আমাদের কিশোর মামা
১৫ জুলাই ২০২০ ১২:০৩
বছরের পর বছর বাংলাদেশের গান সাম্রাজ্যে একচেটিয়া শাসন করেছেন একজন এন্ড্রু কিশোর। সেই সাম্রাজ্য, সিংহাসন, মায়া-মমতা সব ছেড়ে কিছুদিন আগে উনি ইহলোক ছেড়ে পাড়ি জমালেন পরপারে। খবরটা শোনার পর থেকে সেই সন্ধ্যা থেকেই মন কাঁদছিলো। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছিলো অনেক অনেক বছর আগের টুকরো টুকরো কিছু মিষ্টি স্মৃতি যখন তিনি ছিলেন আমাদের কিশোর মামা।
তিনি তখনও আজকের বিখ্যাত মানুষটি হয়ে ওঠেননি। তখন আমি ক্লাস টুতে পড়ি। আমাদের বিল্ডিংটা নতুন হয়েছে। আমরা চার তলায় থাকি। তিন তলায় চারজন ভাড়া নিলেন। আফজাল মামা, মঞ্জুমামা, কিশোরমামা আর একজন যাকে আমরা শফিদাদা বলে ডাকতাম। কারণ, উনি ছিলেন আফজাল মামার ভাগ্নে। আম্মুর কাছে শুনলাম কিশোরমামা নাকি গান গায়। প্রথম প্রথম দূর থেকে দেখতাম। ভয়ে কাছে যেতাম না। তারপর একদিন ডেকে অনেক কথা বললেন। সেই থেকে ওনাদের সাথে দূরত্বটা ঘুচে গেল। তখন ওনাদের কাজ করে দিতেন নাসিমার মা। আমরা তাকে খালা ডাকতাম। বুয়াদের রান্না যা হয় আরকি। মামারা সেই রান্না মুখে তুলতে পারতেন না প্রায়ই। অনেক দিনই দেখতাম আম্মুকে আপা আপা ডাকতে ডাকতে চলে আসতেন। ‘আপা ভাত খাবো তরকারি দেন। বুয়ার তরকারি ভালো হয় নাই।’ আমার আম্মুও ভালো কিছু রান্না হলেই ওনাদের পাঠিয়ে দিতেন আর বলতেন, ‘আহারে মা-বাবা ছাড়া এখানে থাকে। কাজের বুয়া কি রান্না করে না করে। ওরা খেতে পারে না।’ তাদেরকে আম্মু ভাই ডাকতেন আর সেই চোখেই দেখতেন। আমাদের কাছেও তাই ওনারা ছিলেন খুবই প্রিয় মামা।
প্রায়ই সন্ধ্যা বা রাতের বেলা কিশোরমামাকে বাসায় ফিরতে দেখতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে জিন্সের জ্যাকেট আর প্যান্টের সাথে এখনকার ছেলেদের লোফার সু স্টাইলে একটা সু পরতেন যেটার একটু হিল ছিলো। যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতেন শব্দ হতো। সিঁড়িতে সেই শব্দ পেলেই আমরা বুঝে যেতাম মামা আসছেন। উনি যে তখন এই গানের জগতে পা রাখার জন্য যে এত পরিশ্রম করছেন তা পরে বুঝেছি। অথচ গানের ভূবনে তিনি রাজাধিরাজ হয়ে গেলেন তার একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর পরম সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায়।
রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও উনি আপন মামার মতই আমাদের আদর করতেন। একদিন এসে হুট করে বললেন, ‘আপা, ওদের দুজনকে (আমাকে আর আমার বোনকে দেখিয়ে) রাজশাহী বেড়াতে নিয়ে যাবো।’ সেই ক্লাস টুতে আমার প্রথম প্লেনে চড়া কিশোরমামা আর আফজালমামার সাথে। ঈশ্বরদীতে নেমে তারপর রাজশাহী। আমরা উঠলাম আফজাল মামার বাসায় কারন ওখানে আমাদের কাছাকাছি বয়সের ওনার ভাতিজা-ভাতিজি ছিলো। আমরা খুব মজা করেছিলাম সেখানে। কতদিন ছিলাম মনে নেই কিন্তু কিশোরমামা ওনাদের বাসায় নিয়ে গেলে তার মা পরম যত্নে আমাদের রান্না করে খাওয়ালেন। এরপর রাজশাহী ভার্সিটি ক্যাম্পাস, চার্চ এগুলা ঘুরে ঘুরে দেখালেন।
