Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘নৃত্যশিল্পীদের প্রণোদনা নয়, কাজের বিনিময়ে সম্মানি দেওয়া হোক’


১৩ জুলাই ২০২০ ২১:১১

ওয়ার্দা রিহাব- বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনের একজন প্রিয়মুখ। যিনি আন্তর্জাতিক মানের একজন মূলধারার নৃত্যশিল্পী, নৃত্যশিক্ষক ও কোরিওগ্রাফার। বিশেষ করে মণিপুরী নৃত্যের অন্যতম এই নৃত্যশিল্পী দীর্ঘদিন ধরে নিরলস কাজ করে চলেছেন নৃত্যের প্রচার, প্রসার ও বিকাশে। নিজেকে উজার করে দিয়েছেন নৃত্যের প্রতি ভলোবাসায়।

মণিপুরী নৃত্যের টানে স্কলারশিপ নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মণিপুরী নৃত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ওয়ার্দা। লাভ করেছেন নৃত্য বিভাগে রবীন্দ্রভারতীর স্বর্ণপদক। মণিপুরী নৃত্যের কিংবদন্তি গুরু কলাবতী দেবীর কাছ থেকে পেয়েছেন উচ্চতর শিক্ষা। তার কাছে নাচ শিখেছেন ছয় বছর। এখন নিজেই শিক্ষা দেন। তার নিজের সংগঠন ‘ধৃতি নর্তনালয়’ ছাড়াও তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’র নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক।

নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই ঘরবন্দি সময়েও থেমে থাকেন নি ওয়ার্দা রিহাব। অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তার নৃত্যচর্চায়, নৃত্যশিক্ষায়। তার এই ব্যস্ততার মধ্যেই নতুন করে যুক্ত হল আরেকটি আয়োজন- ভারতীয় দূতাবাসের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)’র অনলাইনে নৃত্যশিক্ষার ওয়ার্কশপ ‘গুরুপ্রথা-২’।

আইজিসিসি’র পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছে অনলাইনে মনিপুরী ও কত্থক নৃত্যের ওয়ার্কশপ। এতে মনিপুরী নৃত্য শেখাবেন ওয়ার্দা রিহাব। প্রতিটি নৃত্য শাখায় ৪৫ জন করে মোট ৯০ জন শিক্ষার্থী অনলাইনে লাইভের মাধ্যমে অংশ নিতে পারবে এই ক্লাসে।

ওয়ার্দা রিহাব আইজিসিসি’র এই আয়োজন এবং ঘরবন্দি সময়ে তার যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়ে কথা বললেন সারাবাংলা’র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্ত’র সঙ্গে। তারই বিস্তারিত সারাবাংলা’র পাঠকদের জন্য…

• প্রসঙ্গঃ অনলাইনে নৃত্যশিক্ষার ওয়ার্কশপ ‘গুরুপ্রথা-২’ _

‘গুরুপ্রথা- ২’ হচ্ছে অনলাইনে নৃত্যশিক্ষার একটা ওয়ার্কশপ- যার আয়োজন করেছে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার। এটা দ্বিতীয় সেশন। তবে এবারের অনলাইন ওয়ার্কশপটা একটু অন্যরকম। ‘গুরুপ্রথা’ নামে কিছুদিন আগে যে ওয়ার্কশপটা হয়েছিল, সেটাতে ক্লাসের ভিডিওটা আগে রেকর্ড করে শিক্ষার্থীদের ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হত- যেটা দেখে দেখে ওরা শিখেছে। এবার অনলাইনে লাইভে ক্লাসটা নেয়া হবে। ‘গুরুপ্রথা- ২’র ক্ষেত্রে যে বিষয়টা সবচেয়ে আনন্দের, তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি সংযোগ। আমার ক্লাস সপ্তাহে একদিন- প্রতি শুক্রবার। প্রাথমিক, ইন্টারমিডিয়েট, এডভান্স- তিনটা ব্যাচে আমি ‘মনিপুরী নৃত্য’ শেখাবো। ‘কত্থক’ নৃত্যের ক্ষেত্রেও একই- যেটা শ্রদ্ধেয় নৃত্যগুরু মুনমুন আহমেদ শেখাবেন। এখানে ‘প্রাথমিক’ মানে যারা একেবারে নতুন- মনিপুরী নাচকে হয়ত চেনে, কিন্তু জানেনা, তাদের জন্য। ‘ইন্টারমিডিয়েট’ হচ্ছে যারা দু’তিন বছর ধরে মনিপুরী বা অন্য কোন শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখছে তাদের জন্য। আর যারা সিনিয়র নৃত্যশিল্পী বা নৃত্যশিক্ষক, তারা যদি মনিপুরী নৃত্য সম্পর্কে গভীর ভাবে জানতে চান বা অনুশীলন করতে চান- মূলত তাদের জন্যই ‘এডভান্স’ ব্যাচ। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, এখানে কোন ফি নেই। কোন বয়সসীমা নেই। শুধুমাত্র আইজিসিসি’র দেয়া লিংকে রেজিস্ট্রেশান করে এতে অংশ নেয়া যাবে। এবং সেটা ১৮ জুলাই-এর মধ্যে।

