‘রণযোদ্ধা’— এক ক্যানভাসে ৭ বীরশ্রেষ্ঠের গল্প
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:০৫
সাত জন পরিচালক, গল্প সাতটি। তবে সেই সাতটি গল্প এসে মিলবে একই মোহনায়। সেলুলয়েডের ফিতায় সাতটি গল্প মিলেমিশে পরিণত হবে একটি গল্পে। আর সেটি সম্ভব হবে কারণ— সাতটি গল্পেরই সময়কালটা যেমন এক, তেমনটি সাতটি গল্পই উৎসারিত একই জায়গা থেকে— একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়েও এর আঙ্গিক কিছুটা ভিন্ন। ওই যে সাতটি গল্পের কথা বলা হচ্ছে, ওই সাত গল্পের একেকটির কেন্দ্রে যে রয়েছেন আমাদের একেকজন বীরশ্রেষ্ঠ। আর তাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে সাতের গল্পের মিশেলে যে একক ক্যানভাস ফুটে উঠবে রুপালি পর্দায়, তারই নাম দেওয়া হয়েছে ‘রণযোদ্ধা’।
সাতটি গল্প যেমন থাকছে এই চলচ্চিত্রে, সেই একেকটি গল্পের জন্য তেমনি থাকছেন একেকজন পরিচালকও। কাওসার মাহমুদ, সানী সানোয়ার, কামরুল ইসলাম রিফাত, রাইসুল ইসলাম অনিক, রাশিদ পলাশ, গৌতম কৈরী ও সাকিব সনেট— সাত পরিচালকের পরিচালনায় ফুটে উঠবে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের কথা। কেমন করে ‘রণযোদ্ধা’ চলচ্চিত্রের ভাবনা এলো, কিভাবে এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা চলছে, কাহিনী বিন্যাস কেমন হবে— সারাবাংলার সঙ্গে এক আড্ডায় সেসব তথ্য জানালেন পরিচালকেরা। সানী সানোয়ার ছাড়া বাকি ছয় পরিচালকই উপস্থিত ছিলেন আড্ডায়। সেই আলাপচারিতার সূত্র ধরেই ‘রণযোদ্ধা’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
শুরুটা যেভাবে
২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল দেশের প্রথম অমনিবাস চলচ্চিত্র ‘ইতি তোমারই ঢাকা’। ওই সময় কয়েকজন সমমনা পরিচালক মিলে সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে এরকম ছবি নির্মাণের চিন্তা করেন। রাশিদ পলাশ বললেন, ‘সবাই জানি আমাদের সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছেন। কিন্তু তারা আসলে কত বড় বীর, তাদের বীরত্বের সেই গল্পটা আমরা বিস্তারিত জানি না। আমরা যখন তাদের নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম তখন খুবই শিহরিত হতে থাকলাম। মনে হলো এরকম একেকটা প্লট নিয়ে তো সিনেমা হওয়া দরকার। সেই জায়গা থেকে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, কিন্তু দেশটাকে ভালোবাসি— তারা মুক্তিযুদ্ধের মহান বীরদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ছবিটি নির্মাণ করছি।’
এক ফ্রেমে এক ক্যানভাসে সাত বীরশ্রেষ্ঠের গল্প
সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য, নাটক, ডক্যুমেন্টারি হলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হয়নি। রাইসুল ইসলাম অনিক বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে প্রথম সিনেমা হবে। সে সিনেমায় এক ফ্রেমে এক ক্যানভাসে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প দেখতে পাবে দর্শক।’
সাত পরিচালক, কারণ…
অনিক বলেন, ‘সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের যুদ্ধ, তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা, লাইফস্টাইল, ফিচার, বীরত্ব তুলে নিয়ে আসা একজন পরিচালকের জন্য একই ছবিতে একই সময়ে তুলে আনা অনেক কঠিন কাজ। তাই সবার সিদ্ধান্তে সাত জন পরিচালক নেওয়া হয়েছে।’
গবেষণা ও চিত্রনাট্য
পরিচালনার পাশাপাশি ‘রণযোদ্ধা’র চিত্রনাট্য করছেন গৌতম কৈরী। ছবির গল্প যুদ্ধের আগের কয়েক মাস থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ১৬ ডিসেম্বরে গিয়ে। ছবিটি নিয়ে কাজ করছে একটি গবেষণা দল। গৌতম জানালেন, এই গবেষণায় তাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একই ঘটনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের মধ্য থেকে সঠিক তথ্যটি বেছে নেওয়া।
একটি উদাহরণ দিয়ে অনিক বললেন, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে নিয়ে এক জায়গায় বলা হচ্ছে তিনি বিমান ছিনতাইয়ের আগে দুই ঘণ্টা ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, তিনি সরাসরিই বিমানে উঠে ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। আবার বলা হচ্ছে, তিনি লিখিত অনুমতি নিয়েছিলেন উড্ডয়নের আগে।
এ ধরনের বিভিন্ন বিষয়গুলো সমন্বয়ের ব্যাপারে গৌতম কৈরী বলেন, ‘রণযোদ্ধার চিত্রনাট্যের জন্য ওই সময়কার পত্রপত্রিকার রেফারেন্স, আর্কাইভাল ফুটেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। বীরশ্রেষ্ঠদের ওইভাবে কোনো আর্কাইভাল ফুটেজ নেই। তবে তাদের প্রত্যকের একটা করে ছবি পাওয়া যায়। আমরা ওই সময়ে তাদের প্লাটুনে কিংবা তিন বাহিনীর যারা জীবিত আছেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলছি। বিভিন্ন বই পড়ছি। বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলছি। তাদের থেকে যুদ্ধের আগের গল্প শুনছি, পরিবারে তারা কেমন ছিলেন তা শুনছি। বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করছি। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অনেক বড় একটি সোর্স ছিল আমাদের জন্য।’
তিনি জানান, সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের যুদ্ধ সময়কার বীরত্বের গল্পই মূলত বলা হবে। তবে এর মাঝে মাঝে তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু মুহূর্তও স্থান পাবে ছবিতে।
সাত বীরশ্রেষ্ঠের গল্পে একজন বীরঙ্গনা
কেবল সাতটি গল্প একে একে বললেই তো সেটি একক গল্পে পরিণত হয় না। এ ক্ষেত্রে বীরশ্রেষ্ঠদের এই গল্পে একটি সংযোগ হিসেবে রাখা হয়েছে একজন বীরাঙ্গনার গল্পকে। গৌতম কৈরী বলেন, ‘সাতটা গল্প যদি একসঙ্গে বলতে চাই, তাহলে সাতটা গল্পের মাঝে একটা কানেক্টিং ব্রিজ লাগে। সে জন্য একজন বীরঙ্গনার গল্প বলা হচ্ছে।’ বীরঙ্গনা চরিত্রে অভিনয় করবেন ববি। তার চরিত্রের নাম থাকবে শারমিন।
কার গল্প কতটুকু
কোনো পরিচালকের জন্য বা বীরশ্রেষ্ঠের জন্য আলাদা করে কোনো টাইম ফ্রেম বেঁধে দেওয়া নেই ‘রণযোদ্ধা’য়। রিফাত জানালেন, যদি কোনো গল্প ১৫ মিনিটে বলে দেওয়া যায়, সেটি ওই সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে, বাড়ানো হবে না। আবার কোনো গল্পে বেশি সময় লাগলে সেটিও দেওয়া হবে।
লাগবে ৩০০ অভিনয়শিল্পী, কেউ চূড়ান্ত না
সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের চরিত্রে দেশের সাত নায়ক অভিনয় করবেন। আর পুরো ছবিতে অভিনয়শিল্পী লাগবে ৩০০ জন। অনিক জানালেন, তারা এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ জন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আর বীরশ্রেষ্ঠদের চরিত্রে এখন পর্যন্ত কাউকে চূড়ান্ত হয়নি বলে জানালেন রাশিদ পলাশ।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, হামিদুর রহমান, মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, মতিউর রহমান, মুন্সি আব্দুর রউফ ও নূর মোহাম্মদ শেখ— আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠ। তাদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩৬ বছর পর্যন্ত। একজন একেক বাহিনীতে ছিলেন। তাদের চেহারাও সবার পরিচিত, উচ্চতাও সবার জানা। তাই কামরুল রিফাত বললেন, ‘এমন না যে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের চরিত্রে সাত জন তারকাই অভিনয় করবেন।’
