‘কখনো ফিরে আসলে এই জীবনটাই চাইবো’
২০ মার্চ ২০১৮ ১৮:২৯ | আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৮ ১৯:১৮
তুহিন সাইফুল, খুলনা থেকে ফিরে
গত শতকের শেষ দিকে ‘নতুন কুঁড়ি’তে ফুল হয়ে ফুটেছিলেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তখন তিনি দশ বছরের শিশু, কৈশোর উঁকি দিচ্ছে কেবল তার মগজ ও মননে! আরোপিত গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠার সেই তো শুরু! এরপর মফস্বলের বিহ্বল চোখে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন পর্দায় আটকে পড়া পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবন। রাত্রি ও নক্ষত্রের মাঝখানে বসে গায়ে মেখেছেন সেলুলয়েডের কমলা রাঙা রোদ। আর খুঁজে নিয়েছেন প্রিয় বন্ধু, অগুন্তি আলোর মানুষ আর নিজের অস্তিত্বের সংজ্ঞা।
- ফাগুন হাওয়ায় কেন যুক্ত হলেন?
ভাষা আন্দোলনের ওপর বিস্তারিত কাজ হয় নাই বাংলাদেশে, আর তৌকির ভাইয়ের সঙ্গে এর আগে ‘হালদা’য় কাজ করেছি, সেটা খুব ভালো কাজ ছিল। যখন দেখবেন একটা স্ক্রিপ্ট ভালো, গল্প ভালো, পরিচালক ভালো, সহশিল্পীরা অনেক ভাল, তখন এই ‘ভালোটা’র সঙ্গে থাকাটাই অনেক বেশি বড় বলে মনে হয় আমার কাছে। শুধু এটাই নয়, ফাগুন হাওয়ার চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে গল্পটাও অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বানানো একটা সিনেমার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারব এটাও একটা বড় ব্যাপার।
- ফাগুন হাওয়ায় আপনি যেমন সিয়ামের মতো নতুনের সঙ্গে কাজ করছেন, তেমনি যশপাল শর্মার মতো অভিজ্ঞ এবং বিদেশি ভাষার অভিনেতার সঙ্গে কাজ করছেন, অভিজ্ঞতাটা কেমন?
এর আগেও আমি বলিউডের ইরফান খানের সঙ্গে কাজ করেছি, পরমব্রতের সঙ্গে কাজ করেছি, ইয়াদ হুরানির সঙ্গে কাজ করেছি, যশপালের সঙ্গে এবার কাজ করছি, এদের সবার সঙ্গেই অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। আমার আশেপাশে যেসকল সহশিল্পী আছেন, যেমন সিয়াম, রওনক, হায়াত কাকা (আবুল হায়াত), এদের সবার সঙ্গে অভিনয়টা আমি উপভোগ করছি। হলিউড বলিউড যেখান থেকেই শিল্পী আসুক না কেন, সবার সঙ্গে কাজ করেই আমার ভালো লাগে। কারণ, তারা অনেক সহযোগিতা প্রবণ, আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা শিল্পী। সুতরাং শিল্পের সূত্র ধরে বলব, এদের সঙ্গে অভিনয় করতে অনেক ভালো লাগছে।
- পর্দায় আপনি বেশ সাবলীল অভিনয় করেন, আপনার অভিনয় যারা দেখে তারা বলে থাকে যে আপনি চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন…
মিশে কি যাই? আদৌ কি মিশে যেতে পারি? যদি যেতে পারি তাহলে এটা পরিচালকের কৃতিত্ব। এই পর্যন্ত যত চরিত্রে অভিনয় করেছি, সবগুলো চরিত্রে যদি সামান্যতমও মিশে যাওয়া থাকে, তাহলে আমি অবশ্যই পরিচালকদের কৃতিত্ব দেব। কারণ, উনাদের জন্যই আমি চরিত্র বুঝতে সক্ষম হই এবং চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে যেমন প্রস্তুতি দরকার হয় সেটা নিতে পারি। এই কারণেই দর্শক এমনটা ভাবেন। চরিত্রের সঙ্গে একেবারে মিশে যাওয়ার গুণ আমার আছে কিনা আমি নিশ্চিত না, তবে আমি এটা বলব যে আমি আমার পেশাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি।
- আপনার করা চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনটিকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন? কখনো নিজের সিনেমার চরিত্রের মতো হয়ে যেতে কি ইচ্ছে করে?
