সিনেমার ‘ম্যাভরিক’ কিম কি দুক
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:২০
কোরিয়ান সিনেমা পরিচালক কিম কি দুকের সিনেমার সাথে আমার পরিচয় ২০০৪ সালে। ময়মনসিংহের এক কিশোরের জন্য সেই সময়ে ‘ব্যাড বয়’ আর ‘থ্রি আয়রন’ ছিল মনজাগোতিক জগতে এক বিপ্লবের নাম।
জানলাম কোরিয়ায় এমন একজন সিনেমা পরিচালক আছেন যিনি মানুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া সমস্ত বিশ্রী আর সুন্দর ব্যাপার একই ফ্রেমে একই টাইমলাইনে নিপুণ দক্ষতায় এক মাদকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেন। সেই থেকে কিম কি দুক আমার নিজের পরিচালক। আমার মনোজাগতিক জগতের একান্ত আপনজন। তার সাথে পরিচয় হয়নি, দেখা হয়নি অথচ আমার তাকে বড্ড চেনা,বড্ড আপনজন মনে হয়।
২০০৪-০৫ সালের দিকে আমাদের বিদেশি সিনেমার একমাত্র ভরসা ছিল ডিভিডি। শাহবাগ-নিউমার্কেট-এলিফেন্ট রোড-রাইফেল প্লাজা-মোহাম্মদপুর যেখানে যেখানে ভাল কালেকশনের ডিভিডির দোকান ছিল চরকির মত চক্কর দিতাম। হাজার হাজার ডিভিডির স্তুপ থেকে ভুবুক্ষের কাকের মত খুঁজে বেড়াতাম কিম কি দুকের সিনেমা। কিমের একটা সিনেমা পাওয়া মানে সেই দিনটায় আমি জগতের সেরা সুখী মানুষ। বড্ড যত্নে রাখা কিমের সিনেমার ডিভিডি আমার কাছে এখনো আছে।
এই টরেন্টের যুগে এখনো আমি সেই সমস্ত ডিভিডির গায়ের ধুলো ঝাড়ি,পরম মমতায় হাত বুলাই!
কিমের জন্ম ১৯৬০ সালে। শুরু থেকেই আর্টের সাথে কিমের সম্পর্ক। ১৯৯০ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত কিম প্যারিসে পড়াশোনা করেছেন ফাইন আর্টস বা চিত্রকলা নিয়ে। এরপর দেশে ফিরে একজন স্ক্রিন রাইটার হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করেন আর প্রথম সিনেমাতেই কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল প্রাইজ জিতেন। ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন তার প্রথম সিনেমা-ক্রোকোডাইল।
খুব লো বাজেট প্রডাকশন ফিল্ম এটা কিন্তু কি অসামান্য স্টোরিটেলিং আর গায়ে কাটা দেয়া পারফর্মেন্সের সিনেমা। এই সিনেমার পর সমগ্র কোরিয়া আর বিশ্বে কিম দু দুকের নাম ছড়িয়ে পড়ে। দারুণ সব রিভিউ দিতে শুরু করেন জগতের স্বনামধন্য সব ফিল্ম ক্রিটিকেরা। এরপর একের পর এক সিনেমা বানিয়ে বিশ্বকে নতুন ভাবে সিনেমায় গল্প বলার ধরণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন,যাকে আমরা ভালবেসে ডাকি “কিম কি ফিল্ম”। কিমের যে ফিল্মগুলো চোখ বন্ধ খোলা রেখে এক নিমিষে আমি বলতে পারি,আমার ভাবনায় ঝড় তোলে,আবার সেই ঝড় শান্তও করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Wild Animals, Birdcage Inn, The Isle, Real Fiction, Spring, Summer, Fall, Winter and Spring, Samaritan Girl, The Bow, Time, Breath, Pietà, Human, Space, Time and Human।
কিমের সিনেমা কেন অন্যসব সিনেমা ফর্মেশনের একদম বাইরে সেটা পুরোপুরি বুঝতে হলে বা আত্মস্থ করতে চাইলে কিমের সিনেমা দেখার বিকল্প নেই,পৃথিবীর কোন ক্রিটিকের পক্ষেই তা সম্পুর্ণ রুপে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমাকে কিম কেন এতটা বিমোহিত করেছে জানতে চাইলে আমি বলব, কিমের সিনেমায় জীবনের মন্দ-কুৎসিত-অপ্রকাশযোগ্য বিষয়গুলো এত সহজে, এত সাবলীলভাবে মানুষের সৌন্দর্য্যের সাথে মার্চ করে যে তা এক কথায় অনবদ্য, সেই সাথে প্রচণ্ড দুঃসাহসী।
আমরা যারা ইন্ডিপেনডেন্ট বা স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র বানাতে চাই, নিজের গল্পটা একদম মার্কেট প্রেশারের বাইরে গিয়ে নিজের মত করে নির্মাণ করতে চাই তাদের জন্য কিম কি দুক অনেকটা বাইবেলের মত। কেমন করে স্বল্প পরিসরে, একটু একটু করে নান্দনিক সিনেমা বানানো যায় তা কিম বহুবার বহু সিনেমা বানিয়ে দেখিয়েছেন। যা কোরিয়া হয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীদের অলি গলিতে। ঢুকে পড়েছে আমার মত বহু তরুণের মস্তিষ্কে অনন্তকালের জন্য!
লেখকঃ চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা