নাট্যাচার্যের প্রয়াণ ছিল তার ইচ্ছামৃত্যু: শিমূল ইউসুফ
১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৩:৩৪
আজ ১৪ জানুয়ারি, নাট্যাচার্য র প্রয়াণ দিবস। ১৩ বছর আগের এই দিনে জাগতিক মায়া কাটিয়ে অনন্তযাত্রায় সামিল হন অমৃতপথের এই শিল্পী। বাংলা নাটকে নতুন ধারার প্রবর্তক এই নাট্যকারের কীর্তিসম্ভারের দীর্ঘদিনের সহযোগী ছিলেন বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের কিংবদন্তী অভিনেত্রী মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফ। সারাবাংলা’র সঙ্গে আলাপে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করলেন এই অমৃতপথের যাত্রীকে। অনুলিখন করেছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্ত।
১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেই। তখনই সেলিম ভাইকে আমি প্রথম দেখি। আমরা তখন সিনিয়রদের অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম এবং তাদের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। সে কারণে তার সঙ্গে আমার তখনও ততটা হৃদ্যতা তৈরি হয়নি। মাঝে মধ্যে সামনা-সামনি হলে সালাম দিতাম— এটুকুই। এর বেশি কথা কখনোই হতো না। আর উনি থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর। সেখান থেকে এসে কাজ সেরে আবার চলে যেতেন। তাই তার সঙ্গে খুব একটা দেখাও হতো না।
এর বেশ কিছুদিন পরে শকুন্তলা স্ক্রিপ্টটা নিয়ে কাজ শুরু হলো। আমরা যখন এটার রিডিং পড়া শুরু করলাম, তখন তিনি জাহাঙ্গীরনগর থেকে নিয়মিত আসতে শুরু করলেন। শকুন্তলা’র ভাষাটা ভীষণ ক্লাসিক্যাল। তখন আমরা এর অনেক কিছুই বুঝতাম না। ওই সময় আমার বয়স ১৭ কি ১৮ হবে। আবার তিনি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, আমরা তাকে খুব ভয় পেতাম। শকুন্তলা স্ক্রিপ্ট নিয়ে যখন প্রশ্ন করতাম, তখন সেগুলো খুব বোকা বোকা মনে হতো। কিন্তু তিনি খুবই মনোযোগ দিয়ে আমাদের প্রতিটি প্রশ্ন শুনতেন। অনেক বাংলা শব্দের অর্থও জানতাম না। জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর মিলত, অভিধান ঘেঁটে অর্থটা জেনে নাও। সে থেকে এখনো অব্ধি আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, কোনো শব্দের অর্থ না বুঝলে অভিধান ঘেঁটে দেখা। উনি আমাদের শিক্ষাটাও দিলেন, আবার অভিধানের অভ্যাসও করে দিলেন।
শকুন্তলা হলো। এরপর ‘চরকাঁকড়া’র ডকুমেন্টারি। এই নাটকে মিউজিক, কস্টিউমের কাজ করতে গিয়েই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলা শুরু। কেমন বা কিভাবে হবে— সব বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হতো। ‘কীত্তনখোলা’ নাটক করতে গিয়ে তার সঙ্গে ক্যারেক্টার অ্যানালাইসিস নিয়ে নিয়মিত বসতাম। এই নাটকে আমি ‘কালিমন’ চরিত্রটা করেছিলাম। এই চরিত্রকে আমি কিভাবে দেখি, জানতে চাইতেন। তিনি তখন আমাকে চরিত্রটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দিতেন। আমাকে বলতেন, ‘তুই গ্রাম-গঞ্জে বেদের বহর, নৌকা ওদের জীবনযাপন— এসব ঘুরে ঘুরে দেখ। তাহলেই তুই চরিত্রটাকে ভালোভাবে বুঝতে পারবি’।
এভাবে নাটকের মাধ্যমেই তার কাছাকাছি হওয়া। পরবর্তীকালে ‘কেরামতমঙ্গল’ নাটকেও অভিনয় ছাড়াও আমাকে প্রি-প্রোডাকশনের সবকিছু করতে হয়েছে। এভাবেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা বা শিল্পসঙ্গী হওয়া। উনি বাচ্চুর (নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) বন্ধু ছিলেন। কিন্তু যেহেতু আমি পারফর্মার এবং সংগীতের মানুষ, তাই বাচ্চুর চেয়েও আমার সঙ্গে আন্তরিকতাটা অনেক বেশি ছিল। আমাদের মধ্যে সংগীতের আদান-প্রদান হতো। উনি প্রায় চলে আসতেন আমাদের কাছে। তখন বন্ধুত্বের বাইরেও আমাদের যে সম্পর্ক— কখনো উনি আমার পিতা, কখনো বন্ধু, কখনো ভাই, আবার কখনো উনিই আমার সন্তান। উনার আবদারটা ছিল এমনই। হয়তো ক্ষুধা পেয়েছে। দৌড়ে এসে বলতেন, আমারে একটু ওইটা বানাইয়া দে না, খাই। সবসময় কিছু না কিছু বানিয়ে দেওয়ার আবদার করতেন। বিভিন্ন খাবার খেতে পছন্দ করতেন। আর খুব গল্প করতে ভালোবাসতেন। উনি আর বাচ্চু যখন শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গল্প করতেন, তখন আমি সেখানে শুধুমাত্র একজন শিক্ষার্থী। আমি শুধু শুনেই যেতাম। আমার বলার কিছু থাকত না। কারণ আমি তাদের মতো অতটা বড়মাপের জ্ঞানী নই।