আমি আমার নিজের চরিত্র এবং নিজের জীবন নিয়ে এতো বেশি সুখি যে, আমি কখনোই চাইবো না সিনেমার কোন চরিত্রের মতো জীবন হোক আমার। যদি আবার কখনো জন্ম নেই তাহলে আমি এই জীবনটাই চাইবো। এই পরিবারটাই চাইবো। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে অনেক সুখি। কোন ‘চরিত্রের’ মতো জীবন আমি চাইনা। তবে আমি অনেক অনেক চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। সঙ্গে জীবন বলতে একান্তই নিজের জীবনটা যাপন করতে চাই। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি কারণ সে আমাকে অনেক সুন্দর একটা জীবন দিয়েছে এবং অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিয়েছে।
- ডুব নিয়ে বাংলাদেশে বেশ বড়সড় বিতর্ক হয়ে গেলো, অনেকেই বললো এই গল্প বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় একজন লেখকের জীবন থেকে নেয়া, ছবিটিতে আপনি লেখকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, বাস্তবজীবনে কি এমন কারো সঙ্গে আপনার পরিচয় রয়েছে যার সঙ্গে আপনার করা সেই চরিত্রটির অনেক মিল?
না… (একটু থেমে) বাংলাদেশের মতো জায়গায় সাবেরীর মতো মানুষ অনেক রয়েছে। এমন কাউকে আমি কখনো দেখিনি, তবে আছে! (আরেকটু সময় নিয়ে, ভেবে) আমার সঙ্গে এমন কারো কখনো পরিচয় হয়নি। কখনো দেখা হলে হয়তোবা তার অনুভূতি, চিন্তা বোঝার চেষ্টা করব। জীবন সম্পর্কে তার দর্শন হয়তো অন্যরকম হবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করব।
- বিয়ের পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি সিনেমাতে আপনি অভিনয় করেননি। পিপড়াবিদ্যা। সেই সিনেমায় না থাকার আক্ষেপ কখনো কাজ করে কিনা?
আমি তো ওর (ফারুকী) কোন সিনেমাতে অভিনয়ই করতে চাই না! (হেসে) কারণ আমার কাছে মনে হয় মানুষ বলবে জামাইয়ের সিনেমায় বউ অভিনয় করে! ওই সেন্সে তো আমার ‘টেলিভিশন’ সিনেমাতে অভিনয় করার কথা ছিলো না। ‘থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার’-এর পরে আমি সবসময় বলছি যে, আমি তোমার সিনেমা করতে চাই না। ‘টেলিভিশন’ আমি না বলেছিলাম, ‘শনিবার বিকেল’ ছবিতেও আমি না বলেছি কিন্তু আমাকে করতে হয়েছে। যেমন টেলিভিশন করেছি কেন, আনিসুল হক আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে, আমারও মনে হয়েছে যদি চরিত্র আমাকে চায়, যদি একটা ভালো চিত্রনাট্য পাই, পরিচালক যদি অন্য কেউও হয় তাহলে আমি অবশ্যই ছবিটা করতাম, এক্ষেত্রে ওকে হাজবেন্ড হিসেবে না দেখে যদি পরিচালক হিসেবে দেখি তাহলে আমার জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং আমি তাই করি।
- পরিচালক ফারুকী সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
পরিচালক হিসেবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে আমার চেয়েও বেশি মূল্যায়নটা করবে দর্শক এবং সেটা তারা করছেও। অভিনেত্রী হিসেবে অন্যান্যরাও যেভাবে ওকে মর্যাদাটা দেয় আমিও সেটাই দেই। আসলে পরিচালক হিসেবে দর্শকের সারিতে বসেই আমি ওকে মূল্যায়ন করতে পছন্দ করি।
- আপনি শেষ যে চারটা সিনেমাতে অভিনয় করেছেন বা করছেন, এর মধ্যে দুটো ছবির পরিচালক তৌকির আহমেদ, দুটোর ফারুকী; এই দুজনের মধ্যে আপনি কাকে এগিয়ে রাখবেন?
