখি মানুষ যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর এই যুদ্ধে নিরাপদ দূরত্ব রেখেও ঠিকই কিন্তু একসঙ্গে লড়ছে। পৃথিবীকে সুস্থ করতে এখন এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে সমবেত চেষ্টার বিকল্প নেই। আমরা কেউই একা বাঁচতে পারি না, পারব না। আমি সুস্থ থাকলেই আমার চারপাশটা সুস্থ-সুন্দর থাকবে। এই যে মানবতার মায়ায় ভালোবাসার জাল ছড়াতে শুরু করেছে তাতে মনে হয় না করোনা আর বেশিদিন বিরক্ত করবে পৃথিবীকে। খুব শীঘ্রই হয়ত অন্যসব ভাইরাসের প্রতিষেধকের মতো এরও প্রতিষেধক তৈরি হবে। করোনা নামের ভাইরাস হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানবজাতির আতঙ্কের ইতিহাস থেকে। তবে মহাকালের পাতায়, শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায় হয়তো করোনার পায়ের গভীর দাগ থেকে যাবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, করোনা মনুষ্যজাতির চেতনায় যে পরিবর্তনটা এনে দিয়ে গেছে, সেটা সমুজ্জ্বল অটুট থাক। পৃথিবী মানবতার মায়ায় আবারও সুন্দর হোক। একটা মহামারির আতঙ্ক থেকে অন্তত এই শিক্ষাটা ধারণ করুক মানবতা।
হয়তো লকডাউনের এই পৃথিবীতে আপাতত আমরা কেউই ভালো নেই। আগামী দিনের আর্থ-সামাজিক মন্দাভাবের ভয়াবহতার আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। তবুও একটা আশার আলো বুকে রেখে নতুন ভোরকে স্বাগত জানাতে চাই আগামীর পৃথিবীতে।
মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে। করোনার এই আঁধার কেটে সুদিন আসবেই। সেদিনের অপেক্ষায় হলেও অন্তত ঘরে থাকি সবাই। নিরাপদ হোক আগামীর দিনগুলো- এই স্বপ্নটাই কিলবিল করছে চোখের পাতায়। প্রকৃতি আবার হাসবে। আমরাও একসঙ্গে হাসব। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবো খোলা আকাশের নিচে।
শানারেই দেবী শানু– কবি ও অভিনেত্রী