• সম্পৃক্ততা _

ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমার আগে থেকেই ছিল। ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় সাত বছর আমি মনিপুরী নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলাম। গত একবছর যাবত ওদের সবগুলো নাচের ক্লাসই বন্ধ হয়ে আছে। যার ফলে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মধ্যে একটা শূন্যতা ছিল। কিন্তু এখন আইজিসিসি আবার এই উদ্যোগটা নেয়ায় আমি আনন্দিত। এক্ষেত্রে একটু পার্থক্য রয়েছে- আগে সশরীরে ক্লাসটা নিতাম, এখন অনলাইনের মাধ্যমে নিতে হবে। তারপরও এটা আনন্দের যে, শিক্ষার্থীদের সাথে আবার যুক্ত হতে পারছি। অন্তত নাচটা আর থেমে থাকল না।

• আপনি তো আগে থেকেই অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, নাচ নিয়ে কাজ করছেন _

আসলে নাচ হচ্ছে আমার ভালোবাসার মাধ্যম, আমার কাজের প্রিয় জায়গা। আমি সবসময় নাচ নিয়েই থাকব- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই করোনাকালে আমার নিজের পারফর্মেন্স পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। পাশাপাশি আমার চর্চাটাও কিছুটা হলেও কমে গেছে। বিশেষ করে গত ১৫ দিন যাবত আমার অন্যান্য কর্মকান্ড গুলো কিছুটা শিথিল হয়ে আছে। তার কারণ আগামী ২৯ তারিখে ভারতীয় একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য উৎসবে আমি অংশ নেব। সেটার জন্যই তৈরি হচ্ছি। করোনাকালের প্রথম মাসে আমি প্রচুর কাজ করেছি। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী-সহ বেশ কয়েকটা আয়োজন নিয়ে আমার পরিবেশনা ছিল। পরের মাসটাতে আমি আমার অনলাইন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে প্রায় একশ জন শিক্ষার্থী এই ক্লাসে সম্পৃক্ত ছিল। তাদেরকে আমি আমার পুরো সময়টাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। অনলাইনে স্কুলিং সিস্টেমটাকে দাড় করাতে গিয়ে ওই মাসটাতে আমাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এখন এটা বেশ সুন্দর ভাবেই চলছে।