আস্তে আস্তে দেখলাম মামার ব্যাস্ততা বাড়তে লাগলো। গান রেকর্ড করে এক কপি ক্যাসেটে আমাদের দিয়ে যেতেন। যেকোন মুভি হলে আসার কয়েকমাস আগেই গানগুলা আমরা শুনে ফেলতাম। ‘ভালবেসে গেলাম শুধু ভালবাসা পেলাম না।’ এই গান শুনে আমরা তিনবোন পাগল হয়ে গেলাম। ধরলাম মামা আমাদের এই গান টা শিখিয়ে দেন। উনি পরম যত্নে এই গানটা নিজে হারমোনিয়ামে তুলে দিলেন। অথচ সেই সময়ে ওনার জনপ্রিয়তা এবং ব্যাস্ততা তুঙ্গে। আর একটা গানের কথা খুব মনে পড়ছে। আজ অবধি এই গানটা আমার খুবই ভালো লাগে। ‘সুখ কিবা দুঃখ, প্রেম কি বিরহ’ এক জায়গাতে কিছুতেই হচ্ছিলো না। উনি আমাকে পাশে বসিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আরেকদিন কেন যেন গিয়েছিলাম শুনি মামা তানপুরায় রেওয়াজ করছেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘জানো, এইটা কি রাগ?’ আমি মাথা না সূচক মাথা নেড়ে বললাম যে, ‘জানিনা’। বললেন, ‘এটা রাগ মালকোষ। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় রাগ।’ তখন না বুঝলেও পরে বুঝলাম সত্যিই কতই না মধুর এই রাগ মালকোষ।
প্রায় অনেক গানই রেকর্ড করেই আমাদের দিয়ে যেতেন মামা। একদিন ‘জীবনে মরনে আমরা দুজন জ্বালবো প্রেমেরই বাতি’ গানটা শুনছিলাম। মামার সামনে গানটা অনেক সুন্দর বলতেই উনি আমার ভাইকে বললেন এই সিনেমা টা আসলে দেখো। আমরা পরে সবাই মিলে ওই সিনেমা দেখেছিলাম। আরেকদিন রাতে আমরা ভাইবোন সবাই মিলে ওনার সদ্য রেকর্ড করা গান শুনছিলাম। গানপাগল। গানগুলা শুনে আমরা এমন মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে দুইটা গান যে কতবার শুনলাম। তাও মনে হয় মন ভরছিলো না। গান দুটা ছিলো নয়নের আলোর ‘আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে।’ আর ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি।’ আহা কি গান! ভাবাই যায় না কি যে মনে ধরেছিলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে আমার কানে তখনও, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে গানটির সুর ভাসছিলো। এসব গানের স্রষ্টা আর গায়কের অসামান্যতার প্রমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গানের আবেদন বিন্দুমাত্র না কমা। এগুলো যেন আজও আধুনিক। আজও সেই প্রথম দিনের মতই ভালোলাগা রয়ে গেছে। আরেকটা গান উনি নিজের মুখে বললেন, ‘এই গান টা খুব ভালো’। সেটা হল, ‘আমি চক্ষু দিয়ে দেখতেসিলাম জগত রংগিলা।’ সৈয়দ আব্দুল হাদীর সাথে গেয়েছিলেন।
কোন ঈদে সম্ভবত প্রথমবারের মত টেলিভিশনে মামার গান দেখাবে আনন্দমেলায়। আব্বুর কাছে আমাদের চারজনের টিকেট দিয়ে গেলেন। টিভি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান দেখার জন্য। আম্মু, আব্বু আমি আর আমার বোন কি উৎসাহ নিয়ে যে সেই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে সেই গল্পই শেষ হয়না। মামা সে প্রোগ্রামে হালকা আকাশি নীল রঙের মুন লাইটের একটা শার্ট পরেছিলেন। গানটা ছিলো, ‘ও আমার উদাস মন, চলো দূরে কোথাও হারিয়ে যাই।’ এরপর থেকে অনেককেই দেখতাম ওনাকে মজা করে ‘উদাস মন’ নামে ডাকতেন।