দুজনই একরকম আমার কাছে। গুড ডিরেক্টর আমার কাছে সবসময় গুড ডিরেক্টরই। এক দুই তিন চার, এটা আমি করতে পারবো না। কারণ আমি ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে চাই, যারা সিনেমাটা নিজে বোঝে এবং বোঝাতে পারে। এই দুজন পরিচালকই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং সিনেমাটা নিজে বোঝে এবং বোঝাতে পারে। পড়াশোনা করে কাজ করে। নিশ্চিত ভাবেই দুজনের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমার ভাল লাগে। দুজনেই আমার কাছে সমান, এরা সমান গতিতেই দৌঁড়াচ্ছে।
- ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটিকে গ্লোবাল সিনেমা বলা যায়, বাংলাদেশের পাশাপাশি জার্মানি ও ভারত সিনেমাটিতে অর্থ লগ্নি করেছে, ফিলিস্তিন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিথযশা অভিনেতারা অভিনয় করেছেন, এই ছবিটা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা…
আমারও খুব জানার ইচ্ছা! (হাসি) আমি আসলে প্রিভিলাইজড! এতগুলো দেশ মিলিত ভাবে, এতগুলো আর্টিস্ট মিলিত ভাবে একটা খুব সুন্দর কাজ করছে এবং সেই কাজে আমি অংশ নিতে পারছি, এটা সত্যিই গর্বের এবং আনন্দের। একই কথা আমি ‘ফাগুন হাওয়া’কে নিয়েও বলব। এত সুন্দর চিত্রনাট্য, এত ভালো গল্প, ভালো পরিচালক, ভাষা আন্দোলনের মতো একটি বড় ঘটনা নিয়ে সিনেমা হচ্ছে এবং আমি সেটার অংশ হতে পেরেছি, আমি আনন্দিত।
- একবার বলেছিলেন, আপনি সিনেমা দেখতে বেশ পছন্দ করেন। এমন কোন সিনেমা কি আছে যেটা দেখে মনে হয়েছে এটাতে তিশা অভিনয় করলে ভালো করতো?
আমার খুব পছন্দের সিনেমা হচ্ছে নাটালি পোর্টম্যান অভিনীত ‘ব্ল্যাক সোয়ান’। এমন আরও অনেক সিনেমা আছে যেগুলো আমার প্রচণ্ড রকমের ভালো লাগে। তবে আমার কখনো মনে হয়না ওই জায়গায় আমি অভিনয় করলে ভালো করতাম। যেমন জুলিয়েন মুরের ‘স্টিল এলিস’ সিনেমাটাও আমার খুব পছন্দের, ওখানে আমি করলে ভালো করতাম এটা আমার কখনো মনে হয় না, কিন্তু মনে হয় এই ধরণের বা এর কাছাকাছি কোন চিত্রনাট্য আমাকে দিলে, আমি জানপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করব। আমি পুনঃনির্মাণ এবং প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করি না, আমি নিজের উপর বিশ্বাস রাখি। আমি মনে করি আমার ভাগ্যে যেটা আছে সেটা আমি পাবো। এরজন্য আমাকে কাজ করতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। ভালো ভালো সিনেমা যখন দেখি, তখন ভাবি এমন চরিত্র পেলে অভিনয়ে আমি নিজেকে উজার করে দেবো।
- ১৯৯৬ সালে মিডিয়াতে এসেছেন, সেই নতুন কুঁড়ি থেকে শুরু, এই শুরুর শেষ হবে কোথায়?
আমি জানি না! আমি আসলে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় বিশ্বাস করি না। আমি খুব প্লান করে কিছু করি না। আমি ভালো থাকতে চাই, ভালো রাখতে চাই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় বিশ্বাস। দর্শকদের ভালোবাসা আমার উপরে আছে, সেই ভালবাসা-শ্রদ্ধাকে আমার ভেতরে রেখে ভালভাবে জীবন ধারণ করতে চাই। ভালো কিছু কাজ রেখে যেতে চাই। এরপর এই করব, সেই করব এমন পরিকল্পনা আমি করব না। আমি খুব ক্রিটিকাল চিন্তা করি না, আমি এখন যেখানে আছি, যেভাবে আছি সেভাবেই জীবনটা যাপন করতে চাই। ভবিষ্যত- ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
- এই সম্পর্কিত ভিডিও স্টোরি
https://www.youtube.com/watch?v=AHYwqeXl8Ys
ছবি ও ভিডিও: আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/টিএস/পিএ