সেলিম ভাইয়ের লেখার প্রতি আমার এতটাই দুর্বলতা যে তার লেখা ছাড়া আমার আর অন্য কারও নাটকে কাজ করাই হয়ে ওঠেনি। তার ভাষা, তার কল্পনা বা দৃশ্য ভাবনার প্রতি আমার দুর্বলতা এতটাই বেশি যে তিনি যা লিখতেন, আমি সঙ্গে সঙ্গেই তা দেখে ফেলতে পারি। উনি প্রবন্ধ লিখলেও সেটা আমি দৃশ্য ভাবনা করতাম। পরে যখন আমি বর্ণনাত্মক রীতিতে ঢুকলাম, বিশেষ করে ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হাতহদাই’য়ের মতো নাটকগুলো করলাম, সবকিছু আমার চোখে ভেসে উঠত। আমি কোথায় আছি, কী করছি— এগুলো তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং দর্শককেও আমার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া— এই জার্নিটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্র্যাকটিসটা করতে করতেই আমার মনে হলো, আমি বোধ হয় আর কার সংলাপ বলতে পারব না।
সেলিম ভাইয়ের মধ্যে যে সমৃদ্ধি আর আধ্যাত্মিকতা— সবকিছু মিলিয়েই উনি লিখতেন। তার একটা আধ্যাত্মিক জীবন ছিল। অনেকেই এটা জানত না। উনি ভীষণ আধ্যাত্মিক পর্যায়ের একজন মানুষ ছিলেন। তিনি তার এই আধ্যাত্মিকতা আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তাকে এবং তার লেখাকে বোঝার জন্য তিনি লেখক মানুষ একদম আলাদা। আবার তিনি যখন গল্পের মানুষ, বন্ধু মানুষ, সেটাও একদম আলাদা। তখন তার মধ্যে শিশুর মতো সারল্য। অনেক বিষয়েই খুবই অবাক হতেন। সাধারণ বিষয়ও তাকে বুঝিয়ে দিতে হতো। আমি আর বাচ্চু এটা খুবই উপভোগ করতাম।
তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, দুঃখ-কষ্ট সবই আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। তার শ্যালিকার মেয়ে ‘অনিতা’কে সেলিম ভাই ও পারুল ভাবী দত্তক নিয়েছিলেন। একটা সময় ‘অনিতা’ অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে সময় সেলিম ভাইয়ের মধ্যে পিতৃত্বের যে আকাঙ্ক্ষা ও বেদনা, সেটা আমি খুব কাছ থেকেই দেখেছি। হাসপাতালে অনিতাকে দেখে উনি আমাদের বাসায় চলে আসতেন। দেখতাম সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন, আর আর দু’চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। বলতেন, ‘আমি অনিতার মৃত্যু দেখতে পারব না। আমি অনিতার আগেই চলে যাব।’ সেটাই সত্যি হলো। উনি চলে গেলেন অনিতার আগেই— ১৪ জানুয়ারি। আর অনিতা পৃথিবীর মায়া কাটালো ২৯ ফেব্রুয়ারি।
তার চলে যাওয়াটাকে আমি মনে করি ইচ্ছামৃত্যু। তার মৃত্যুর ক’দিন আগে সম্ভবত ঈদুল আজহা ছিল। তখন ডিসেম্বর মাস, সেলিম ভাই সেনেরখীল গ্রামে। সেবার ভীষণ শীত পড়েছিল। আমি আর বাচ্চু দু’জনেই তাকে প্রচুর অনুরোধ করেছিলাম চলে আসতে। আমি তার গলা শুনে বলেছিলাম, ‘সেলিম ভাই, তোর গলাটা আমার ভালো লাগছে না। ভীষণ কফ জমে গেছে। তুই কথা বলতে পারছিস না। এত ঠান্ডায় থাকিস না তুই, চলে আয় ঢাকায়।’ বললেন, ‘না রে, আমি ঈদ করেই আসব।’ ঈদ চলে গেল, সেলিম ভাই আর ফিরলেন না। যখন ফিরলেন, তখন নিউমোনিয়ায় ভুগছেন। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, তিনি সেটা আমাদের কাউকে বলেননি।
তিনি ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে জাহাঙ্গীরনগরে ফিরলেন। কিন্তু আমি আর বাচ্চু সেটা জানতামই না। যদি জানতে পারতাম, তাহলে সেদিনই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতাম। তাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিতাম না। আসলে যেটা হওয়ার নয়, সেটা হবেই না। আর যেটা হবে, সেটা যেকোনোভাবে হবেই। তিনি বাঁচতে চাননি বলেই হয়তো চিকিৎসার সুযোগটা কাউকে দিলেন না। যেটা চেয়েছেন, সেটাই হয়েছে।
তার চাওয়াটা পূরণ হয়েছে, কিন্তু সবশেষে ক্ষতিটা তো আমাদের সবারই হলো। আমরা সবাই স্থবির হয়ে গেলাম। এখনো তাই আছি।
(বি .দ্র.- সাক্ষাৎকারটি ২০২০ সালে নাট্যাচার্যে র ১২তম প্রয়াণ দিবসে সারাবাংলায় প্রকাশ হয়)