• আইজিসিসি’র এই আয়োজন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা _

আইজিসিসি’র এই আয়োজনটা আমাদের নাচের জগতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমি সবসময় যেটা ফিল করি, অনেক ছেলে মেয়ে আছে, যারা টাকা দিয়ে আমাদের কাছে ক্লাস করতে পারছেনা। বিশেষ করে করোনার এই সময়টাতে অনেক নবীন নৃত্যশিল্পী আর্থিক সংকটে ভুগছে। এক্ষেত্রে তারা কোন টাকা বা সম্মানি ছাড়াই শুধুমাত্র রেজিস্ট্রেশান করেই নাচটা শিখতে পারবে। বিশেষ একটা শাস্ত্রীয় নৃত্যের সংগে তারা পরিচিত হতে পারবে। পাশাপাশি যারা ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে থাকে, দীর্ঘদিনের জন্য ঢাকায় এসে আমাদের কাছে ক্লাস করা সম্ভব নয়; তাদের জন্যও এটা অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। আমি মনে করি, তারা এটা করার পর তার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়ে যাবে যে, আগামীতে সে নৃত্যের কোন মাধ্যমটা নিয়ে কাজ করবে। একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে শাস্ত্রীয় নৃত্য সম্পর্কে জানার যে আগ্রহ, সেটা আমাদেরকেই তৈরি করে দিতে হবে। তাই আমি মনে করি এদের মধ্যে যদি একজনই শাস্ত্রীয় নৃত্যটাকে পুরোপুরি গ্রহণ করে, সেটাই আমাদের সার্থকতা। অন্তত একজন হলেও সত্যিকার শিক্ষিত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী আমরা তৈরি করতে সক্ষম হবো। আর এটা একমাত্র আইজিসিসি’র কল্যাণেই সম্ভব হচ্ছে। বিনা বেতনে শাস্ত্রীয় নৃত্যশিক্ষার একটা বিশেষ সুযোগ।

• নাচ নিয়ে বর্তমান ভাবনা _

এখন আমার পরিকল্পনা একটাই- শাস্ত্রীয় নৃত্যে আরেকটু বেশি সময় দেয়া। করোনার আগে আমরা শুধু পারফর্মেন্সের মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু বিশেষ নির্দেশনামুলক তেমন কোন কাজ আমরা করতে পারিনি। তাই এবার আমি তেমনই একটা কাজ করতে চাই। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- যেখানে আমি নৃত্যকলা বিভাগে শিক্ষকতা করি, সেখানেও গত ৭ তারিখ থেকে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু হয়ে গেছে। সেটা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ মাসের ২৪ তারিখ থেকে আইজিসিসি’র ক্লাসটাও শুরু হবে। বলা যায়, এই নিউ নরম্যাল টাইমটাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।

• সবশেষে _

সবশেষে সরকার বা নৃত্য সংশ্লিষ্টদের কাছে আমার একটা বিশেষ দাবী বা আর্জি জানাতে চাই; সেটা হচ্ছে করোনাকালিন এই সময়টাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করাটা খুবই জরুরী। কারণ যেসব নৃত্যশিল্পীরা বর্তমানে আর্থিক সংকটে ভুগছে, তাদেরকে শুধুমাত্র আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তাদের উৎসাহ বা চর্চাটাকে দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। আর এই আর্থিক প্রণোদনাটাও একজন শিল্পীর প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য, আবার সেটা এককালীন। তাহলে সেই শিল্পী পরের মাসগুলোতে কিভাবে চলবে? তাই আমি মনে করি, শুধুমাত্র এককালীন আর্থিক প্রণোদনা বা অনুদান না দিয়ে বরঞ্চ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করে সেখানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তার পারফর্মেন্স করার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেই শিল্পীর চর্চাটাও চলবে, আবার আর্থিক ভাবেও সে সচ্ছল থাকবে। এবং এটা একজন শিল্পীর জন্য অনেক সম্মানের যে, সে অনুদান নয়, কাজের বিনিময়ে সম্মানি গ্রহণ করছে। সম্মানজনক ভাবেই সে জীবিকা নির্বাহ করছে। এ ব্যাপারটাতে যদি সরকার বা সংস্কৃতির নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি বা সংস্থাগুলো যদি একটু দৃষ্টি দেন তাহলে নৃত্যশিল্পীরা উপকৃত হবেন। করোনাকালিন এই দুঃসময়ে এ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করাটা বিশেষ প্রয়োজন বলেই আমি মনে করছি।

অনলাইন ওয়ার্কশপ আইজিসিসি ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার ওয়ার্দা রিহাব কলাবতী দেবী কোরিওগ্রাফার গুরুপ্রথা নৃত্যশিক্ষক নৃত্যশিল্পী মণিপুরী নৃত্য


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আইভরি কোস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪০

সম্পর্কিত খবর