শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও স্মরণে এন্ড্রু কিশোর
৭ জুলাই ২০২০ ১৯:১৬
থেমে গেল বাংলা গানের এক বিরাট অধ্যায়ের। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য কালজয়ী গানের রূপকার এন্ড্রু কিশোর। মরণব্যধি ক্যানসারের ‘লাস্ট স্টেজে’র সঙ্গে লড়াই করে আর টিকে থাকতে পারলেন না তিনি। ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’— এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানও আর তাই কাউকে অমন দরাজ গলায় শুনতে পাওয়া যাবে না কোনো মঞ্চে। দীর্ঘ ১০ মাস মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই সোমবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি।
সবাই চলে যাবে। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু এতটা কষ্ট দেয়, যা বলে বা লিখে বোঝানো যায় না। কেবল অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায় সেই যাতনা। আট বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই কণ্ঠশিল্পীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া সংগীতসহ শোবিজ জগতের প্রতিটি অঙ্গনে। কাঁদছেন প্রিয়জনেরা, করোনার ভয়াবহতায় ছুটে যেতে পারছেন তাকে একবার শেষ নজর দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে। তাই হয়ত স্মৃতিচারণ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে—
এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খানের হাত ধরে। তার সুরে ‘মেইল ট্রেন’ ছবিতে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর। শিষ্যের মৃতুতে ব্যাথিত দেশের প্রথিতযশা সুরকার আলম খান। শোক জানিয়ে বললেন, ‘১৯৭৭ সাল। ‘মেইল ট্রেন’ ছবিতে এন্ড্রু কিশোর প্রথম গান গেয়েছিল। আমার সুর করা গান। এটি নিয়ে অনেকে আমার কাছে অনেক কিছু শুনতে চান। অনেক পুরনো কথা। ঠিক মনেও পড়ে না এখন। তার চেয়ে বড় কথা, এন্ড্রুর সঙ্গে তো আমার স্মৃতি অনেক। অভাব নাই। তাই প্রথম দিককার গানের কথাটা সেভাবে মাথায় আসে না। অনেক অনেক গুণ ছিল তার। গানের প্রতি কী যে নিষ্ঠা, সততা- তা বলে বোঝানোর নয়। মানুষ হিসেবেও সে অন্যরকম ছিল। কী যে ভোজনরসিক! তার চেয়ে বড় কথা, সে ছিল ভালো মানুষ। সে যখন অসুস্থ হলো, যাওয়ার আগে আমার কাছে বিদায় নিয়েছিল। এমনকি যখন চিকিৎসা চলছিল, এর মধ্যেও সে ফোনা আমার সঙ্গে কথা বলত। এরপর বিষন্ন মন নিয়ে দেশে ফিরল। রাজশাহী যাওয়ার পর আমাকে ফোন দিয়েছিল। সব বলল। তার কষ্ট আমি আর নিতে পারছিলাম না। কয়দিন আগে ফোনে বিদায় নেওয়ার মতো করে বলল, ‘দোয়া কইরেন, যেন শান্তিমতো যেতে পারি। এটাই ছিল আমার সঙ্গে তার শেষ কথা।’
বাংলাদেশের কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে গেয়েছেন অজস্র গান। মেনে নিতে পারছেন না সহশিল্পীর এমন প্রয়ান। লিখেছেন, ‘এন্ড্রু কিশোর আর নেই- খবরটা শুনতে হবে তা ভাবিনি। যখন সিঙ্গাপুরে গেলেন চিকিৎসার জন্য, ভেবেছিলাম ক্যান্সার জয় করে ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম তাকে ফিরিয়া দেওয়ার জন্য। তিনি ফিরলেন না। তার এই চলে যাওয়ায় আমার মনে কী যে শূন্যতা তৈরি হলো তা বলে বোঝাতে পারছি না। এখনো ভাবছি, মেধাবী মানুষকে এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যেতে হয়। আর ভাবতে পারছি না। গলা কেঁপে আসছে। এখন এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছি, চাইলেই তো ছুটে যেতে পারছি না। গত সপ্তাহে দীর্ঘ সময় টেলিফোনে কথা বলেছি। তিনিই সব বলে গেছেন, আমি শুধু কাতর হয়েছি। এমনও অনেক স্মৃতি তুলে এনেছেন, যেটা নিজেও ভুলে গেছি। এখন দোয়া ছাড়া আর কিছু করার নাই।’
এন্ড্রু কিশোরের একেবারে আত্মার আত্মীয় ছিলেন হানিফ সংকেত। দুজন দুজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এন্ড্রু কিশোরের বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হানিফ সংকেত এমন একজন বন্ধুকে হারিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সোমবার ফেসবুকে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন তার শোকের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘এন্ড্রু কিশোর আর নেই, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু সংবাদটি নিজের হাতে এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে কখনো কল্পনাও করিনি। এই মুহূর্তে কানে বাজছে রাজশাহী থেকে বলা কিশোরের শেষ কথাগুলো, ‘দোয়া করিস বন্ধু, কষ্টটা যেন কম হয়, আর হয়তো কথা বলতে পারবো না’। এর পরই খুব দ্রুত শরীর খারাপ হতে থাকে কিশোরের। আমারও যোগাযোগ বেড়ে যায় রাজশাহীতে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে আজ সন্ধ্যায় এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় এন্ড্রু কিশোর-বাংলা গানের ঐশ্বর্য, যার খ্যাতির চাইতে কণ্ঠের দ্যুতিই ছিল বেশি। যার মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনের অনেক বড় ক্ষতি হলো।’
