এমন করে পৃথিবীর গাড়িটা থামুক, আমরা তা চাইনি
১৯ এপ্রিল ২০২০ ২০:১৯
‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও!’
সলিল চৌধুরী প্রায় চল্লিশ বছর আগে পৃথিবীর গাড়িটা থামাতে বলেছিলেন। কোনো এক স্বপ্নরাজ্যে যাবেন বলে তিনি এই পৃথিবীর গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান, সভ্যতার অত্যাচারে অতিষ্ট এই গাড়ি বেশিদূর যেতে পারবে না। এই গাড়ি থেকে নেমে তাকে নিতে হবে অন্য গাড়ি। তাইতো তিনি বলেছিলেন- পৃথিবীর গাড়িটা থামাও।
আজ এতদিন বাদে পৃথিবীর গাড়িটা থেমে গেছে। কলকারখানার কালো ধোঁয়া নেই, গাড়ির হর্ন, লঞ্চ-স্টিমারের সাইরেন নেই। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ আজকের এই অচেনা পৃথিবী। এমনি করে পৃথিবীর গাড়িটা থামুক- নিশ্চয়ই সলিল চৌধুরী তা চাননি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারাবিশ্বের মতো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও আজ আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত আক্রান্তের হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। কাজ হারাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে বেতন থেকে। যেটুকু সঞ্চয় ছিল ধীরে ধীরে তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে কেবল দুঃখী-দরিদ্র মানুষের কান্নার সুর।
এমনই এক পরিস্থিতিতে অন্য প্রায় সব পেশার মানুষের মতো ভালো নেই আমাদের শিল্পীসমাজ। উপার্জনের উৎসটুকু হারিয়েছে সংস্কৃতিকর্মী, আঁকিয়ে, নাট্যজন, যন্ত্রশিল্পী, মৃৎশিল্পী ও কন্ঠশিল্পীরা। মার্চের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া এই মহামারির কারণে একে একে বাতিল হয় মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা দিবসের আয়োজন, চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো। বছরের এই সময়টাতে শিল্পীরা পাড়ায়-মহল্লায়-মেলায়-পার্বণে অনেক স্টেজ শোতে অংশ নেন। শুধু তাই নয়, টেলিভিশন-বেতার থেকে শুরু করে ছোটখাটো ঘরোয়া আয়োজনেও তারা থাকেন। চিত্রশিল্পীরা নানা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। মৃৎশিল্পীরা মাটির তৈজসপত্র, খেলনা ও শো-পিস বানাতে ব্যস্ত থাকেন। মৃৎশিল্পীদের আয়ের একটা বড় অংশ বৈশাখী মেলা থেকেই আসে।
শুধু শহরেই না, মফস্বলেও এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাদের কীর্তন ও পালাগানের দল আছে- তারা একদমই উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এই দুর্যোগ চলতে থাকলে তাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা কল্পনারও বাইরে। মানুষ আজ দিশেহারা। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে দানা বাঁধছে ভয়। এই ভয় শুধু করোনাভাইরাসের নয়; ভয় অভাবের, ভয় না খেয়ে মরার।
শিল্পীরা আমাদেরই অংশ। আমাদের আনন্দের জন্যই তারা পারফর্ম করেন। আমাদের সুখ, দুঃখের অনুভূতির সঙ্গে তাদের পরিবেশনা মিশে থাকে। এই দুঃসময়ে শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিত্তবান ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসুক শিল্পীদের পাশে।
সরকারের কাছে চাওয়া- সারাদেশে সকল দুঃস্থ, দরিদ্র ও করোনাকালে আয়হীন শিল্পীদের তালিকা তৈরি করে তাদের অনুদানের ব্যবস্থা করুন। শিল্পীরা যেন অন্তত কোনোরকম খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারে। শুধু শিল্পীরা কেন, একজন মানুষও যেন অভুক্ত না থাকে। ভালো থাকুক মানুষ, সুস্থ থাকুক প্রাণ ও প্রকৃতি।
লেখক- তবলাশিল্পী
করোনাকাল কোয়ারেনটাইন গোবিন্দ দাস তবলাশিল্পী শিল্পী সলিল চৌধুরী