অজানা এক জ্বীনের খোঁজে
১২ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৩৩
হুমায়ুন আহমেদ তার হিমুকে নিয়ে চিরকালের জন্য না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ঠিকই, তবে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সিনেমা-পাড়া খুঁজে নিয়েছে এক নতুন হিমুকে! কিছুটা ভবঘুরে কেরালার সেই হিমুর কিঞ্চিৎ দর্শন পাবার আশায় আমাদের যাত্রা মালায়লাম ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির দিকে।
মালায়লামের নতুনদিনের সিনেমা গুলোকে বলা যেতে পারে একেবারে ‘ডিকনস্ট্রাকশন অফ ট্রেডিশনাল কমার্শিয়াল সাউথ এশিয়ান সিনেমা’। আপনি যদি গতানুগতিক ধারণা নিয়ে সিনেমা দেখতে বসেন যে ধুন্ধুমার মারপিট, নায়কোচিত সংলাপ, গতানুগতিক রোমান্স-ডান্স, রগরগে দৃশ্য আপনাকে দুইঘন্টা বুদ করে রাখবে তাহলে আপনি যেখানে ছিলেন সেখানেই থাকেন আর প্রথা ভেঙে নতুন স্বাদ নিতে চাইলে মালায়লাম সিনেমার তুলনা অদ্বিতীয়। তারা দেখিয়েছে স্বল্প বাজেটেও কিভাবে একইসাথে বাণিজ্যিক ভাবে সফল পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। সেখানকার নতুনদিনের সিনেমাগুলার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সিনেমাকে স্টুডিও-সেটের বাইরে এনে স্থানীয় সংস্কৃতি আর প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া চেষ্টা।
বলছি মালায়লামের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা চার্লির (২০১৫) কথা, দুলকার সালমান অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি তেমনি এক সিনেমা যেখানে নায়ক-নায়িকার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে সাকুল্যে একবার, ছিল না কোন বাগাড়ম্বর তাও দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে শেষ পর্যন্ত অজানা টানে।
সিনেমার শুরু এক স্বাধীনচেতা মেয়ের পালিয়ে বেড়ানো নিয়ে। ঘটনাক্রমে বিয়ের হাত থেকে বাচতে সে এসে হাজির এমন এক রহস্যে, যেখানে থাকত এক ‘জ্বীন’! এই জ্বীন ঘুরে বেড়ায়, আঁকাআকি করে, জাদু জানে, নিজের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে জানতে চায় কাছের-দূরের মানুষের সাথে তার হৃদয়ের সম্পর্ক কতদূর। একদিন ঘটনাক্রমে তেসার হাতে পড়ে এক অসমাপ্ত কমিক দিনলিপি যার পরেরটুকু জানার চঞ্চলতা, ব্যাকুলতা তাকে নিয়ে যায় নতুন নতুন উপ-গল্পের দিকে। এখন আর আমাদের আগ্রহ শুধু কমিকের পরের অংশ জানতে চাওয়ায় নিবদ্ধ থাকেনা বরং আমরা খুজতে থাকি চার্লিকে। সেই খোঁজা যত দীর্ঘ হয়েছে ততই জীবন আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে চমকপ্রদ, করুন, মানবিক। যারা একসময় নববর্ষের রাতে বিদায় নিতে চেয়েছিলো তারাও নতুন করে বেঁচেছিল অন্য দুনিয়ায়। যেখানে কেউ একজন না বলা কথা বলার আশায় অপেক্ষমান ছিল অনন্ত যৌবন। ওরে খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে ‘ও যেন ঠিক বাতাসের মত, একদম ধরাছোয়ার বাইরে’। এমনিভাবে একদিন শেষ হয়ে যায় জীবনের গল্প। কারো গল্প মধ্যরাতে মাঝসাগরে ঝাপ দেয়, কেউ আবার নতুন গন্তব্যে পথচলা শুরু করে। আসলে ‘জীবন নিয়ে আমরা যতই পরিকল্পনা করিনা কেন ভাগ্যে যা লেখা থাকে তাই ঘটে’।
এই সিনেমার চিত্রনাট্যের পাশাপাশি অসাধারণ ছিল প্রতিটা দৃশ্যের নির্মানশৈলী। সিনেমাকে যদি শিল্প বলতে হয় তাহলে এই ধরনের সিনেমাই তার যোগ্য প্রতিনিধি। বলিউডে এখন ধর্মকে যেমন ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভক্তি টানতে, এই সিনেমা তার থেকে আলাদা। আলাদা হয়ত মালায়লামের সংস্কৃতিটাই। শুরুর দিকে একটা দৃশ্যে লঞ্চে করে পারাপার হওয়ার সময় আমরা যেমন দেখতে পাই মুসলমান এক বয়স্ক লোককে, তেমন দেখতে পাই দুই ভিনদেশী নরনারী, বোরখা পরা কয়েকজন রমনী। সবাই নিজেদের স্বপ্নে বিভোর, নেই কোন সংঘাত।
এই সিনেমার কাহিনীকার উন্নি আর দেখিয়েছেন কিভাবে গল্প বাঁধতে হয়। সংগীতে গোপী সুন্দর ভালো কাজ করেছেন। আর চিত্রগ্রহনে যার কথা না বললেই নয়- তিনি হলেন জমন টি জন প্রত্যেকটা শটে তিনি সিনেমাকে স্টুডিও থেকে বের করে নিয়ে গেছেন প্রকৃতির কাছে, শিল্পের আবরণে বেঁধেছেন। সম্পাদনায় ছিলেন শামির মোহাম্মদ, অভিনয়ে নাম ভূমিকায় ছিলেন দুলকার সালমান- যে ব্যাঙ্গালোর ডেইজ, নীল আকাশ-সবুজ সমুদ্র-লাল পৃথিবীর মত এই সিনেমাতেও অসাধারণ অভিনয় করেছেন। এছাড়া তেসা চরিত্রে পার্বতী তিরুবোত সহ অন্য সবাইও অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন নিজেদের চরিত্রে। আর যার কথা না বললেই নয়, তিনি মার্টিন প্রক্কট যার পরিচালনা এত দুর্দান্ত একটা কাজ এসেছে মালায়লাম থেকে।
সিনেমায় আমরা এমন এক পর্দা খুঁজি যে পর্দা আমাদের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা বিষাদ ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে রাখে। বাণিজ্যিক মিশ্রনে কল্পনার আর অবাস্তবের ডালপালার বিস্তার ঘটিয়ে। বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প নিচের দিকে যাচ্ছে ঠিক এই চক্র থেকে না বের হয়ে আসতে পারার কারনে। সেই ঘোরের ধারাবাহিকতা একসময় বিরক্তি পর্যায়ে চলে যায়। সেই ধারা থেকে বের হয়ে এমন জীবন ঘনিষ্ঠ সিনেমা, যা মানবিক জীবনের গল্প বলে তা মন্দ নয় বৈকি।
লেখক- শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিল্যালয়
অজানা এক জ্বীনের খোঁজে আল মাসুম সাকিল চার্লি মালায়লাম ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি সিনেমা চার্লি