গানের সুবাদে অনেক প্রতিষ্ঠিত গায়কদের আসা যাওয়া ছিলো ওনার বাসায়। সুবীর নন্দী, তপন চৌধুরী, আব্দুল মান্নান রানা, এম এ শোয়েব, খুরশীদ আলম। কুমার বিশ্বজিতের গান পছন্দ করতাম বলে উনি যখন প্রথম এসেছিলেন আমাকে ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন যে তোমার একজন ক্ষুদে ভক্ত। এরপর একবার কুমার বিশ্বজিতের বাসায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। একবার মামার কাছে আবদার করলাম, রুনা লায়লা কে দেখবো। উনি তখন শ্রুতি স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন সাবিনা ইয়াসমিন আসলেও রুনা লায়লা আসেননি।
কিশোর মামা একবার ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলেন কোন এক প্রোগ্রামে। সেখান থেকে আমাদের তিন বোনের জন্য তিনটা ওড়না এনেছিলেন। সেই উপহার পেয়ে আমাদের আনন্দের সীমা ছিলো না। কারন তখন সিলসিলা কাপড় নতুন আসছে। সেই সিলসিলা ওড়না। বড়বোনের জন্য আকাশি নীল, মেজ বোনেরটা হালকা গোলাপি আর আমারটা ছিলো টকটকে লাল। কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর আর মায়ায় জড়ানো সেই ওড়নাগুলো বহুদিন ছিলো আমাদের কাছে যত্ন সহকারে। এরও বহুদিন পর আমি তখন ক্লাস টেন বা নাইনে পড়ি। সে সময় দুবাই থেকে আমার আর আমার বড়বোন দুইজনের জন্য শাড়ি নিয়ে এলেন। আমরা তো অবাক। বোনেরটা ছিলো ঘিয়ে কালারের উপর হালকা প্রিন্ট আর আমার টা ছিলো সবুজ এক কালারের জর্জেট। এই শাড়িটা এখনও আমার কাছে আছে।
আসলে উনার স্মৃতিচারণ করতে গেলে অনেক কথা চলে আসে যা লিখে শেষ করা যাবে না।
কিশোর মামার আম্মা যখনই আসতেন ছেলের কাছে আমার আম্মুকে বারবার বলতেন, ‘ভাইটাকে দেখে রেখেন।’ আমার আম্মু সবসময়ই অল্পসময়ের মধ্যে মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে। তিনিও বড় বোনের মতই ওনার আম্মুকে আশ্বস্ত করতেন। অনেক সময়ই দেখেছি কিশোর মামা বড় অংকের টাকা আম্মুর কাছে গচ্ছিত রেখে যেতেন।
মামার বিয়ের সময় নিজে এসে আম্মুকে দাওয়াত দিয়ে গেলেন। সেই রাজসিক আর তারকাখচিত বিয়েতে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো।
আমার আব্বু-আম্মুকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে আমাদের প্রায় সব ভাইবোনের বিয়েতে এত ব্যাস্ততার মাঝে সময় করেও উপস্থিত হয়েছেন। তেমনি আব্বুর আর আমার বোনের মৃত্যুতে ওনার চোখেও পানি দেখেছি। আমাদের সান্তনা দিতে গিয়ে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
এত নাম-ডাক, বিপুল জনপ্রিয়তা, সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া এবং খবরের হেডলাইনে থাকা মানুষটা আমাদের কাছে ছিলেন শুধুই কিশোরমামা। যিনি আমাদের জীবনের অনেক সুখ-দুঃখে পাশে থেকেলেন। যশ-খ্যাতি তাকে তার অতীত ভুলিয়ে দিতে পারেনি। এসব তাকে সেই অহংকারের চূড়ায় নেয়নি যেখানে উঠে উনি আমাদের ভুলে যাবেন।
নিজের বাড়ি করে চলে গেলেও কখনও ভুলে যাননি আমাদের। প্রতিটি বড়দিনে আম্মুর জন্য কেক নিয়ে আসতেন। আম্মুকে তার নিজ বাড়ি যেতে খুব অনুরোধ করতেন। গত ৭/৮ বছর আগে একবার আম্মুর সাথে অভিমান করে বললেন ‘আপা আপনি যদি আর আমার বাসায় না যান, আমি আর আসবো না।’ সত্যিই এরপর উনি আর আসেন নি। আমার আম্মু সেদিন কাঁদতে কাঁদতে এই কথাই বলছিলেন, ‘কেন যে একটা বারও গেলাম না।’ মামার ক্যানসারের খবরটাও মিডিয়াতেই জেনেছি। আজ শুধুই আফসোস আর দীর্ঘশ্বাস।