‘দুঃখের দিনে কাছের মানুষটাকে হারালাম’
১৫ নভেম্বর ২০২০ ১৭:২৩
শেষ হল ৪১ দিনের লড়াই। হাসপাতালের বেডে টানা এতদিন ধরে প্রকৃত যোদ্ধার মতো লড়ে যাচ্ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু অনুরাগীদের এত প্রার্থনা, চিকিৎসকদের হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও আর ফিরে এলেন না প্রিয় ‘ফেলুদা’। বাঙালি হারালো তার ‘আইকনিক হিরো’কে। ফিল্মি কেরিয়ারে মোট ৩০০টিরও বেশি ছবি করেছেন তিনি। আর বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির প্রতি তার যে অবদান, তা বোধহয় এই সুবিশাল কর্মজগৎ থেকে আলাদা করে ৩-৪টি ছবির নামোল্লেখ করে বলা অসম্ভব।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বিনোদন জগৎ। তার সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে পুরো অনুরাগীকূল, প্রত্যেকেই শোকে মূহ্যমান। কেউ প্রিয় অভিনেতাকে একটিবার শেষ দেখার জন্য ভীড় জমিয়েছেন বেলভিউ হাসপাতালের বাইরে, আবার শর্মিলা ঠাকুর, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেনের মতো অভিনেত্রীরা ফোন ধরে কান্নাজড়ানো গলায় ভাগ করে নিলেন তাঁদের স্মৃতি।
কারও কাছে প্রিয় ‘পুলুদা’, কারও কাছে সৌমিত্রবাবু, কারও কাছে আবার শুধুই সৌমিত্র। কেউ ছিলেন অপুর অপর্ণা, কেউ অমূল্যর মৃণ্ময়ী, কেউ আবার অমলের চারুলতা। পর্দায় এভাবেই বারবার সৌমিত্র-সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, তনুজা থেকে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। প্রত্যেক নারীর সঙ্গে পর্দায় ভিন্ন রসায়ন ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র।
‘খাবার পর একটা করে কথা দিয়েছ’। হাসিমুখে স্ত্রীর আবদার রেখেছিল অপরাজিত। আর এই এক দৃশ্যেই পর্দায় অপু-অপর্ণার অমরগাথা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। হয়েছিল সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সফর। ক্যামেরার নেপথ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের। বন্ধুত্বের সেই রসায়ন পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছে ‘দেবী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘বর্ণালী’র ভিত। ফোন ধরে কথা বলতে পারলেন না শর্মিলা ঠাকুর। গলা বুজে আসছিল অভিনেত্রীর। “দুঃখের দিন কাছের মানুষটাকে হারালাম। ভেবেছিলাম লড়াইটা জিতে যাবেন। গৌতমের (ঘোষ) ‘আবার অরণ্য’-এর সব স্মৃতি ভীড় করে আসছে”, বলেই পরে কথা বলছি বলে ফোন রেখে দিলেন।
অমূল্য আর মৃণ্ময়ীর সম্পর্কে ছিল ভিন্নতার ছোঁয়া। শহুরে অমূল্য প্রথম দেখাতেই গ্রামের ডানপিটে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। মাত্র ১৬ বছরের অপর্ণার সঙ্গে ২৬ বছরের সৌমিত্রর বন্ধুত্ব হতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। শুটিংয়ের ফাঁকে নাকি সৌমিত্রর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ খুঁজতেন অপর্ণা সেন। অনেক কিছু শিখতে পারতেন তার থেকে। দু’জনের এই পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক দর্শদকের উপহার দিয়েছে ‘আকাশ কুসুম’, ‘বাক্স বদল’, ‘নিশিমৃগয়া’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘পারমিতার একদিন’, ‘বসু পরিবার’।
কিংবদন্তী প্রয়াণের সাথেই সবকিছুই শেষ হয়ে গেল। এমনটাই ভাবছেন অপর্ণা সেন। বললেন, ‘আমি অভিভাবককে হারালাম। ওর মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ১৪ বছর বয়সে ওর সঙ্গে আলাপ। মুখে দাদা ডাকলেও ওর প্রতি বিশাল একটা শ্রদ্ধা সবসময়েই ছিল। পরের দিকে সবসময়ে ঠাট্টা করে বলতেন, তুমি ডিরেক্টর হয়ে মুশকিল হল। আমাদের জুটিটা ভেঙে গেল। আমার ছবিতে নেওয়ার কথা বলেও হাসিঠাট্টা হত। মনে হল মাথার উপর থেকে ছাতা সরে গেল।’
ফোনে কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল প্রবীণ অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়েরও। বললেন, ‘যার সঙ্গে এতদিন কাজ করেছি, পারিবারিক বন্ধু ছিল, তার মৃত্যুতে আমি কিছু বলতে পারছি না। উনি আমাদের বিরাট ক্ষতি করে গেলেন। উত্তমকুমার চলে যাওয়ার পর উনিই পূরণ করেছিলেন সেই ক্ষতি। আর আবার একটা শূন্যস্থান হয়ে গেল।’
অপর্ণা সেন শর্মিলা ঠাকুর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়