এন্ড্রু কিশোরের আত্মার শান্তি কামনা করে হানিফ সংকেত লিখেছেন, ‘অনেক কষ্ট পেয়েছি বন্ধু, এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবি ভাবিনি। কিশোরের আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে দুইবার প্লেব্যাক করেছেন দেশের আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর। প্রিয় এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তিনি জানালেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা ছিলো বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের মতো। দাদা (এন্ড্রু কিশোর) অনেক স্নেহ করতেন। তার সঙ্গে ২২ বছরের সম্পর্ক আমার। তার কাছে অনেক ভালো পরামর্শ পেয়েছি। সবসময় আমাকে রাগ কমাতে বলতেন। তার চলে যাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিতে খুব বড় ধরনের এক ক্ষতি হয়ে গেল।’
এন্ড্রু কিশোরের শূন্যতা কোনোভাবেই পূর্ণ হবে না। তার কাজ ও স্মৃতি সংরক্ষণ করার অনুরোধ জানিয়ে আসিফ আরো বললেন, ‘১৯৯৮ সালের প্রথমবার এন্ড্রু দাদার সঙ্গে আমার সরাসরি দেখা হয়। উনি শ্রুতি স্টুডিও-১ গান রেকর্ডিং করছিলেন, আমি ছিলাম শ্রুতি স্টুডিও-২ -এ। দাদা আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। রেকর্ডিং শেষে বললেন, তুমি অনেক দূর যাবা। লেগে থাকো।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান। অজস্র সিনেমায় এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন তিনি। এই মহান শিল্পীর মৃত্যুতে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে শোক জানিয়ে শাকিব খান লিখেছেন, ‘দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী, প্লেব্যাক সম্রাট ‘এন্ড্রু কিশোর’র মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগীত আরও একজন লিজেন্ডকে হারালো। এই ক্ষতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন রোমান্টিক গানের মাস্টার ভয়েস। এমন গুণীজনের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত।’
চঞ্চল চৌধুরী- যিনি একাধারে অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী। দেশের বাইরে এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গেই গিয়েছিলেন গান গাইতে। সেই স্মৃতিচারণ করে চঞ্চল লিখলেন, ‘এন্ড্রুদার সাথে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের এন্ড্রু কিশোর দা। অনেক বছর আগে…আমেরিকায়। ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড উপলক্ষে সেটা ছিলো আমার প্রথম আমেরিকা সফর। বাংলাদেশের তিনজন মহাগুণী সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ এবং আইয়ুব বাচ্চু- একসাথে সে বছর ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান আলোকিত করেছিলেন। আমরা একই হোটেলে থাকতাম। অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, উনারা তিনজনই আমাকে অত্যধিক পছন্দ ও স্নেহ করেন। এন্ড্রুদা তো রীতিমত আমাকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে, নিজে গান প্র্যাকটিস করালেন। আমি বলেছিলাম ‘দাদা,আমাকে ক্ষমা করে দেন, আপনাদের সামনে মঞ্চে গান গাইবার সাহস আমার নেই’। এন্ড্রুদার উত্তর- ‘একদম চুপ, তুই গাইবি, নে প্র্যাকটিস কর। অনুষ্ঠান শেষ হলো। কোন মত সাহস করে বেঁচে গেলাম।’
চঞ্চল আরো লিখলেন, ‘রাতে রুমে ফোন দিয়ে দাদা বললেন, কই তুই? আয় আড্ডা দেই। রাতভর আড্ডা… বাচ্চু ভাই, এন্ড্রুদা, বিশ্বজিৎ দা, আসিফ আকবর ব্রো, ফেরদৌস ভাই, আরো কয়েকজন। দাদার চলে যাবার খবর শোনার পর থেকে, কি লিখবো কিছুই মাথায় আসছিল না। হাজার হলেও আমাদের প্রানের মানুষ তো… প্রাণের শিল্পী তো এন্ড্রুদা। সেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেঁসে উঠলো। সবই স্মৃতি হয়ে গেল। তারপর অনেক অনুষ্ঠানে দাদার সাথে দেখা হয়েছে,আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন। আর আমি আস্তে করে বলেছি, ‘দাদা, ঐরকম একটা আড্ডা আবার হয়না?’ দাদা মুচকি হেসে বলতেন, ‘টাইম ম্যানেজ কর, একদিন বসি’। আর কোনদিন বসা হলো না! টাইমও ম্যানেজ হলো না কারো!’
এন্ড্রু কিশোরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চঞ্চল লিখলেন, ‘এন্ড্রুদা সময়ের উর্ধ্বে চলে গেলেন… অবনত শ্রদ্ধা দাদা… সময় আপনাকে অন্য কোথাও নিয়ে গেলেও, আপনি আমাদের মাঝে মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন।’
আট বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই কণ্ঠশিল্পী ৯ মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১১ জুন রাতে একটি বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি তার ঢাকার বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেই চলে যান গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। সেখানে কোর্ট এলাকায় তার বোনের ক্লিনিকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আলম খান আসিফ আকবর এন্ড্রু কিশোর চঞ্চল চৌধুরী রুনা লায়লা শাকিব খান হানিফ সংকেত