কে কোন বীরশ্রেষ্ঠ
বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয় বলে জানালেন রাশিদ পলাশ। তিনি বলেন, ‘আমরা শিল্পীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে তারপর জানাতে পারব কে কোন বীরশ্রেষ্ঠের চরিত্র করছেন।’
সময়কে পর্দায় আনার চ্যালেঞ্জ
‘রণযোদ্ধা’ হতে যাচ্ছে একটি পিরিয়ডিক্যাল ছবি। আবার সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প দেখাতে গেলে তাদের ওই সময়ের স্থান, পোশাক, পরিবেশ পরিস্থিতি পর্দায় তুলে আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ ব্যাপারে কাওসার মাহমুদ জানালেন, তাদের গবেষণা দলকে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন গবেষক সহায়তা করছেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো বীরশ্রেষ্ঠের গল্প হয়তো ভূমিতে, কারও হয়তো পাহাড়ে। আমাদের চেষ্টা থাকবে যতটা সম্ভব বিষয়গুলোকে পর্দায় ঠিকঠাক তুলে আনা যায়। তারপরও কিছু জিনিসের জন্য আমাদের ভিএফএক্সের সাহায্য নিতে হবে। এ জন্য অনিক দেশের ও দেশের বাইরের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।’
অনুমতি
সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলেই সামরিক বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও তাদের পরিবারের অনুমতির ব্যাপার চলে আসে। ‘যে মানুষগুলোকে নিয়ে আমরা কাজ করব, সে মানুষগুলো তো দেশের সম্পদ। দেশের সম্পদ যেহেতু, সেহেতু তাদের নিয়ে কথা বলার, তাদের বীরত্বের কথা বলার অধিকার সবারই আছে,’— বলেন কাওসার মাহমুদ।
প্রযোজকের চ্যালেঞ্জ
ছবিটি প্রযোজনা করছে বি হ্যাপি এন্টারটেইনমেন্ট ও পুণ্য ফিল্মস। বি হ্যাপি এন্টারটেইনমেন্টের কর্ণধার সাকিব সনেট প্রযোজনার পাশাপাশি ছবিটির একজন নির্মাতাও। তিনি জানালেন, প্রযোজক হিসেবে তিনি কোনো ভয় পাচ্ছেন না। কারণ হিসেবে জানান, তার সবশেষ নির্মাণ ‘নোলক’-এ তিনি সাড়ে ৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের পরিবারে একজন সেক্টর কমান্ডার আছেন, আছেন বীর বিক্রম। এ ছবির গল্প পরিকল্পনা যখন আমার কাছে আসে, তখন আমি বলেছি, আমি যতটাসম্ভব এতে থাকব। কারণ পারিবারিক কারণে হোক বা নিজের উপলব্ধির জায়গা থেকে হোক, মুক্তিযুদ্ধ ও এর চেতনাকে আমরা ধারণ করি।’
মেকআপ
যেহেতু পিরিয়ডিক্যাল ছবি, ফলে এই ছবির চরিত্রগুলোর পোশাক থেকে শুরু করে মেকআপেও দিতে হবে বাড়তি মনোযোগ। কামরুল রিফাত জানালেন, ছবির মেকআপের জন্য দেশের বাইরে থেকে একটি দল কাজ করবে।
বাজেট
সাকিব সনেট দাবি করলেন, যৌথ প্রযোজনা ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় বাজেটের ছবি হতে যাচ্ছে ‘রণযোদ্ধা’। ‘আমরা বিভিন্ন বাহিনী থেকে যে সাপোর্ট পাচ্ছি তাকে কীভাবে আপনি মূল্যায়ন করবেন? সেগুলোর আর্থিক মূল্য ধরলে তো শত কোটি টাকা হয়ে যাবে ছবির বাজেট,’— বলেন সাকিব সনেট।
সারাবাংলা/এজেডএস
কাওসার মাহমুদ কামরুল ইসলাম রিফাত গৌতম কৈরী নূর মোহাম্মদ শেখ মতিউর রহমান মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মুন্সি আব্দুর রউফ মোস্তফা কামাল মোহাম্মদ রুহুল আমিন রণযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম অনিক রাশিদ পলাশ সাকিব সনেট সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ সানী সানোয়ার হামিদুর রহমান